চিকিৎসা : কিছু হাদিস
চিকিৎসা : কিছু হাদিস - প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী
সব রোগের চিকিৎসা রয়েছে : আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার কোনো ওষুধ সৃষ্টি করেননি।’ (বুখারি-৫২৭০)
ছোঁয়াচে-সংক্রামক কোনো রোগ নেই : হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লøাহ সা: বলেছেন, ‘ছোঁয়াচে বলে কোনো রোগ নেই এবং সফর মাস ও পেঁচার মধ্যে অমঙ্গল বলে কিছু নেই।’
তখন একজন গ্রাম্য লোক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, তবে আমার এ উটগুলোর এ দশা হলো কেন? এগুলো ছিল চারণভূমিতে, দেখতে বন্য হরিণের মতো সুন্দর। তারপর সেখানে একটি চর্ম রোগাক্রান্ত উট এলো। আমার উটগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং সেগুলোকে চর্ম রোগাক্রান্ত বানিয়ে দিলো।’ তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, প্রথম উটটির মধ্যে রোগ সৃষ্টি করল কে?’ (বুখারি-৫৩০২)
হজরত আবদুল্লøাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লøাহ সা: বলেছেন, ‘রোগে কোনো সংক্রমণ নেই। অশুভ ও কুলক্ষণ বলেও কিছু নেই।’ (বুখারি-৫৩৫৩)
মহামারী আক্রান্ত এলাকায় যেও না : হজরত আবদুল্লøাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা: তাঁর খেলাফতকালে মদিনা থেকে সিরিয়া সফর করলেন। সারগ নামক স্থানে পৌঁছার পর সেনাবাহিনী প্রধান হজরত আবু ওবায়দাহ ইবনে জাররাহ রা: ও তাঁর সঙ্গীরা ওমর রা:-এর সাথে দেখা করলেন। তাঁকে সংবাদ জানালেন, সিরিয়ায় প্লেগ মহামারী দেখা দিয়েছে। ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ওমর রা: সে সময়ে প্রবীণ মুহাজিরিনদের তাঁর কাছে ডেকে আনলেন এবং বললেন, ‘সিরিয়ায় প্লেগ দেখা দিয়েছে। সিরিয়ায় যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে তিনি তাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন, মুহাজিরিনদের কেউ বললেন, আপনি যে উদ্দেশ্যে বের হয়ে এসেছেন, তা থেকে ফিরে যাওয়া আমাদের মত নয়। আর কেউ কেউ বললেন, আপনার সাথে রাসূলুল্লøাহ সা:-এর প্রবীণ সাহাবিরা রয়েছেন; সুতরাং প্লেগ মহামারীর মুখে তাদের তুলে দেয়া আমরা ঠিক মনে করি না।’
তখন ওমর রা: তাদের চলে যেতে বললেন। তারপর নির্দেশ দিলেন মদিনার আনসারদের ডেকে আনতে। তাদের মাঝেও মতানৈক্য দেখা গেল। তিনি আনসারদেরও বিদায় করে দিলেন। এবার তিনি কুরাইশদের প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ লোকদের আসতে বললেন। তাদের মধ্যে দু’জন একমত হয়ে বললেন, আমাদের অভিমত হলো- এই বিশিষ্ট লোকজনসহ আপনার প্রত্যাবর্তন করা উত্তম। আর তাদেরকে প্লেগ মহামারীর মধ্যে তুলে না দেয়াই উচিত; তখন ওমর রা: ঘোষণা করলেন, আগামীকাল খুব ভোরে ফিরে যাওয়ার জন্য বাহনে আরোহণ করব। তার পরদিন লোকেরা খুব ভোরে তার কাছে এলো। আবু ওবায়দাহ ইবনে জাররাহ রা: জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আল্লøাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করতে চান? ওমর রা: বললেন, হে আবু ওবায়দাহ, তুমি ভিন্ন অন্য কেউ যদি এ কথা বলত! হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদির থেকে আল্লাহর অন্য তাকদিরের দিকেই পালাচ্ছি। বলো তো, তোমার কাছে উট আছে- তুমি তা চরাতে এক উপত্যকায় নিয়ে গেলে, সেখানে দু’টি প্রান্তর আছে- একটি সবুজ শ্যামল, অপরটি শুষ্ক ধূসর। ব্যাপারটি এমন নয় কি, যদি তুমি সবুজ-শ্যামল প্রান্তরে চরাও তবে আল্লাহর তাকদির অনুযায়ীই তা করলে। আর যদি শুষ্ক ও ধূসর প্রান্তর নির্বাচন করো, তাও আল্লাহর তাকদিরের কারণেই করলে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা: এসে পৌঁছলেন। কোনো কারণবশত তিনি অনুপস্থিত ছিলেন।
