একটি নদী এবং ভারত-নেপাল বিরোধ
কুঠি নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত নেপালের এলাকা, দাবি করছে কাঠমান্ডু - ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা
ভারত ও নেপালের মধ্যকার সীমানা যদি মহাকালীই হয়, তা হলে আর ধন্দ কোথায়? এলাকাটা যারা হাতের তালুর মতো চেনেন, তারা বলছেন, ধন্দ ওই মহাকালীকে নিয়েই। ধর্মীয় বিশ্বাস এক রকম। রাজনৈতিক বক্তব্য আর এক রকম। অতএব কোনটা আসল মহাকালী, তার আসল উৎস কোনটা? ভারত-নেপাল দ্বন্দ্ব এখন আবর্তিত হচ্ছে সেই প্রশ্নকে ঘিরেই।
দুই অঙ্গাঙ্গী প্রতিবেশী। সীমান্তে কোনো কাঁটাতার নেই। সীমানা চিহ্নিত করে রেখেছে প্রকৃতি— কোথাও পর্বতশ্রেণি, কোথাও উপত্যকার কিনারা, কোথাও আবার নদী। কিছু অঞ্চল নিয়ে ধোঁয়াশা বা তর্ক থাকলেও মোটের উপর শান্তিপূর্ণই ছিল সে সব সীমান্ত। কিন্তু নেপালে রাজতন্ত্রের পতন এবং নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে ক্রমশ তপ্ত হয়েছে পরিস্থিতি। লিপুলেখ, কালাপানি এবং লিম্পিয়াধুরাকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করতে শুরু করেছে নেপাল। সেই সঙ্ঘাত এখন তুঙ্গে পৌঁছনোর পথে। কারণ নিজেদের যে নতুন মানচিত্র বানিয়েছে কাঠমান্ডু, তা চ্যালেঞ্জ করছে নয়াদিল্লির সার্বভৌমত্বকে। উত্তরাখণ্ডের ধরচুলা থেকে লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত যে রাস্তা বানিয়েছে দিল্লি, সেই রাস্তা বানানোর অধিকারই ভারতের নেই বলে কাঠমান্ডু দাবি করতে শুরু করেছে। এলাকা ভারতেরই নিয়ন্ত্রণে এখনও। কিন্তু নতুন মানচিত্র তৈরি করে নেপাল জানিয়েছে, লিপুলেখ থেকে লিম্পিয়াধুরা পর্যন্ত এলাকার উপর থেকে দাবি তারা কিছুতেই ছাড়বে না।
সীমান্ত নিয়ে এই বিতর্ক থাকার তো কথা ছিল না! ২০০ বছরেরও বেশি আগে তো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিহ্নিত করে দিয়েছিল যে, নেপালের সীমা কোথায় শেষ হচ্ছে। পূর্বে মেচি নদী, পশ্চিমে মহাকালী নদী, দক্ষিণে তরাই অঞ্চলের কিনারা, উত্তরে তিব্বত— এর মধ্যবর্তী অংশ হল নেপাল। ১৮১৬ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া সুগৌলীর সন্ধিতে তেমনই লেখা হয়েছিল। তার পর থেকে নেপালে নাক গলাননি ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালেও ওই আয়তাকার ভৌগোলিক সীমাকে মাথায় রেখেই স্থির হয়েছিল ভারত-নেপাল সীমান্ত। তা সত্ত্বেও কেন এত বিতর্ক আজ?
সীমান্ত যদি স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত থেকেই থাকে, তা হলে বিতর্ক তৈরি করার সুযোগ আসে কী ভাবে? সুগৌলীর সন্ধিতে যদি স্পষ্ট লেখা থাকে যে, নেপালের পশ্চিমতম প্রান্ত হল মহাকালী নদী, তা হলে আর ধন্দ তৈরি করার অবকাশ তৈরি হচ্ছে কী ভাবে? আসলে মহাকালী নদীর উৎসকে ঘিরেই তর্কটা চলছে।
মহাকালী নদী হিন্দুদের কাছে অন্যতম পবিত্র নদী। সেটা ভারত-নেপাল নির্বিশেষে। যতক্ষণ সে নদী ভারত-নেপাল সীমা বরাবর প্রবাহিত, ততক্ষণ নাম কালী বা মহাকালী। পুরোপুরি উত্তরাখণ্ডে ঢুকে পড়ার পরে তার নাম শারদা, অর্থাৎ সরস্বতীর আর এক নাম। উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলার কালাপানি (যে এলাকাকে নেপাল নিজেদের অংশ বলে দাবি করছে) থেকে উৎপত্তি এই নদীর— ধর্মবিশ্বাস এই রকমই। কালাপানি গ্রামের কাছে পাহাড় থেকে নেমে আসা কয়েকটা প্রস্রবণ মিলে মহাকালী নদী তৈরি করেছে বলে স্থানীয়দের পরম্পরাগত বিশ্বাস। ওই প্রস্রবণগুলিকে স্থানীয় হিন্দুরা পবিত্র হিসেবে মানেন। কিন্তু ভিন্নমতও রয়েছে।
লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত ভারত যে রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে, সামরিক দিক থেকেও সে রাস্তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যে প্রস্রবণগুলিকে মহাকালী নদীর উৎস হিসেবে মানা হয় স্থানীয় পরম্পরা অনুয়ায়ী, সেই প্রস্রবণগুলির পানি যে মহাকালীর খাতে প্রবাহিত হচ্ছে না, এমন নয়। কিন্তু মহাকালীর খাতে আরো দু’টি ধারা এসে মিশছে। একটা ধারার নাম কালাপানি নদী, যার উৎপত্তি লিপুলেখ গিরিপথের কাছ থেকে, যে গিরিপথের একপাশের এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে, অন্য পাশ চীনের নিয়ন্ত্রণে এবং খুব কাছেই এসে মিশেছে নেপালের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তও। আর একটা ধারার নাম কুঠি নদী, যার উৎস উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুঁ অঞ্চলে, লিম্পিয়াধুরা গিরিপথের ঠিক নিচে। দু’পাশ থেকে আসা এই কুঠি নদী এবং কালাপানি নদীই হলো মহাকালী নদীর আসল উৎস, মাঝে কালাপানি গ্রামের কাছ থেকে নেমে আসা যে প্রস্রবণগুলিকে পবিত্র মনে করেন স্থানীয়েরা, মহাকালীর আসল উৎস সেগুলো নয়— নেপালের রাজনৈতিক অবস্থান অনেক দিন ধরেই এই রকম। অতএব কুঠি নদীর পূর্ব তীর পর্যন্তই হল নেপালের সীমানা এবং লিপুলেখ, কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা আসলে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পিথোরাগড় জেলার অংশ নয়, নেপালের মহাকালী জেলার অংশ— কাঠমান্ডু তাই মনে করে। সম্প্রতি সেই দাবির প্রতিষ্ঠা আদায়ের চেষ্টা কোমর বেঁধে শুরু করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি।
নেপালের সীমা কিন্তু এক সময় আরো অনেকটা ছড়িয়েছিল। ভারতের অনেকটাই তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে। কিন্তু নেপালের গোর্খা রাজত্ব স্বাধীন। এখন উত্তরপ্রদেশের যে অংশ নেপাল লাগোয়া, সেই তরাই অঞ্চল তখন ছিল অবধ রাজত্বের অধীনস্থ। আর অবধ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রোটেক্টরেট। নেপালের শাহ ধীরে ধীরে অবধে হানা দিচ্ছিলেন। দখল করে নিয়েছিলেন তরাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। পূর্বে মেচি পেরিয়ে তিস্তা পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন নেপালরাজ, আর পশ্চিমে কুমায়ুঁ এবং গঢ়বাল পেরিয়ে শতদ্রু নদের তীর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু নয়, ভারতীয় রাজারাও বিপন্ন বোধ করছিলেন গোর্খা সাম্রাজ্যের দাপট দেখে। ফলে নেপালরাজের বিরুদ্ধে ১৮১৪ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গঢ়বাল, পটিয়ালা এবং সিকিমের রাজারাও কোম্পানির হয়ে যোগ দেন সে যুদ্ধে। বছর দুয়েক চলেছিল সে যুদ্ধ। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হওয়া গোর্খা সাম্রাজ্য সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে। ১৮১৬ সালে বিহারের সুগৌলীতে হওয়া সেই সন্ধিপত্রে নেপালের সীমানা নতুন করে নির্ধারিত হয়েছিল। পশ্চিমে শতদ্রু থেকে পূর্বে তিস্তা পর্যন্ত নয়, পশ্চিমে মহাকালী থেকে পূর্বে মেচি পর্যন্ত এলাকা থাকবে নেপালরাজের নিয়ন্ত্রণে— এমনই স্থির হয়েছিল। অতএব প্রায় ২০৪ বছর আগে থেকেই এই সীমার মধ্যে আবদ্ধ নেপাল। কিন্তু মহাকালীর আসল উৎস কোনটা, তা নিয়ে বিতর্ক বহাল।
