নেপালে কী করেছে ভারত
নেপালে কী করেছে ভারত - সংগৃহীত
আরেক দেশের নতুন কনস্টিটিউশন গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি দিয়ে নিজেকে হাস্যকর করার কোনো মানে হয় বলে আমরা কেউ মনে করি না। কিন্তু নেপালে সব হারিয়ে ভারত তাই করেছিল। যদিও সবকিছু উপেক্ষা করে নেপালে নতুন কনস্টিটিউশন গৃহীত ও ডিক্লারেশন বা ঘোষণা হয়েছিল ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে। কিন্তু এর পরের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এক ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার ক্ষমতায় আসে সেটা ছিল নেপালের বড় দুই কমিউনিস্ট পার্টি মিলে এক দলের সরকার। আর একমাত্র নেপালি কংগ্রেস কোনো মতে বিরোধী দলে জায়গা হয় আর সেই সাথে এর ভারতের সাথে সম্পর্ক রক্ষার সুযোগ সামনে আসে। এবার, নেপালের পার্লামেন্টে লিপুলেখ নিয়ে প্রতিবাদ আলোচনায় সেই নেপালি কংগ্রেসের এক এমপি পুষ্পা ভূষল গৌতম বলেন, ‘১৮১৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাগাউলি চুক্তি অনুসারে ওই এলাকা সম্পূর্ণভাবে নেপালের।’ অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে নেপাল কংগ্রেস দলও এখন কম ভারতবিমুখ নয়। এ থেকে নেপালের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্তত কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।
নেপালের মাওবাদীরা তাদের সশস্ত্র বিপ্লব নিয়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৯৬ সালে। সেখানে নেপালে তাদের রাজার মূল সহযোগী বলে ভারতকে উল্লেখ করা হয়েছিল। ফলে ওই বিপ্লবের মূল শত্রু বলে তারা চিহ্নিত করেছিল ভারতের শাসকদের। বিশেষ করে ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তি বাতিলের প্রধান দাবি তারা সেই থেকে শুরু করেছিল। মাঝে ২০০৭ সালের দিকে নিজেরা কৌশল বদলে সশস্ত্র থেকে গণআন্দোলনে নেমে আসারকালে চুক্তি বাতিলের কথা কিছুটা ঢিলেঢালা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে চুক্তি রিভিউয়ের পক্ষে আনুষ্ঠানিক দাবি তোলার একপর্যায়ে ২০১৬ সালে এটা কাজ শুরু করলেও নেপালের মূল ফোকাস সরে যায় ভারতের বিকল্প হিসেবে চীনের ভেতর দিয়ে বাইরের দুনিয়াতে বের হওয়ার ব্যবস্থা ও কোনো নতুন চুক্তির পথ খুঁজে বের করা। তা এখন চীনের মাধ্যমে কার্যকর হয়ে গেছে। এরও প্রভাব এখন নগদ দেখা যাচ্ছে। সারা নেপালের চরম ভারতবিমুখ হয়ে পড়া চলছে ধরা যায় গত সাত বছর ধরে। কিন্তু এই লিপুলেখ সীমান্তের রাস্তা নির্মাণ কেন্দ্রে করে এবারের ভারতবিমুখতা বা বিরোধিতা অনেক বাস্তব হয়ে উঠেছে। চীন-নেপালের সাতটা সীমান্ত দিয়ে বাইরের সাথে যোগাযোগ, সম্পর্ক করার কথা নেপাল প্র্যাকটিক্যালি ভাবতে পারে এখন। এক কথায় মূল কারণ এটাই যে, ভারত ছাড়াও নেপালের অর্থনৈতিক জীবন এখন সার্ভাইভ করা বাস্তবে সম্ভব। এটাই হলো এবারের ভারতবিমুখতার বিশেষ দিক।