তিনি বললেন, আপনাদের বিতর্কিত বিষয়ে একটি হাদিস আমার জানা আছে। রাসূলুল্লøাহ সা:কে বলতে শুনেছি, ‘যখন তোমরা শুনতে পাও, কোনো স্থানে প্লেগ মহামারী দেখা দিয়েছে, তবে সেখানে যেও না। আর যখন কোথাও তা ছড়িয়ে পড়ে এবং তুমি সেখানে থেকে যাও, তাহলে সেখান থেকে বের হয়ে পলায়ন করো না।’ বর্ণনাকারী বলেন, এই হাদিস শুনে ওমর রা: আল্লøাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর মদিনার দিকে ফিরে চললেন। (বুখারি-৫৩১২)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা: কর্তৃক বর্ণিত। ওমর রা: সিরিয়া যাত্রা করলেন। সারগ নামক স্থানে উপনীত হলে খবর পেলেন, সিরিয়ায় প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তখন আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা: বললেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন তোমরা শোনো যে, কোনো স্থানে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তবে তোমরা সেখানে যেও না। আর যখন কোনো স্থানে তা দেখা দেয়, তোমরাও সেখানে অবস্থান করতে থাকো। তবে সেখান থেকে বাইরে যেও না।’ (বুখারি-৫৩১৩)
ব্যাখ্যা : এখানে বুখারি শরিফ থেকে কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে।
বুখারি শরিফ ৫২৭০ নং হাদিস থেকে উপলব্ধি করা যায়, সংক্রমিত নতুন ভাইরাস করোনার কোনো ওষুধ আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান না হলেও বিশ^প্রকৃতিতে রয়েছে। মানুষ গবেষণা করছে এবং সহসাই তার ভ্যাকসিন বা ওষুধ পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করবে, আল্লাহ তার সমাধান তাদেরকে দান করবেন। রাসূল সা: চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার জন্য তাঁর উম্মতদের উৎসাহ দান করে বলেছেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা ৭০ বছর ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।’
৫৩০২ ও ৫৩৫৩ নম্বর হাদিসে বলা হয়েছে, ছোঁয়াচে বা সংক্রামক বলে কোনো রোগ নেই এবং মহামারী আক্রান্ত এলাকায় যেও না মর্মে ৫৩১২ ও ৫৩১৩ নম্বর হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে। এখানে বৈপরীত্য আছে বলে মনে হলেও আসলে কোনো বৈপরীত্য নেই (আমার উপলব্ধি)। অবস্থা ও পরিবেশে দু’টিই সঠিক।
হাদিস সাধারণত ঘটনাকেন্দ্রিক। বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সমাধান হিসেবে রাসূল সা: নিজের থেকে বা প্রশ্নের জবাব হিসেবে কথা বলেছেন।
তৎকালে মানুষ ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং এখনো তা রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে শুভ-অশুভ সম্পর্কে এবং রোগ-ব্যাধি নিয়ে কুসংস্কার ছিল। ফলে এ সব নিয়ে সমাজে মানুষের মাঝে ভেদাভেদ, স্পর্শ করা না করা এবং সেবা-যতœ নিয়ে নানা বাধা-বিপত্তি ছিল। ফলে মানুষের মাঝে সঙ্কীর্ণতা দূর করে পরস্পরের প্রতি উদার ও সহমর্মী হওয়ার লক্ষ্যে তিনি বলেছেন। তৎকালে কুষ্ঠ রোগকে ছোঁয়াচে মনে করা হতো। রাসূল সা: কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন; আবার কুষ্ঠ রোগীর সাথে খাওয়ারও হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। আসলে ছোঁয়াচে বলে কোনো রোগীকে ঘৃণা কিংবা অবহেলা করে তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বর্তমানে করোনাভাইরাস মহা এক আতঙ্ক এবং সমগ্র বিশ^বাসী এই ভাইরাসে আক্রান্ত। এটি একটি সংক্রামক ভাইরাস যার কোনো চিকিৎসা আজো উদ্ভাবিত হয়নি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশে^ লাখ লাখ লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে। এটি বায়ু বা পানিবাহিত কোনো রোগ নয়; বরং এটি ছড়াচ্ছে মানুষের মাধ্যমে (একজন থেকে আরেক জনে)। ফলে এর থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিশ^ব্যাপী চলছে লকডাউন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
ফলে লোকসমাগম এড়িয়ে ঘরে অবস্থানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। সংক্রামকের কারণেই কোনো রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয় এবং ৫৩১২ ও ৫৩১৩ নম্বর হাদিসে রাসূল সা: সংক্রমিত এলাকায় না যাওয়া এবং সে এলাকার লোকদেরকে সেখান থেকে না আসার জন্য বলেছেন। তাঁর এই কথা একটি সাধারণ ঘোষণা যাতে মানুষ সচেতন হয় এবং মহামারীর বিস্তৃতি রোধ করা যায়।
