টাইম বোমায় পরিণত চীন-ভারতের সাড়ে ৩ হাজার কিমি সীমান্ত
টাইম বোমায় পরিণত চীন-ভারতের সাড়ে ৩ হাজার কিমি সীমান্ত - প্রতীকী ছবি
গুলি-গোলা চলে না, অতএব ভারত-চীন সীমান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত সীমান্তগুলোর অন্যতম— এমন একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল প্রতিরক্ষা বিশারদদের মধ্যে। দুই বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি, পাথর ছোড়াছুড়ির দৃশ্য সামনে এসেছে অনেক বারই। কিন্তু সীমান্তে কোনো পক্ষই গুলি চালাবে না, এমন সমঝোতাও ভারত-চীনের মধ্যে রয়েছে। অতএব গুলি চলে না, সংঘর্ষ প্রাণঘাতী আকার নেয় না। কিন্তু সোমবার শেষ রাতে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তার পরে কিন্তু ভারত-চীন সীমান্তকে আর ‘শান্তিপূর্ণ’ আখ্যা দেয়া কঠিন হচ্ছে সমর বিশেষজ্ঞদের অনেকের পক্ষেই। গুলিগোলা না চললেও অশান্তির বীজ শুরু থেকেই পোতা রয়েছে ভারত-চীন সীমান্তে, বলছেন তারা।
লাদাখ থেকে অরুণাচল পর্যন্ত ভারত-চীন সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার। ভারতের স্বাধীনতার সময়ে বা চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে কিন্তু এতটা দীর্ঘ সীমান্ত ছিল না ভারত ও চীনের মাঝে। কারণ মাঝের অধিকাংশ এলাকাটাই ছিল তিব্বত, যার নিয়ন্ত্রণ তখন বেইজিঙের হাতে ছিল না। ১৯৫৯ সালে তিব্বতকে পুরোপুরি দখল করে চীন। ফলে ভারত ও চীন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে ওঠে। আর তখন থেকেই সঙ্ঘাত তৈরি হওয়া শুরু হয়।
যে বছর তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিল চীন, তার ঠিক তিন বছরের মাথাতেই কিন্তু ভারত-চীন যুদ্ধ— ১৯৬২ সালে। বেইজিঙের এই আগ্রাসন তথা সম্প্রসারণবাদ যে ভারতের জন্য সমস্যার হয়ে উঠতে পারে, তা ১৯৫৯ সালেই আঁচ করেছিল দিল্লি। তাই নেপালের অনুমতি নিয়ে নেপাল-তিব্বত সীমান্তে বেশ কিছু সামরিক চৌকি বসিয়েছিল ভারত। ১৯৬২-র যুদ্ধে যে হেতু নেপাল-চীন সীমান্ত সে ভাবে তপ্ত হয়নি, সে হেতু ওই চৌকিগুলো খুব কাজে লাগেনি। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর ওই চৌকিগুলোও যে চীনের পছন্দ নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৮ সালে চীন সফর করে আসেন নেপালের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী কীর্তিনিধি বিষ্ট। বেজিঙে গিয়ে মাও সেতুং-এর সঙ্গে দেখা করে আসেন তিনি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী হন কীর্তিনিধি এবং নেপাল-চীন সীমান্ত থেকে ভারতীয় সামরিক চৌকিগুলো সরিয়ে নিতে তিনি দিল্লিকে বাধ্য করেন।
১৯৬২-র যুদ্ধে ভারতের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল লাদাখের অংশ আকসাই চিন। অরুণাচলকে যে হেতু ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে দাবি করে চীন, সে হেতু অরুণাচলের বিস্তীর্ণ অংশেও ঢুকে পড়েছিল চীনা সেনাবাহিনী। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেভাবে বিনা বাধায় অরুণাচলের মধ্যে দিয়ে আসামের তেজপুরের দিকে এগোতে পেরেছিল চীনা বাহিনী, তাতে সংশয় তৈরি হয়েছিল লালফৌজের কর্তাকর্মদের মধ্যে। বিনা বাধায় নিজেদের এলাকায় চীনা বাহিনীকে ঢুকতে দিয়ে পিছন দিক থেকে ‘সাপ্লাই লাইন’ কেটে দিতে পারে ভারত— এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ওই অংশ ছেড়ে চীনা বাহিনী ফিরে যায় দ্রুত। কিন্তু আকসাই চিনে সে রকম কোনো আশঙ্কা ছিল না। চীনা সেনা যত দূর পর্যন্ত ঢুকেছিল, তার পিছন দিকে পৌঁছে ভারতীয় বাহিনী ঘিরে ফেলবে, এমন কোনো রাস্তাই ছিল না বলতে গেলে। ফলে আকসাই চিন ছেড়ে চীন বেরিয়ে যায়নি। এবং তখন থেকেই সীমান্ত নিয়ে বিবাদ রয়ে গেছে।
