এখন কোন পথে যাবে চীন-ভারত
মোদি ও শি - প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস অতিমারি এখনো ভয়াবহ তাণ্ডব চালাচ্ছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসন্ন বলে মনে হচ্ছে, বর্ণবাদ ও পুলিশ সহিসংতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী উত্তপ্ত প্রতিবাদ চলছে। এমন অবস্থায় বিশ্বের সবচেয়ে কাম্য যে বিষয়টি তা হলো বিশ্বের বৃহত্তম দুটি দেশের (উভয়ের মিলে প্রায় ৪৩০টি পরমাণু বোমা আছে) মধ্যকার স্থল যুদ্ধ।
চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তপ্ত সীমান্ত বিরোধ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভারতের ভাষায় সোমবার চীনা সৈন্যদের সংঘর্ষ। প্রাথমিক ঘুষাঘুষিতে সীমান্তে টহলরত তিন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়, পরে আহত ১৭ জন মারা যায। অন্যরা এখনো নিখোঁজ রয়েছে বা বন্দী হয়েছে। এখনো ওই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখনো পাওয়া যায়নি। ভারতীয় মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছে, চীনাদের মধ্যেও হতাহত হয়েছে। তবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মে মাসে প্রথম ঘুষাঘুষির পর দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের যে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিল, এই ঘটনায় তা বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
সর্বশেষ এই উত্তেজনা সীমান্ত এলাকায় কয়েক দশকের উত্তপ্ত অবস্থার ধারাবাহিকতা। ভারত ও চীন ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত তবে তীব্র সীমান্ত যুদ্ধে অংশ নেয়, তাতে চীন জয়ী হয়। দুই পক্ষ সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কয়েক রাউন্ড বৈঠক করলেও চূড়ান্ত কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। দুই দেশের মধ্যে থাকা ২,৫০০ মাইল সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগই জনবিরল পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে। এই সীমান্তই এখন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অচিহ্নিত সীমান্ত। দুই পক্ষের সামরিক বাহিনী শিথিলভাবে চিহ্নিত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের মাধ্যমে আলাদা করা। কিন্তু ঠিক কোনটি সীমান্ত রেখা, তা নিয়ে কোনো পক্ষই একমত নয়। ভারতীয় মিডিয়া দাবি করেছে, ২০১৯ সালে সীমান্তরেখা জুড়ে ৪৯৭ বার চীনা অনুপ্রবেশ ঘটে, এসবের কোনো কোনো সময় সংঘর্ষ হয়েছে। তবে অলিখিত নিয়মানুসারে কোনো পক্ষ বন্দুক ব্যবহার করেনি। ফলে ১৯৭৫ সালর পর থেকে গুলিবিনিময় হয়নি। অবাক করা বিষয় হলো, উচ্চ প্রযুক্তির দুই সামরিক বাহিনীর লড়াইটি এখনো হচ্ছে পাথর আর ধাতব লাঠি দিয়ে। বিকল্প অন্য কিছুর চেয়ে এটি অনেক ভালো।
এর আগে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল ২০১৭ সালে। ওই সময় দোকলাম মালভূমিতে চীনের একটি রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ প্রতিরোধ করেছিল ভারত। ভুটানের পক্ষ থেকে ওই কাজে নেমেছিল ভারত। ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, সোমবার যেখানে সংঘর্ষ হয়েছিল, সেখানে চীন ৫,০০০ সৈন্য এনে তাদের শক্তি বাড়িয়েছিল।
ইতিহাস থেকে যদি নির্দেশনা পাওয়া যায়, তবে বলা যায় যে দুই পক্ষ এই হতাহতের ঘটনার পরও আলোচনায় বসতে পারবে। কারণ উভয় পক্ষই মনে করে, সীমান্ত উত্তেজনা আসলে বৃহত্তর কৌশলগত অগ্রাধিকার থেকে বিচ্যুতি। তাদের মতে, এই উত্তেজনা বাড়তে দেয়া উচিত নয়। তবে আড়ালে থাকা কিছু ঘটনা আরো উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক মনোযোগ সরে যাওয়ায় শি জিনপিঙের সরকার বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক তৎপরতা জোরদার করাসহ বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতে সার্বভৌমত্ব দাবি জোরদার করা, হংকংয়ের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার মতো কাজগুলো আগ্রাসীভাবে করছে। এই তৎপরতা ভারত সরকারকে সতর্ক করেছে। ভারত আগে থেকেই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামে পরিচিত চীনের বিশাল বৈশ্বিক অবকাঠামো বিনিয়োগ কর্মসূচির প্রতি উদ্বেগ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। বিরোধপূর্ণ কাশ্মির অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন। আবার ভারতের দীর্ঘ দিনের মিত্র ও প্রতিবেশী নেপালে প্রভাব জোরদার করছে চীন। নেপালও এখন ভারতের সাথে আরেকটি সীমান্ত বিরোধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। ভারতীয় নেতারা সম্ভবত মনে করছেন যে তার প্রতিবেশী এলাকায় ক্রমবর্ধমান চীনা সামরিক প্রভাব প্রতিরোধ করার এটিই শেষ সুযোগ।
তবে প্রাথমিক খবরগুলোতে বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবস্থা খুবই খারাপ। ভারত সরকার এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
উভয় দেশের কট্টর জাতীয়তাবাদের চরম মাত্রা এখনো নিশ্চিতভাবেই স্থিতিশীল বিষয় হয়নি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সদানন্দ ধুম লিখেছেন যে ভারতীয় জনমত দ্রুততার সাথে চীনবিরোধী হয়ে পড়ছে। সামাজিক মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জন্য চীনকে দায়ী করেছে ভারতীয়রা। সিএনএনের খবরে বলা হয়, ভারতীয় অ্যাপ স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে চীনা অ্যাপের। চীনা সফটওয়্যার বয়কট করছে ভারতীয়রা।
এদিকে গ্লোবাল টাইমসের মতো চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাসে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ওই দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে নরেন্দ্র মোদি সরকার এখন সীমান্ত সংঘাতের দিকে মনোযোগী হয়েছেন।
এছাড়া আছে ট্রাম্প ফ্যাক্টর।বিশ্বের যেকোনো নেতার চেয়ে মোদির সাথেই ট্রাম্পের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। লোকরঞ্জক-জাতীয়তাবাদী এই দুই নেতা দায়িত্বে থাকার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রেক্ষাপটে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা ম্লান হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউস বিভিন্নভাবে চীনবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও এলএসিজুড়ে চীনা তৎপরতাকে আগ্রাসী আচরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তবে এর মানে এই নয় যে চীনের সাথে সামরিক সঙ্ঘাতে ভারতকে সমর্থন দেয়ার ইচ্ছা আছে ট্রাম্প প্রশাসনের। তবে মোদি এমন ধারণা প্রচার করতে চাইবেন যে ট্রাম্প তাকে সমর্থন দিচ্ছেন। আর শি সম্ভবত এমন ধারণায় থাকবেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তার বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে।
এমন সমীকরণের কারণে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দুই পক্ষ যেসব বিষয় এড়াতে পারত, তা পারবে না, কিছু বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
স্লট.কম