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা:-এর কথা সর্বকালের জন্য। মানুষ সেখান থেকে নির্দেশনা খুঁজে নেবে। করোনাভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান হলো- ঘরে অবস্থান করা। কিন্তু ডাক্তার, নার্স, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দেশনা হলো- বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সেবাদান অব্যাহত রাখুন।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- ছোঁয়াচে বা সংক্রামক যাই বলি না কেন, সেটা কার্যকর হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে। তাকদির বা অদৃষ্টের বিষয়টি আমাদের ঈমানেরই অংশ। তাই দেখা যায়, ওমর রা:-এর শাসনামলে, সিরিয়া অভিমুখে রওনা হয়ে কাছাকাছি পৌঁছার পর তিনি জানতে পারেন, সিরিয়ায় প্লেগ মহামারী দেখা দিয়েছে। সে সময়ে সিরিয়া যাওয়া-না-যাওয়া নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম মতৈক্যে উপনীত হতে পারেননি। পরে আবদুুর রহমান ইবনে আউফ রা: বর্ণিত হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে ওমর রা: মদিনায় ফিরে আসেন। সেই মহামারীতে সেনাবাহিনী প্রধান আবু ওবায়দাহ ইবনে জাররাহ রা: ও পরবর্তী সেনাপ্রধান মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:সহ ২০ হাজার মুসলিম সেনা মারা যান। পরবর্তীতে আমর ইবনুল (আস) সেনাপ্রধান নিযুক্ত হয়ে বলেন, মহামারী এক আগুন এবং আমরা হলাম তার জ¦ালানি। তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো। বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অবশিষ্ট সেনারা বেঁচে যান। হাসপাতাল, বাজার, মসজিদ, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র লোকসমাগম থেকে দূরে থাকার জন্য বারবার বলা হচ্ছে এখন। আমাদের মাঝেও কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কে ভাইরাস বহন করছে তা আমাদের অজানা। তাই নিরাপত্তার খাতিরে বেশির ভাগ মানুষ ঘরে অবস্থান করছে এবং ঘরে নামাজ আদায় করছে।
আবার অনেকে তাকদিরের ওপর নির্ভর করে বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মানতে রাজি নয়। তবে সবাই ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে চায়। ডাক্তার, নার্স, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই তাকদিরের ওপর নির্ভর করে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয়। মানুষ আল্লাহরই প্রতিনিধি। আর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করার পাশাপাশি তার নিজের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীতে নিজেকে সজ্জিত করার পর একজন মুসলিম ডাক্তার-নার্স বলবেন, আমি মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর পূর্ণ নির্ভর করে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি, আল্লাহ আমার অভিভাবক এবং তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। এমতাবস্থায় তাঁর বান্দার নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব হয়ে যায় আল্লাহর। আর দায়িত্ব পালনকালে তার মৃত্যু হলে সেটি হবে শাহাদতের, গৌরবের। জাতি এই বীরদের আজীবন স্মরণ করবে। যুদ্ধের মাঠে কেউ শহীদ হলে মুনাফিকরা বলত, সেখানে না গিয়ে আমাদের সাথে থাকলে সে মারা যেত না। আল্লাহ তাদের কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন, ‘মৃত্যুর সময় সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আল্লাহর ওপর এই দৃঢ় বিশ^াসেই স্বল্পসংখ্যক হয়েও মুসলিম বাহিনী বিশাল শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসাকিতার সাথে লড়াই করে জয়ী হয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদের এমন তাকদিরের ওপরই নির্ভর করতে বলে।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ ছাড়া আল্লাহর নামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নাম তাকদিরের ওপর বিশ^াস নয়। সেটি হবে এক ধরনের পাগলামি।
একজন মুসলিম ডাক্তার, নার্স বা সেবাদানকারী ব্যক্তি তার জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও সব ধরনের সুরক্ষাসামগ্রীতে সজ্জিত হয়েও নিজের ওপর নির্ভর করবেন না, বরং বিশ^াস করবেন, করোনাভাইরাস তাকে মৃত্যু দেবে না বরং আল্লাহ পাকের ইচ্ছাতেই তার মৃত্যু হতে পারে। ফলে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক হয়েই দায়িত্ব পালন করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সব ধরনের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করুন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