লিপুলেখ গিরিপথের কিনারা থেকে লিম্পিয়াধুরা পর্যন্ত যে এলাকাকে সম্প্রতি নিজেদের মানচিত্রের মধ্যে দেখাতে শুরু করল নেপাল, সেই এলাকা কিন্তু স্বাধীনতার সময় থেকেই ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারতের প্রাক্তন বিদেশ সচিব তথা এককালে নেপালে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্যাম সারণ জানাচ্ছেন, ১৯৫০-এর দশকে চীন যখন তিব্বত দখল করল, তখন নেপাল-চীন সীমান্তে ভারত বেশ কিছু সামরিক তথা পুলিশ চৌকি বসিয়েছিল। নেপালের অনুমতি নিয়েই সেটা করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ভারতকে ওই চৌকিগুলি নেপাল সরিয়ে নিতে বলে। নেপালের এলাকায় ভারত যে ১৭-১৮টি চৌকি বানিয়েছে, সেই সবক’টি সরিয়ে নিতে হবে— ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে তেমনই জানান নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কীর্তি নিধি বিশ্ত। ভারত সরিয়েও নেয় চৌকিগুলি। কিন্তু ওই ১৭-১৮টি চৌকির মধ্যে কালাপানির নাম ছিল না। অর্থাৎ তখনও নেপাল কালাপানিকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করছিল না। পরবর্তীকাকেও দশকের পর দশক কালাপানি, লিপুলেখ বা লিম্পিয়াধুরা নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। ফলে ওই অঞ্চলে নানা উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণ করেই থাকে ভারত। ২০১৫ সাল থেকে নেপাল সুর চড়াতে শুরু করেছিল লিপুলেখ, কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা নিয়ে। সম্প্রতি ধরচুলা থেকে লিপুলেখ পাস পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরির কাজ ভারত শেষ করার পরে নেপালের সুর আরও চড়েছে।
ভারতের তৈরি এই নতুন সড়কটা যোগাযোগের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কৌশলগত ভাবেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই মহাসড়ক তৈরি হওয়ার ফলে মানস সরোবরে (যা তিব্বতে অবস্থিত) যাওয়া ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের পক্ষে অনেক সহজ হবে। মানস সরোবরে যেতে আগে সিকিমের নাথু লা দিয়ে বা নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে তিব্বতে অর্থাৎ চিনে ঢুকতে হতো। লিপুলেখ গিরিপথ পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে মানস সরোবর পৌঁছনো অনেক সহজ হয়ে গেল। আবার এই রাস্তাটা চীন সীমান্তের দুর্গম প্রান্ত পর্যন্ত ভারতের সামরিক বাহিনীকেও দ্রুত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল। তাই বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, নেপালের এই অবস্থানের নেপথ্যে চীনের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই সে তত্ত্ব মানছেন না।
নেপালের এই বদলে যাওয়া মেজাজের কারণ যা-ই হোক, ভারতকে পরিস্থিতির মোকাবিলা কিন্তু করতে হবে খুব সতর্ক ভাবে। প্রাক্তন কূটনীতিক শ্যাম সারণের মতে, ভারত-নেপাল সম্পর্ক দু’দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জন্য যে আচরণ নেপালের বর্তমান নেতৃত্ব করছেন, তাকে ‘অদূরদর্শী’ বলেও আখ্যা দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু তার পরেও সারণের সতর্কবার্তা, ‘‘ভারতকে খুব সতর্ক ভাবে পা ফেলতে হবে। নিজের এলাকার দখল নিজের হাতে রাখার প্রশ্নে ভারতকে অনড় থাকতে হবে। কিন্তু নেপালিদের আবেগকে প্রশমিত করা যায়, এমন পথ খোঁজার ইচ্ছাও ভারতকে দেখাতে হবে।’’ কী রকম হতে পারে সেই পথ? কালাপানি এলাকায় তীর্থযাত্রী বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেপালের নাগরিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে বা ওই এলাকায় ভারতের তৈরি বিভিন্ন পরিকাঠামো নেপালের নাগরিকরাও ব্যবহার করতে পারবেন— এই রকম কিছু প্রস্তাব বা বন্দোবস্তের কথা ভারতের ভাবা উচিত বলে সারণের মত।
প্রতিবেশীদের ভারতের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর অবস্থায় নেই এখন। পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন, তা গোটা বিশ্ব জানে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে। মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এই মুহূর্তে খুব ভালও নয়, খুব খারাপও নয়। ভুটানও চাইছে চিনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে। দিল্লির সঙ্গে সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক রেখে চলছে একমাত্র ঢাকা। অতএব প্রতিবেশীদের অধিকাংশকে নিয়েই অস্বস্তিতে থাকতে হচ্ছে কম-বেশি। ভারতের অর্থনীতিও একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। নেপাল সীমান্তের সমস্যাটাও ঠিক এই সময়েই যে ভাবে মাথাচাড়া দিল, তা কিন্তু ভারতের অস্বস্তি আরো বাড়াল।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা