ভারত সাগরের বিমান কেন স্থলভাগে ব্যবহার করছে?

সুবীর ভৌমিক | Jun 12, 2020 06:52 pm
পি-৮

পি-৮ - সংগৃহীত

 

ভারত সামুদ্রিক নজরদারি বিমান পি-৮ হিমালয় অঞ্চল ও থর মরুভূমিতে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা একে উদ্ভট সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত ভাইস-অ্যাডমিরাল বলেন, মার্কিন-নির্মিত পোসেডন পি-৮ বা জাপানের শিনমায়াওয়ার তৈরী ইউএস-২ খুবই ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা প্লাটফর্ম। ভারতীয় নৌবাহিনীতে এগুলোর অন্তর্ভুক্তি করা হয়েছে বা হতে যাচ্ছে দেশেল বিশাল উপকূলীয় রেখায় সামুদ্রিক নজরদারির জন্য বা ভারত মহাসারগীয় অঞ্চলে ভারতের সামরিক শক্তি প্রক্ষেপণের জন্য। এগুলো দ্বীপ এলাকায় অভিযানের জন্য খুবই কার্যকর এবং এতে অস্ত্র সজ্জিত করা হলে তা হয় দারুণ সম্পদ। কিন্তু এগুলোকে স্থলভাবে মোতায়েন করা মানে স্রেফ উদ্ভট ব্যাপার।

তিনি যুক্তি দেন যে বিকল্প আরো কিছু স্থান আছে, যেখানে আধিপত্য বিস্তার করার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন লাদাখের পানগঙ সর মতো বিশাল জলাধার। এখানেও সাম্প্রতিক সমযে চীনের সাথে উত্তেজনার তৈরী হয়েছে।
তিনি বলেন, চীনারা যেমন দ্রুতগামী, দীর্ঘ সময় মোতায়েনযোগ্য হেলিকপ্টার, নিরস্ত্র বা সশস্ত্র ড্রোন বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করছে, তেমন কিছু ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু পি-৮২ বা ইউএস-২ ওই এলাকায় ব্যবহার করা স্রেফ বোকামিপূর্ণ কাজ। আর এমনটা হতে পারে কেবল তখনই যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা নৌবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ধারণাই না থাকে।

প্রতিরক্ষা বিষয়ে অবহিত ব্যক্তিরা সাউথ এশিয়ান মনিটারকে বলেন, ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করছেন হিমালয় এলাকায় তথ্য পাওয়ার জন্য নৌবাহিনীর সর্বাধুনিক বিমান মোতায়েন নিয়ে।
বিমান বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, এই লক্ষ্যে তামিল নাড়ুর বিমানবাহিনীর ঘাঁটি থেকে পি-৮১ আটটি বিমানের সবগুলোই স্থায়ী ভিত্তিতে নর্দার্ন কমান্ডে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত পি-৮আই বিমানের প্রশংসা রাওয়াত করেছিলেন গত ফেব্রুয়ারিতে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে ২০১৭ সালে দোকলাম উত্তেজনার সময় চীনাদের সৈন্য চলাচলের গতিবিধি জানার জন্য এই বিমান ব্যবহার করা হয়েছিল।

রাওয়াতের এই ধারণা সেনাবাহিনীও সমর্থন করেছে। তাদের কথা হরো, তিন বাহিনলি সব বিমান সম্পদই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পারস্পরিক কাজে ব্যবহার করা উচিত। এ কারণেই বলা হচ্ছে যে সাময়িকভাবে পি-৮আই বিমান ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। তাদের মতে, বিমানগুলোকে অলসভাবে বসিয়ে না রেখে দোকলাম বা লাদাখে প্রয়োজনের আলোকে ব্যবহার করা যেতেই পারে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, উভচর অভিযানে বিশেষজ্ঞ, জে এম দেবাদস এক সাক্ষাতকারে এসএএমকে বলেন, এসব বিমান লাদাখ বা সিকিমের রণাঙ্গন ছাড়িয়ে তিব্বতের অনেক দূর পর্যন্ত দেখার সুযোগ করে দেয়। এতে করে পুরো যুদ্ধ এলাকা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়। পুরো এলাকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে আমাদের পক্ষে জবাব দেয়াও সহজ হবে।

ভারতীয় নৌবাহিনী প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রেতা হিসেবে পি-৮ বিমান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। আটটি বিমান ২০০৯ সালে ২.১ বিলিয়ন ডলারে কেনার চুক্তি হয়েছিল। প্রথম বিমানটি ভারতে এসেছিল ২০১৩ সালেল ১৫ মে। এখন আটটি বিমানের সবই ভারতীয় নৌবাহিনীতে কাজ করছে। বিমানগুলো তামিল নাড়ুর রাজ্যেল চেন্নাইয়ের কাছে আরকোনামের আইএনএস রাজালিতে রয়েছে। ইন্ডিয়ান নেভার এয়ার স্কয়াড্রোন ৩১২ এ তাদের পরিচালনা করে।
পি-৮আই বিমান হলো পি-৮এ পোসেডন-এর সংস্করণ। মার্কিন নৌবাহিনীর পুরনো পি-৩ বহরে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য বোয়িং এই বিমান নির্মাণ করেছে। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৯০৭ মাইল এবং চার ঘণ্টা আকাশে থেকে ১,২০০ নটিক্যাল মাইল উপর থেকে এটি কাজ করতে পারে। এসব বিমান হুমকি চিহ্নিত করতে পারে এবং প্রয়োজনে ভারতীয় উপকূলে আসার অনেক আগেই সেগুলো খতম করে দিতে পারে।

এর কমিউনিকেশন ও সেন্সর স্যুটের মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা পাবলিক সেক্টারের আন্ডারটেকিংস ও প্রাইভেট নির্মাতাদের স্থানীয়ভাবে তৈরী সরঞ্জাম। এতে অত্যাধুনিক সেন্সরের পাশাপাশি অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টি-সারভেজ ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অস্ত্রও রয়েছে।
ভয়াবহ হারপুন ব্লক-২ ক্ষেপণাস্ত্র, এম কে-৫৪ লাইটওয়েট টর্পেডো, রকেট সমৃদ্ধ এই বিমান ভারতের সেরা গোয়েন্দা চোখ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর যখন ব্যাপক মাত্রায় সামরিকায়ন হচ্ছে, তখন এই বিমান খুবই সহায়ক। এই বিমান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেও অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ ৩৭০ অনুসন্ধান অভিযান, বিশ্বে প্রথমবারের মতো বিমান থেকে হারপুন ব্লক ২ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, টর্পেডো বর্ষণ, নৌমহড়ায় অংশগ্রহণ করার কথঅ উল্লেখ করা যেতে পারে।
সেনাপ্রধান থেকে সিডিএস হওয়া রাওয়াত সম্ভবত উত্তরে সমন্বিত থিয়েটার প্রতিষ্ঠার জন্য এই উদ্যোগে বেশি উৎসাহী।

অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
অবসরপ্রাপ্ত ওই ভাইস-অ্যাডমিরাল এসএএমকে বলেন, অত্যন্ত বিশেষায়িত এই প্লাটফর্মটিকে অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য সরিয়ে নেয়াটা অপ্রয়োজনীয় কাজ।
জেনারেল রাওয়াতের পি-৮ বিমান স্থল ও হিমালয় অঞ্চলে ব্যবহার করাটা ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে ভালোভাবে দেখবে না।
তিনি বলেন, তারা এগুলো দোকলামে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওইসময় ঠিক কী ধরনের নজরদারি করা হয়েছে, তা নিশ্চিত নয়। এসব বিমান যে কাজের জন্য কেনা হয়েছে, তাতেই যদি না লাগে, তবে তা হবে অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনে করদাতাদের অর্থের অপচয়। কাঠ তোলার জন্য ঘোড়া কিংবা দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য হাতির প্রয়োজন নেই।
তাছাড়া যৌথ উদ্যোগের ফলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে নানা সমস্যাও হতে পারে।
আবারো পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক সিনিয়র বিমানবাহিনীর এয়ারমার্শাল বলেন, পি-৮ বিমান স্থলভাগে নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হলে এর ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে সেনাবাহিনীল প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আর বিমান ও নৌবাহিনীর অবস্থান দুর্বল হলো।

তিনি এসএএমকে বলেন, এই বিমান কেনা হয়েছিল ভারত মহাসাগরে ভারতের নৌআধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। এই লক্ষ্যেই আন্দামানে ভারতের প্রথম তিন বাহিনীর কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি।
ভারতীয় সাবেক কর্নেল ও বর্তমানে প্রতিরক্ষা শিক্ষাবিদ অনিত মুখার্জি সম্প্রতি ‘অ্যাবসেন্ট ডায়ালগ’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। এটি ভারতের বেসামরিক-সামরিক ও আন্তঃসামরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
তিনি বলেন, ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির একটি প্রতিবন্ধক হলো আন্তঃবাহিনী দ্বন্দ্ব ও যৌথতার অনুপস্থিতি। উদাহরণ হিসেবে আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ডে ভারতের কার্যক্রমের কথা বলা যায়। ভারত মহাসাগরে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য এখানকার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীণা বিশ্লেষকেরা মনে করে, এসব আইল্যান্ড হলো মালাক্কা প্রণালীতে যাওয়ার চাবিকাঠি। কিন্তু জয়েন্ট আন্দামান ও নিকোবর কমান্ডকে বেশ অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
জাপান থেকে ইউএস-২
ভারত এখন তার নৌবাহিনী ও উপকূলীয় রক্ষীদের জন্য জাপানের কাছ থেকে এক ডজন ইউএস-২ উভচর বিমান কেনার কথা ভাবছে। ইউএস-২কে বিবেচনা করা হয বিশ্বের সবচেয়ে ভালো উভচর বিমান। এসব উড়ন্ত নৌকা ৪৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে।

তবে প্রধানত উচ্চ মূল্যের কারণে এখন পর্যন্ত ক্রয় চুক্তি হতে পারেনি।
এদিকে রাজস্থানে পি-৮ মোতায়েন পাকিস্তানকে উত্তেজিত করবে। কারণ পাকিস্তানের সাবমেরিন বহর করাচিত পোতাশ্রয়ে মোতায়েন রয়েছে। এগুলো পোসেডনের হামলার পাল্লায় থাকবে।
পাকিস্তানি টুইটারিরা গত কয়েক দিন ধরে ভারতীয় বিমান বাহিনীল কার্যক্রম নিয়ে সতর্ক রয়েছৈ। তারা আরেকটা বালাকোট ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সন্দেহ করছে। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা সূত্রগুলো এ ধরনের কিছুর সন্ধান পায়নি বলে জানিয়েছে।

সূত্র : এসএএম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us