ফিলিস্তিনি আন্দোলনের ভিন্ন মাত্রা

রামজি বারুদ | Jun 12, 2020 05:17 am
ফিলিস্তিনি আন্দোলনের ভিন্ন মাত্রা

ফিলিস্তিনি আন্দোলনের ভিন্ন মাত্রা - সংগৃহীত

 

চিলিস্টিনিয়ান’। এর সাথে প্রথম পরিচিত হলাম গত ফেব্রুয়ারিতে। ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে। ‘প্যালেস্টিনিয়ান ফেডারেশন অব চিলির পরিচালক আনোয়ার মাজলুফ সম্মেলনে তার এক উপস্থাপনায় এই পদবাচ্যটি উচ্চারণ করেছেন। চিলিতে গভীরভাবে শেকড় গেড়ে থাকা ফিলিস্তিনি সমাজের কথা বলতে গিয়ে তিনি এই পরিভাষাটি উল্লেখ করেন। চিলিতে বসবাস করছে সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি। তাদের ব্যাপারে এই অপরিচিত পদবাচ্যটি শুনে হাসি পেল। অন্যরাও আমার মতোই হাসছিলেন।

ফিলিস্তিন সম্পর্কিত একটি সম্মেলনে একজন চিলিয়ান-ফিলিস্তিনি নেতার এ ধরনের উল্লেখ একটি বিরল ঘটনা। কারণ, ফিলিস্তিন-সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনায় সর্বত্র বিরাজ করছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অনৈক্য ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ছলচাতুরী। মনে হলো ‘চিলিয়ান-প্যালেস্টিনিয়ান’ কথাটা বলা কোনো সুযোগের সন্ধানার্থে। পরে উপলব্ধি করলাম, ঈযরষবংঃরহরধহং কথাটি এলোপাতাড়িভাবে কিংবা রসিকতা করে চালু করা হয়নি।

ড. লিনা মেরুয়েইন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত চিলিয়ান স্কলার। তিনি ঝপবহব অৎধনরধ নামের অনলাইন সাময়িকীর প্রতিনিধি বাহিরা আমিনকে বলেন, ‘চিলিস্টিনিয়ান’ কথাটি ‘চিলিয়ান-প্যালেস্টিনিয়ান’ কথাটি থেকে এই অর্থে পুরোপুরি ভিন্ন যে, এটি হচ্ছে একটি অনন্য আইডেন্টিটি বা পরিচয়সত্তা। তিনি বলেন, ‘এটি শুধু হাইফেন দেয়া এক পরিচয়সত্তা নয়, বরং দু’টি পরিচয়সত্তার একত্রীকরণ, যার মালিকানা যৌথভাবে দু’টি জাতিসত্তার, যাদের মধ্যে নেই কোনো সমস্যা।’ বাহিরা আমিন এটিকে উল্লেখ করেন একটি ‘থার্ড স্পেস’ হিসেবে, যা সৃষ্টি হয়েছে ১৫০ বছরের সময় পরিধিতে অভিবাসীদের মধ্যে।

যারা চিলির ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত নন, তারা অবাক হতে পারেন চিলি একটি পুরনো প্রবাদ শুনে। প্রবাদটি হচ্ছে : ‘চিলির প্রতিটি গ্রামে আপনি দেখতে পাবেন তিনটি বিষয় : একজন পুলিশ, একজন যাজক ও একজন ফিলিস্তিনি।’। কিন্তু এই প্রবাদ অবশ্যই প্রকাশ করে ফিলিস্তিন ও এমন একটি দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক বন্ধন, যে দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার একদম দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে। জেরুসালেম ও সান্টিয়াগোর মধ্যে ১৩ হাজার কিলোমিটারের বিশাল এক দূরত্ব। অংশত এর ব্যাখ্যা হতে পারে- এ কারণে চিলি ও এর বৃহৎ চিলিস্টিয়ান জনগোষ্ঠী সবস্থানের ফিলিস্তিনিদের ভাবনায় মর্যাদার কোনো স্থান করে নিতে পারেনি। কিন্তু অন্য কারণও আছে। একর পর এক আসা ফিলিস্তিনি নেতারা ফিলিস্তিনি অভিবাসী সমাজের, বিশেষত চিলির ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক শক্তিমত্তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। চিলিয়ান ফিলিস্তিনিদের কাহিনী শুধু সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের কাহিনীই নয়, বরং সাফল্যের এবং তাদের সমাজে ও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে অবদান রাখার কাহিনীও।

১৯৭০-এর দশক থেকে ফিলিস্তিনি নেতারা চেষ্টা চরিত্র চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়াশিংটন ও পশ্চিমা দেশের অন্যান্য রাজধানীর সাথে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত থাকতে। কারণ, তাদের পরম বিশ্বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বৈধতা প্রদান ছাড়া ফিলিস্তিনিরা সবসময় প্রান্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। কিন্তু এই হিসাব-নিকাশ ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা ও নির্দেশনা অবলম্বন করতে গিয়ে ফিলিস্তিনি নেতাদেরকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ শেষ পর্যন্ত সেটাই প্রমাণ করল।

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর রয়েছে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়াও। বিগত তিন দশকে ফিলিস্তিনিরা সামগ্রিকভাবে তাদের পশ্চিম গোলার্ধের ঐতিহাসিক মিত্রদের অস্বীকার করে নিজেদের গড়ে তুলেছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে। আরো খারাপ দিক হলো, এই নতুন ভাবনা ফিলিস্তিনের ফিলিস্তিনি ও দক্ষিণ আমেরিকার ফিলিস্তিনি-সমাজের নিজ-গোত্রীয়দের মধ্যকার ফাটলকে প্রশস্ততর করেছে। এর পরেও দক্ষিণ আমেরিকার ফিলিস্তিনি সমাজ আরো সুদৃঢ় করেছে ভাষা, সঙ্গীত এবং তাদের পূর্ব-পুরুষদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা।

চিলির ফিলিস্তিনি ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য ফিলিস্তিনি সমাজের অনন্য দিকটি হচ্ছে- তাদের শেকড় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার বহু দশক আগে প্রোথিত। ইসরাইল প্রায়ই দাবি করে, আধুনিক বিবেচনায় ফিলিস্তিনিদের কোনো পরিচয়সত্তা নেই। কিছু কিছু স্কলার মাঝেমধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একমত হয়ে দাবি তোলেন, আধুনিক ফিলিস্তিনি পরিচয়সত্তা ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হয়েছে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ধ্বংসযজ্ঞ ‘ নাকাবার পর।

যারা এখনো এ ধরনের ঐতিহাসিক বিচ্যুতি লালন করে থাকেন, তাদের উচিত নূর মাশালার মতো
ফিলিস্তিনি ইতিহাসবেত্তার ‘প্যালেস্টাইন : অ্যা ফোর থাউজ্যান্ড ইয়ার হিস্ট্রি’ বইটি পড়ে দেখা। ‘চিলিস্টিনিয়ানস’ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি পরিচয়সত্তার সত্যিকারের এক জীবন্ত উদাহরণ, যার অস্তিত্ব ছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি মানচিত্রের ওপর ইসরাইলি মানচিত্র বসিয়ে দেয়ার আগে।

উবঢ়ড়ৎঃরাড় চধষবংঃরহড় চিলির প্রিমিয়ার ডিভিশনের একটি ফুটবল ক্লাব। অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এর আরো চার বছর পর। ইস্তাম্বুল সম্মেলনে চিলিস্টিনিয়ান প্রতিনিধি আমাকে জানালেন, সেখানকার ফিলিস্তিনি সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ‘প্যালেস্টিনো’ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ, তিনি চেয়েছেন তাদের সন্তানেরা যেন কখনোই ‘ফিলিস্তিন’ নামটা ভুলে না যায় এবং আগামী দিনগুলোতেও এ নাম উচ্চারণ কতে পারে। এই ক্লাব ফিলিস্তিনের ‘দ্বিতীয় জাতীয় ফুটবল দল’ হিসেবে পরিচিত। শিগগিরই এটি পালন করবে এর শতবার্ষিকী। সম্ভবত ‘গাজা রেজিস্টস; প্যালেস্টাইন এক্সিস্টস’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে এ উৎসব।

সান্টিয়াগোতে প্যালেস্টিনোর ‘লা স্তিরানা’ স্টেডিয়াম হচ্ছে একটি বিশাল অট্টালিকা, যাতে উড়ছে ফিলিস্তিনি পতাকা। এটি শুধু ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার বৈধ ঘোষণাই নয়, বরং সেই সাথে ফিলিস্তিনি সংস্কৃতির উদারতারও পরিচয় বহন করে। স্টেডিয়ামটি এই রাজধানী নগরীর সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়গত মিলনকেন্দ্র, যেখানে আসেন সবশ্রেণীর মানুষ।
চিলিসহ দক্ষিণ আমেরিকার সব ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা বুঝতে সঙ্কোচনবাদী বোঝাপড়া এড়াতে আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে, অন্যান্য সমাজের মতো ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও রয়েছে নিজস্ব বিভাজন। আর এই বিভাজন মাঝেমধ্যেই নিয়ন্ত্রিত হয় সম্পদ, শ্রেণী ও রাজনীতি দিয়ে। এটা চরমে পৌঁছেছিল ১৯৭৩ সালে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোশের পরিচালিত এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত অভ্যুত্থানের সময়। কিন্তু এই বিভাজন বেশি দিন টিকে থাকেনি।

তখন চিলিয়ানেরা আবারো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলের পরিচালিত সাবরা ও শাতিলা হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার পর। তখন থেকে চিলির ফিলিস্তিনি সমাজ তাদের বিভাজন থেকে শিক্ষা নিয়েছে : তাদের অভিন্ন ক্ষেত্রে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বছরের পর বছর ধরে এখন চিলিস্টিনিয়ানেরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার ফিলিস্তিনি সমাজের সাথে, ঐক্যের প্রয়োজনের ওপর জোরালো গুরুত্বারোপ করে। তারা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে বিভাজনবাদের রাজনৈতিক মিল-অমিল থেকে, যা ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক পরিচয়সত্তার জন্য ব্যাপক ক্ষতি বয়ে এনেছিল। ধীরে ধীরে দক্ষিণ আমেরিকার ফিলিস্তিনিরা আবার একতাবদ্ধ হচ্ছে ফিলিস্তিনে বৃহত্তম মূলধারার কেন্দ্রে চলে আসার লক্ষ্যে। তারা শুধু সঙ্ঘবদ্ধ ফিলিস্তিনি পরিচয়সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে চায় না, বরং হতে চায় রোল মডেল, যা পুরোপুরিভাবে বুঝতে এবং তা অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
এর পর থেকে একদিনও আমার স্পোর্টস অ্যাপ আনচেকড রাখিনি ‘ডিপোর্টিভো প্যালেস্টিনো’র অগ্রগতি জানার জন্য। আমি জানি, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের আরো অনেক ফিলিস্তিনি একই কাজটি করে থাকে। কারণ, দূরত্ব, ভাষা ও সময়ের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এরা মনে করে- আমরা থাকব একই জনগোষ্ঠী।

লেখক : রামজি বারুদ সাংবাদিক, এবং ‘দ্য প্যালেস্টিনিয়ান ক্রনিকল’-এর সম্পাদক। ইস্তাম্বুল জাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের রেসিডেন্ট সিনিয়ার রিসার্চ ফেলো। তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট িি.িৎধসুুনধৎড়ঁফ.হবঃ।
ভাষান্তর : সা’দাদ রহমান


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us