বিদ্যুৎ বিলের মরণ কামড়

বিদ্যুৎ বিলের মরণ কামড় - সংগৃহীত
অনিয়মটা আমাদের নিয়তির লিখন যেন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মপূজা সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে আইনের ভঙ্গুর প্রয়োগ; অপপ্রয়োগের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা আমাদের জাতিসত্তাকেই বিষিয়ে তুলেছে রীতিমতো।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে- উন্নয়ন প্রকল্পে কেনাকাটার নামে রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাটের ‘মচ্ছব’ চলছে। প্রকল্পের জন্য কেনা পণ্যের দামের সাথে বাজার মূল্যের ন্যূনতম সামঞ্জস্যও রাখা হচ্ছে না। আর এভাবেই আকাশচুম্বী মূল্য দেখিয়ে লুটপাট করা হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের বিপুল অর্থ। যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাবে প্রতিটি লিফটের দাম প্রায় দুই কোটি টাকা, এসির দাম ৫২ লাখ টাকা, সিকিউরিটি ও গেটলাইট প্রতিটি সাড়ে ১২ লাখ টাকা এবং সভাকক্ষের টেবিলের ১২ লাখ টাকা দাম ধরা হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ ধরনের অবাস্তব দামের প্রস্তাব সত্ত্বেও তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এর আগে হাসপাতাল ও রূপপুর প্রকল্পে এমন ‘ভৌতিক’ মূল্যে পণ্য কেনার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
দুর্নীতির দরুন দুর্ভাগ্য আমাদের কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। বিদ্যুৎ বিল নিয়েও ‘তুঘলকি’ কাণ্ডের খবর মিলেছে সম্প্রতি। এমনিতেই বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই; হাহাকার সর্বত্রই। তার ওপর বিদ্যুতের মনগড়া বিল সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিয়ে ভোক্তাদের অসন্তুষ্টি ও উদ্বেগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ফারহানা মিলি নামে এক ভুক্তভোগী ফেসবুক স্ট্যাটাসে খেদোক্তি করেই লিখেছেন, ‘ঢাকা শহরে একুশ বছর ধরে বাসা ভাড়া করে থাকছিÑ এত টাকার ইলেকট্রিসিটি বিল চোখে দেখার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। গত দু’মাসের জন্য ১১ হাজার ১২০ টাকা গড়ে প্রতি মাসে পৌনে ছয় হাজার টাকা। কিভাবে সম্ভব!’
তার ভাষায়, ‘প্রতি গরমে আমার এ বাসায় মাসপ্রতি বিল সর্বোচ্চ একবার হয়েছিল এক হাজার ৯০০ টাকা, তাও ছিল অস্বাভাবিক। সাধারণত এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে এসেছি। শীতের দিনে হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। জানি না, এবার কী হয়েছে। হয়তো বিদ্যুৎ বিভাগ বলবে, আমরা বিদ্যুৎ খেয়েছি বসে বসে!’
সমস্যাটা যে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক এমন নয়, বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ এসেছে আমার গ্রামের বাড়ি থেকেও। ভাতিজা সুমন এমন খবর জানিয়েছে। মহানগর চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল থেকেও ঢাকার মতোই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের সমস্যার কথা জানিয়েছেন অনেক গ্রাহক। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরেও এই সমস্যা অহেতুক সৃষ্টি হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ (আরইবি) এলাকায় ‘লাইফ লাইন’ গ্রাহক (যাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার সর্বনিম্ন) ছাড়া সবাই কমবেশি অতিরিক্ত বিলের কবলে পড়েছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না, বরং ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করছেন তারা। তাদের দাবি, সাধারণত করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত অঘোষিত লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে গত দুই মাস কোনো মিটার রিডার কারো বাসায় গিয়ে মিটার পর্যবেক্ষণ করেননি। এ কারণে মার্চ মাসে কাউকে কোনো বিলও পাঠানো হয়নি। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অনেকেই দাবি করছেন, গত দুই মাসের বিল একসাথে দেয়া হয়েছে। তথা আগের মাসগুলোর সাথে একেবারেই সঙ্গতিহীন।
সম্প্রতি মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিদ্যুৎ বিল হাতে পেয়ে চমকে উঠেছেন ঢাকাসহ সারা দেশের অসংখ্য গ্রাহক। কারণ, কারো কারো ক্ষেত্রে এই বিল আগের মাসের তুলনায় চার-পাঁচগুণ বেশি। গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, কোথাও গিয়ে তারা এই অস্বাভাবিক বিলের কোনো যৌক্তিক কারণ জানতে পারেননি বা তার প্রতিকার পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট বিতরণকারী সংস্থার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করে কোনো সদুত্তরও মিলছে না। ফলে এসব ভৌতিক বিদ্যুৎ বিল নিয়ে সাধারণ গ্রাহকরা নিদারুণ ভোগান্তিতেই পড়েছেন।
বিদ্যুৎ বিল নিয়ে নৈরাজ্য যে এই প্রথম এমন নয়; বরং এই অনিয়ম বিতরণ কোম্পানিগুলোর দীর্ঘ দিনের। গত বছরও একই সময়ে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডেসকো) আওতাধীন মহাখালীর একজন আবাসিক গ্রাহকের গত বছরের ১৫ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত এক মাসের বিল এসেছিল পাঁচ হাজার ৪৬ টাকা। বিল অনুযায়ী, তিনি ৬০৩ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন। অথচ এপ্রিল-মে মাসে তার বিল এসেছিল এক হাজার ৬৫০ টাকা। বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন ৩৯৫ ইউনিট। মার্চ-এপ্রিল মাসে তিনি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছেন ৩৯৮ ইউনিট। বিল এসেছিল এক হাজার ৭০০ টাকার মতো। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের বিলে দেখা যায়, তিনি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছিলেন মাত্র ১৯৫ ইউনিট। বিল এসেছিল ৬০০ টাকার কিছু বেশি। এই গ্রাহকের বাসায় ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ধরে হিসাব-নিকাশ করে ডেসকোর একজন প্রকৌশলী জানান, এক মাসে ৬০৩ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং পাঁচ হাজার টাকার বেশি বিল হওয়া তার ক্ষেত্রে একেবারেই অস্বাভাবিক; অগ্রহণযোগ্য।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন, পুরানা পল্টন লেনের একটি বাড়ির একজন গ্রাহকের অভিযোগ, গত বছরের ১৬ মে থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত এক মাসের বিদ্যুৎ বিল পেয়ে তার আক্কেলগুড়ুম। ৮৭৮ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে। এর সাত হাজার ৬৬৫ টাকা বিল; কিন্তু মার্চ-এপ্রিল মাসে তার বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ২১২ ইউনিট। বিল হয়েছিল ৮৬৭ টাকা। হঠাৎ করে বিদ্যুতের ব্যবহার এতটা বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
সম্প্রতি এই অভিযোগ নতুন করে শুরু হয়েছে। প্রাণঘাতী করোনা সঙ্কটের মধ্যেই বিদ্যুৎ বিলে ‘লঙ্কা কাণ্ড’ আঁতকে ওঠার মতো। অভিযোগের জবাবে দায়িত্বশীলরা যা বলছেন তা সম্পূর্ণ দায়সারা গোছের। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডেসকোর ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের আওতাভুক্ত এলাকার মধ্যে ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জও রয়েছে। সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর আমাদের মিটার রিডাররা আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখতে পারেননি। এ কারণে গড় ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে বিল করা হয়েছে।’ পল্লীবিদ্যুতায়ন বোর্ডের বক্তব্য হচ্ছে, ‘ছুটির কারণে মানুষ বেশির ভাগ সময় ঘরে থাকছে। গরমের সময় ফ্যান বা এসিও বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় বাসায় বিদ্যুৎ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের বিল ‘একটু বেশি’ আসবে।’ আবার বলা হচ্ছে, যারা অস্বাভাবিক বিল পেয়েছেন, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো দরকার নেই। নিকটস্থ দফতরে যোগাযোগ করলে এসব বিল ঠিক করে দেয়া হবে। জুন মাসে মিটারের রিডিং দেখে বিল করা হলে সেখানেও সমন্বয়ে করা হবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন যা সংশ্লিষ্টদের স্ববিরোধিতা বলতে হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল আসার তিনটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছে। প্রথমত, মিটার রিডিংয়ে কারচুপি। মিটার রিডাররা প্রতি মাসে সব গ্রাহকের মিটারের রিডিং সরেজমিন না নিয়ে অনুমাননির্ভর বিল করেছেন। ফলে কোনো কোনো মাসে প্রকৃত ব্যবহারের তুলনায় বিল কিছু কম হতে পারে। এতে কয়েক মাসের ব্যবহার থেকে কিছু কিছু জমা হয়ে মে-জুন এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বাড়তি বিল আসতে পারে। বছরের এই দু’টি সময়ে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করা হয়। গ্রাহকরা বলছেন, যদি তা-ই হয়, তাহলে মিটার রিডারের অনিয়মের দায় তাদের ওপর চাপানো হবে কেন? বিদ্যুৎ কোম্পানির গ্রাহক হয়ে সেবা পাওয়ার বদলে তারা এই ভোগান্তিতে পড়বেন কেন? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যদি এভাবে ইউনিট জমিয়ে রেখে জুন ও ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ ব্যবহারের হিসাব ‘সমন্বয়’ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহারকারীর গ্রাহকশ্রেণী পরিবর্তন হয়ে আবাসিক গ্রাহক বাণিজ্যিক গ্রাহকে রূপান্তরিত হয়ে যাবেন। এতে একজন গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন যা বিতরণ কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি ও দায়িত্বহীনতা বলতে হবে।
বিইআরসি গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর আবাসিক গ্রাহককে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রতি ইউনিটের জন্য তিন টাকা পাঁচ পয়সা দাম দিতে হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের মধ্যে থাকলে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে চার টাকা ২৯ পয়সা। কিন্তু ব্যবহার ৪০০ ইউনিটের বেশি হয়ে গেলে প্রতি ইউনিটের দাম সাত টাকা ৮৯ পয়সা। মিটার রিডারদের গাফিলতিতে গ্রাহকশ্রেণী পরিবর্তনের যে দণ্ড দিচ্ছেন তা কখনো কাম্য বা যৌক্তিক নয়, বরং গ্রাহকদের প্রতি জুলুমই বলা যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের সেবার মান ও ভৌতিক বিল বিষয়ক অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধান নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও সমস্যা যে তিমিরে ছিল আজো সে তিমিরেই রয়ে গেছে। আর অনুমাননির্ভর বিলের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের হলেও সরকার বা কর্তৃপক্ষ এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনি। এতে সাধারণ গ্রহকরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের খামখেয়ালি ও উদাসীনতার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
রাষ্ট্র একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। তাই সাধারণ মানুষের সেবার মান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কোনোভাবেই উদাসীন থাকতে পারে না। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল নিয়ে যা ঘটছে তার দায় রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। কারণ, রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের অধিকার হরণ নয়, বরং গণমানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান। তাই রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
smmjoy@gmail.com