দুই ভাইরাস : কোভিড-১৯ ও খবিস-২০
দুই ভাইরাস : কোভিড-১৯ ও খবিস-২০ - সংগৃহীত
সন্ধ্যায় জানাজায় যাবো। ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’ গিন্নির দরাজ গলা। ওটা গলা তো নয়, যেন উর্দু রোডের ‘রহমত মাইক’। যে মানুষটি দরাজ দিল, ঘরে বসে আছে এঁটে খিল। স্কুল বন্ধ। বেতন নেই। চিন্তাই বটে! আর কতদিন এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়? কোচিংও নেই। ‘উপরি’ আয়ও নেই। ব্যাংকে গাদা গাদা টাকাও নেই; শুধু বেতনটুকুই সম্বল।
দুপুরে মারা গেলেন সেন্টু ভাই- কী নাই? বাড়ি, দোকান, হোটেল। অথচ আজ তিনি নেই; স্ট্রোক তাকে কেড়ে নিলো। দীর্ঘদিন সব কিছু বন্ধ। চিন্তা একটাই; কিভাবে সংসার চলবে, রুটি-রুজি আসবে। মধ্যবিত্ত অসহায় মানুষদের যত জ্বালা। বুকফাটে তো মুখ ফোটে না। পাঁচজনের সংসার। লেগেই আছে অভাব। প্রতিদিন যাদের মুখ দেখে ঘুম ভাঙে, তারাও এখন ওই মুখ দেখতে চায় না। কারণ কেবল মুখ দেখলে তো পেট ভরবে না।
এখন বাংলাদেশে নাকি দুই প্রকার ভাইরাস বিদ্যমান। কোভিড-১৯ (করোনা), অন্যটি খবিস-২০; মানে, চাল চোর, তেল চোর আর কী। এই দুর্দিনেও খবিস-২০ দের ফোর-টোয়েন্টিগিরি গেল না। খবরের কাগজে শুধু মৃত্যুর মিছিল। দিন দিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যাও। তবু লকডাউন মানছে না হতচ্ছাড়া মানুষ। একটুও ভয় নেই? ভাইরাসও এসে যেন বিপদে পড়ে গেছে। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। তবে চালাক বটে ভাইরাসটি; ক্ষণে ক্ষণে গতি প্রকৃতিও বদলায়।
কয়েক দিন আগে মারা গেলেন পাড়ার তাজু ভাই। করোনা তাকে বাঁচতে দিলো না। যেতে পারলাম না; দেখতে পারলাম না। কারণ দাফন, জানাজা, কোনো কিছুই স্বজনদের স্পর্শ করেনি। সবই করোনাযোদ্ধা আর আর্মির তত্ত্বাবধানে হলো। আশপাশের বাড়িসহ লকডাউন পুরো এলাকা। তিনি নাকি প্রবাসফেরত সম্বন্ধীর সংস্পর্শে ছিলেন অনেক দিন। ব্যাটা সম্বন্ধী লাপাত্তা।
এদিকে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন বাবু ভাই; বই ব্যবসায়ী। খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ রাত ১টায় বুক ব্যথা।
ব্লাড প্রেসার হাই। খেলেন টকদই। অবস্থা বেগতিক। পবিত্র জমজম পানি খেয়ে ডান কাতের মুখ আর বামে নিতে পারলেন না। ডায়াবেটিস শূন্য হয়ে গিয়েছিল। অপর দিকে পাথর মন। যে পাথরে গাছ হয় না, ফুল ফোটে না। এক এক করে সব প্রিয়জন চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না তাদের জন্য।
কয়েক দিনের ব্যবধানে মারা গেলেন আরেক প্রতিবেশী ভাই শাহজাহান বাবুল, তারা মিয়া। রাতে তারা ভাইকে দেখা যাবে না তারা গুনতে। আকাশের তারা হয়ে জ্বল জ্বল করবেন আমাদের মাঝে। এমন সময়কালে মৃত্যু মানে করোনার আতঙ্ক। পরিবেশটা এমন হয়েছে যে- কেউ কারো নয়। ইচ্ছে করলেই যেতে পারছি না।
কারো জন্য কিছু করতে পারছি না এক বুক কষ্ট আর আফসোস ছাড়া। চলে গেলেন না ফেরার দেশে আরিফের বাবা, তারিনের শ্বশুর, জেনিয়া মুনিয়ার মা, হাজী নাসির ও মনো খালা।
আর ভালো লাগে না। মারা গেলেই করোনা; দোহাই কাউকে ধরো না! কুকুটিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেনÑ আজিমপুরে! যেতে পারলাম কই, জানলামই তো পরে, তবে আগে জানলেও কি যেতে পারতাম?
‘গিন্নিকে বুঝালাম, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করো, সব মুশকিল আসান হবে। আল্লাহ ভরসা।’ পরক্ষণই গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এলো- পাশের গ্রামে এক করোনা রোগী মারা গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বিপত্তি বাধল জানাজার নামাজ নিয়ে। ফুপা জানাজা পড়িয়েছিলেন। কারণ কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাড়িতে ফিরে সে কী ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হলো ফুপাকে।
তাকে ঘরে ঢুকতেই দেয়া হলো না। মেম্বার-চেয়ারম্যান এসে হাজির। লকডাউন পুরো বাড়ি। আলাদা ঘরে রাখা হলো ১৫ দিন। মানুষটি বউ ছাড়া থাকতে পারেন না এক মুহূর্ত। পাশের বাড়ির বেরি মেরি আর ময়না গয়নাদের মধ্যে লেগে যায় ঝগড়া, হাতাহাতি। এ-বাড়ি ও-বাড়ি আসা নিয়ে। ওরা ফুপুদের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিল। করোনা যেন জালে জেঁকে বসেছে।
চিরচেনা দক্ষিণ মৈশুণ্ডি ভূতের গলি আজ সত্যিই ভুতুড়ে। বড় অচেনা সময়ে চলে গেলেন সুফিয়া বেগম (৯২), সেরু চেয়ারম্যানের বোন ও সাইদুর রহমান। নুরুদ্দিন চাচাদের বাড়িটা এ পাড়াতেই। ইয়াসমিন, সুইটিদের বাড়ির ধারে বরফকলটি বন্ধ। নেই সদরঘাটগামী মানুষের আনাগোনা। কলতাবাজার, কোর্ট কাছারি নিস্তব্ধ। নেই ধোলাইখালের টুংটাং শব্দ। মাজার বাড়িতে আমার জন্ম। এখানে বড় হয়েছি, বেড়ে উঠেছি, আজ কেউ নেই- মা বাপ। ক্যান্সার যার নেই অ্যান্সার। তবু কাছে পেয়েছে, দেখেছি। কিন্তু করোনা! পেলে কাউকে ছাড়ে না।
নিরাশার মাঝে আশার আলো- দেশ প্রথম রেমডিসিভির বানাল। বাণিজ্যিক নাম ‘রেমিভির’; সত্যিই হয়তো ‘বীর’। বিশ্বে কমছে সঙ্কটাপন্ন রোগীর সংখ্যা, গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে ব্লাডথিনার নাকি আশানুরূপ ফল দিচ্ছে। আশায় বুক বাঁধি- একদিন আলো-আঁধারি শেষে/পৃথিবী আবার উঠবে হেসে।