এছাড়া এরই ছাপ দেখা যাচ্ছে এখন। যেমন গত ৮ জুন কাঠমান্ডু পোস্ট পত্রিকায় একটা কলাম ছাপা হয়েছে যার শিরোনাম- ‘বিশেষ সম্পর্কের’ সমাপ্তি কি এখানেই ঘটবে? বিশেষ সম্পর্ক বলতে ভারত-নেপাল বিশেষ সম্পর্কের কথা বুঝানো হয়েছে। এই লেখায় কলকাতার হিন্দুস্থান টাইমসের এক সম্পাদকীয় আর এক প্রকাশিত রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমসের এই সম্পাদকীয় একেবারেই সাব স্ট্যান্ডার্ড, ওর নিজের জন্যই লজ্জার। এত খারাপ তারা সাধারণত লিখে না। কিন্তু এখানে তারা নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, কাউকে ‘কাজের ছেলে’ গণ্য করে কোনো লেখা লিখলে যেমন হয় তারই ছাপ রেখে লেখা। যে সম্পাদকীয় আবার সাব-হেডলাইন হলো, ‘কাঠমান্ডু (ভারতের সাথে) সম্পর্ক রিসেট করে ঢেলে সাজাতে চায়, এতে তারই স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ পত্রিকাটা অভিযোগ করেছে, নেপালে নাকি ‘গভীর এন্টি-ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’ ছড়িয়ে পড়েছে।
আরো লিখছে, নেপাল-ভারতের মধ্যে এক ‘বিশেষ সম্পর্ক’ আছে, অসন্তোষের গোড়াটা সেখানে। লিখেছে, ‘বাস্তবে এর মানে ভারত-নেপালের সাথে খোলা সীমান্ত শেয়ার করে। ভারত নেপালিদের বিনা বাধায় ভারতে কাজ করতে এলাউ করে আর নেপালিরা ভারতের সেনাবাহিনীকে সেবা (কাজ) করে। এর বিপরীতে, নেপালিরা এ দুটোতেই রাজি আছে, পরোক্ষে ওরা নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতকে একটা ভূমিকা দিয়েছে আর নেপালিরা ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থের ব্যাপারে সেন্সেটিভ হয়ে থাকছে।’ ... ভারতও বিশেষ সম্পর্ক থেকে লাভবান হয়েছে। তবে এই বিশেষ সম্পর্ক রিসেট করলে নেপালকে এর মূল্য দিতে হবে।
নেপালকে এর দায় বইতে হবে। এর মানে হবে কড়া সীমান্ত, এর মানে হবে নেপালিদের ভারতে অবাধে কাজ করা বন্ধ, এর মানে হবে নেপালের উন্নয়নের জন্য (ভারত থেকে) দ্বিপক্ষীয় জরুরি সহযোগিতার দ্রব্যাদি কমে যাওয়া, এর মানে হতে পারে, ত্বরাই মানে নেপালের দক্ষিণাঞ্চল থেকে যে রাজনৈতিক প্রতিরোধের ঝড় উঠবে (মানে ভারত উসকিয়ে তুলবে) তা সামলানো। কাঠমান্ডু কি এসবের জন্য তার একক সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও মূল্য চুকানোর জন্য তৈরি? এটা তো একটা পরিষ্কার প্রো-চায়না ঝোঁক ও এক আগ্রাসী ন্যাশনালিজম? এভাবে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ সব নিঃশেষ করে দেয়া দুই দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তবে নেপালের বেশি ক্ষতি হবে।
এখন এক কথায় বললে, হিন্দুস্থান টাইমসের এই ভাষ্য অগ্রহণযোগ্য। এই লেখা সম্পর্কে মন্তব্য হলো, কাউকে কাজের ছেলের মতো আচরণ করে বলা ‘আমার পা-দাবানো ছেড়ে চলে গেলে তুই তো না খেয়ে মরবি’- সেরকমের। আসলে ভয় দেখিয়ে কাউকে জোয়ালে নিয়োজিত রাখার অনেক উপায় আমরা জানি, দেখেছিও। তবে এখানে দেখছি; এখানে বলা যে ‘আমারও একটু কষ্ট হবে তোর হাতে আমার পা-দাবানো পাব না, তবে তোরই না খেয়ে থাকতে বেশি কষ্ট হবে।’ এটা এ ধরনের।
বলাই বাহুল্য, এটা কোনো পত্রিকার সম্পাদকীয় হতে পারে না। বাহ্যত উভয়ের সম্পর্ক যাই থাক, নেপাল-ভারত সম্পর্ক দুটো সমমর্যাদার রাষ্ট্রের, যেখানে কেউ কারো অধস্তন এমন মনে করাটাই অগ্রহণযোগ্য তো বটেই, বরং এভাবে বলা বা এমন ধারণা নিয়ে কথা বলাটাও অপরাধ। দুটো সমমর্যাদার রাষ্ট্রের এই সম্পর্ক-নীতির কথা মনে রেখে এই সম্পাদকীয় লেখা হয়নি।
জাতিসঙ্ঘ যেখানে ল্যান্ড-লকড রাষ্ট্রের পড়শি দেশের ওপর দিয়ে সমুদ্র ব্যবহারের একসেস পাওয়াকে অধিকার গণ্য করে রেজুলেশন তৈরির প্রক্রিয়ায় আছে, এরা তখন বেখবর হয়ে এন্টি-ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম করার মূল্য চুকাতে হবে বলে ভয় দেখাচ্ছে।