আকসাই চিন ভারত সরকারের নিন্ত্রণে না থাকলেও ওই অংশকে ভারত নিজেদের মানচিত্রের মধ্যেই দেখায়। ১৯৬২-র যুদ্ধের পরে যে দেশের বাহিনী যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই পর্যন্ত এলাকা সে দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে— এই রকম ভাবেই চলছিল। কিন্তু আকসাই চিনের উপর থেকে নিজের দাবি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে ভারত রাজি হয়নি। ফলে কোনো চিহ্নিত সীমান্তরেখা তৈরি হয়নি। লাদাখের দক্ষিণে হিমাচল প্রদেশ, তার দক্ষিণ-পূর্বে উত্তরাখণ্ড অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতে সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশও চীন সীমান্তে অবস্থিত। সেই সব এলাকাতেও কোনো সীমান্তরেখা চিহ্নিত করা নেই।
কেন চিহ্নিত নেই সীমান্তরেখা? কারণ সীমান্ত সম্পর্কে ভারত ও চীনের বক্তব্যে গোড়া থেকেই ফারাক ছিল। ভারত যেটাকে সীমান্ত বলে মানে, চীন তা মানে না। আবার চীন যত দূর পর্যন্ত এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে, ভারত তা নস্যাৎ করে দেয়। অতএব লাদাখে হোক বা অরুণাচলে, উত্তরাখণ্ডে হোক বা সিকিমে— কোথাওই স্থায়ী ভাবে চিহ্নিত সীমান্ত নেই। কোথাও সারিবদ্ধভাবে পাথর রেখে অস্থায়ী ভাবে সীমান্ত চিহ্নিত করে রাখা হয়। কোথাও আবার সেই পাথুরে সীমানাও নেই। যে এলাকা পর্যন্ত নিজেদের ভূখণ্ড বলে ভারতীয় বাহিনী মনে করে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই পর্যন্ত টহলদারি চালিয়ে আসে ভারতীয় বাহিনী। পরে আবার চিনা সেনাও নিজেদের ইচ্ছামতো টহলদারি চালিয়ে ফিরে যায়।
অর্থাৎ ধারণায় ফারাক। সীমান্ত সম্পর্কে দিল্লি এবং বেইজিঙের ধারণা আলাদা এবং সেখান থেকেই সঙ্ঘাত। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধারণায় ফারাক থাকার কথা নয়। কত দূর পর্যন্ত ভারতের এলাকা, সে সম্পর্কে ভারত আগে যা বলত, এখনো তাই বলে। কিন্তু চিন মাঝেমধ্যেই এক একটা এলাকায় এক এক রকম দাবি করতে থাকে বলে তাদের অভিযোগ। সীমান্ত সম্পর্কে চীনের দাবিতে কোনো ধারাবাহিকতা নেই বলে প্রাক্তন সেনাকর্তাদেরও অভিযোগ। চীন যে সব দাবি করে, তার পক্ষে কোনো ঐতিহাসিক দলিল তারা তুলে ধরতে পারে না বলে তাদের মত। বিভিন্ন এলাকায় সীমান্ত সম্পর্কে চীনের নানা বক্তব্য ভৌগোলিক ভাবেও অবান্তর বলে সেনাকর্তাদের মত।
যার দাবি যা-ই হোক, ভারত ও চীনের সীমান্ত তথা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) আসলে কোনটা, তা চিহ্নিত হয়নি আজও। চিহ্নিত হয়নি বলেই সঙ্ঘাতের অবকাশও থেকে গেছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চীন, সীমান্ত স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত নয় বলে বার বার তা লঙ্ঘন করে সঙ্ঘাত তৈরি করছে চীনা বাহিনী। সীমান্তে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে ভারতকে চাপে রাখাই চীনের লক্ষ্য বলে তাঁদের দাবি। তবে যত দিন না সীমান্ত স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এই রকম সঙ্ঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের মত।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা