যেভাবে হয় মানব পাচার
মানব পাচার - প্রতীকী ছবি
২০১৫ সালে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচারের হিড়িক পড়ে। নৌকাডুবিতে লাশ ভাসতে থাকে বঙ্গোপসাগরে, গণকবর ও কঙ্কাল পাওয়া যায় থাইল্যান্ডের বনে-জঙ্গলে। বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের ইস্যুটি তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। দালাল চক্রের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে। প্রশাসন যৌথ অভিযানে নেমে পাচারকারীদের গ্রেফতার করতে থাকে। পালিয়ে দেশের বাইরে বা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে যায় চক্রের সদস্যরা। কিন্তু কয়েক মাস পরই অদৃশ্য কারণে থমকে যায় অভিযান। আটকে যায় মামলার কার্যক্রম। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, বেশির ভাগই ছাড়া পেয়ে যান জামিনে। আস্তে আস্তে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে আগের মতোই মানবপাচারের মতো গর্হিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে দালালচক্র। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের অভিযোগে ঢাকার শাহবাগ, মতিঝিল, বাড্ডা এবং নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। চক্রের সদস্যদের মধ্যে আবদুর রহিম ওরফে রহিম বস, ইসমাইল সরদার ও শাহিন মাতবর নামে তিনজনকে গত মার্চ মাসের শুরুতে গ্রেফতার করেছিল সিআইডি।
চক্রটির বিরুদ্ধে পাঁচ হাজারের বেশি নিরীহ মানুষকে ব্রুনাইয়ে পাচারের অভিযোগ করা হয়। এ তিনজনসহ ৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছিল। সিআইডি এ মামলা গুরুত্বের সাথে তদন্তে নামে। এক পর্যায়ে উঠে আসে মানবপাচারের অভিযোগে পাসপোর্ট বাতিল হওয়া আরেক দালাল মেহেদি হাসান বিজনের নাম। তবে বিজনকে আর ধরতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিছুদিন যেতে না যেতেই থমকে যায় অভিযান কার্যক্রম। মানবপাচারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবৈভবের মালিক বনে যাওয়া বিজন এখন বাতিল হওয়া পাসপোর্ট ফিরে পেতে তৎপর। ফের ব্রুনাইয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে।
ব্রুনাইয়ে মানবপাচার মামলাগুলোর বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার সামসুন নাহার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, দায়ের করা মামলায় ৩ জনকে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম। যে ৩ জনকে গ্রেফতার করেছিলাম তারা সবাই ভুয়া কোম্পানি খুলে ব্রুনাইতে লোক নিতো। তাদের মতো বিজনও একজন। তিনি বলেন, ওই তিনজনকে গ্রেফতারের পর নানাভাবে বিজনের নাম আসে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু বারবার অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে এখনো তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
মানবপাচারবিরোধী অভিযান জোরালোভাবে শুরু হয়ে মাঝপথে থমকে যায় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডির এই বিশেষ সুপার বলেন, এবার থেমে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু করোনার কারণে একটু হয়েছে। আমাদের অফিসারদেরও অনেকে আক্রান্ত। তবে অভিযান অলরেডি চলছে। ব্রুনাইকেন্দ্রিক গ্রেফতারকৃতরা ছাড়া পেয়েছে, নাকি জেলেই আছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মামলায় তো জামিন হওয়ার কথা না।
সম্প্রতি লিবিয়ার মিজদা শহরে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যার পর মানবপাচার ইস্যুটি ফের সামনে আসে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভুক্তভোগীরা মামলা করার পর ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে র্যাব অভিযান চালিয়ে দালালচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করতে থাকে। লিবিয়ায় মানবপাচারের বিষয়টি নতুন নয়। মূলত লিবিয়া বা তিউনিসিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে নৌকা বা ট্রলারে করে দালালচক্র ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে পাচার করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ এ যাত্রায় ভূমধ্যসাগরে মাঝে মধ্যেই অভিবাসীদের সলিল সমাধির খবর আসে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। ২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়ার থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার জলসীমানায় ৭৫ জন অভিবাসীবাহী নৌকা তলিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক ৬০ জনের মৃত্যু ঘটে। তার মধ্যে ৩৯ জনই ছিলেন বাংলাদেশী। ভুক্তভোগীদের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তখন র্যাব বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন দালালকে গ্রেফতার করে। র্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে দেশের অভ্যন্তরে ১০-১৫টি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে অভিযান।
জানা যায়, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দেশে গত আট বছরে ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। তবে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৩৩টি। বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। এর মধ্যে ৩৩টি মামলায় মাত্র ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আদালতে সময়মতো আসামি ও সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অনেক মামলার শুনানি করা যাচ্ছে না। ফলে বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রম ঝুলে আছে।
জানা যায়, দেশে কক্সবাজার জেলাকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের ঘটনা ঘটে। এ জেলায় এ পর্যন্ত ৬৪২টি মানবপাচারের মামলা হয়েছে। কিন্তু একটিরও বিচার শেষ হয়নি। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে মানবপাচার অভিযোগে দায়ের মামলায় আট হাজার আসামি থাকলেও দুর্বল তদন্ত ও আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় তাদের বেশির ভাগে শাস্তি হয়নি। আইনে জামিন অযোগ্য হলেও উচ্চ আদালত থেকে অধিকাংশ আসামিই জামিন পেয়ে যাচ্ছে।
২০১২ সালের ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সঙ্ঘবদ্ধভাবে মানবপাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ দমন আইনে বিচারের জন্য বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করার ৮ বছর পর চলতি বছরের গত ৯ মার্চ সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আদেশ হয়। একই সাথে বিচারকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মামলায় গতি আনতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলেও এখনো ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়নি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, মানবপাচার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ অপরাধের বিচার না হলে অপরাধীরা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মূল পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
মানবপাচার ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে রিপোর্টি করছেন শরীফুল হাসান। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান। নয়া দিগন্তকে তিনি বলেন, যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে তখন সর্বোচ্চ মাসখানেক অভিযান বা তৎপরতা চলে, এরপর থেমে যায়। আমার মনে হয় যদি মানবপাচার বন্ধ করতে হয় তাহলে সারা বছরই মানবপাচারকারী কারা, কাদের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হয়, বিদেশে বন্দী করার পর কারা কোথায় কিভাবে টাকা নেয় বা দেয়। এই ফলোআপগুলো করা জরুরি। তিনি বলেন, গত ৭-৮ বছরে লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মানবপাচারের শিকার হয়ে ফেরত এসেছিল ঢাকা এয়ারপোর্টে যদি এক পৃষ্ঠার একটা ফরমে স্থানীয় দালাল কে ছিল, কার মাধ্যমে তিনি গিয়েছিলেন এ রকম ১০০-২০০ জনের কাছ থেকে তথ্য নিলেই মূল চক্রটা চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। ফেরত আসাদের কাছ থেকে দালালদের নাম ঠিকানা নিয়ে ডিজিটাল ডাটাব্যাজ তৈরি করলে নিয়মিত অভিযান চালালে এই চক্র দমন করা সম্ভব বলে মনে করেন শরীফুল হাসান।