১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের একটি বিশ্লেষণ
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের একটি বিশ্লেষণ - সংগৃহীত
অতীতের ভুল থেকে স্বচ্ছতা ও শিক্ষা গ্রহণ করার কাজটি বেশির ভাগ দেশই করে না। এমনকি কী কী ভুল করা হয়েছিল এবং কারা দায়ী, তা চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিশন গঠিত হলেও যারা ভুলগুলো করেছে এবং যেসব কাঠামোগত ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনো অস্পর্শই রয়ে গেছে। এসব কমিশনের তৈরী প্রতিবেদনগুলো মোটামুটিভাবে জনসাধারণের চোখের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে দায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের প্রকাশ্য লজ্জায় পড়তে না হয়।
বর্তমান সময়ে স্বচ্ছতা অত্যন্ত জনপ্রিয় দাবি। কিন্তু বেশির ভাগ সরকারই তা পছন্দ করে না। তবে অতীত ভুল থেকে স্বচ্ছতা ও শিক্ষা গ্রহণ টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য বিষয়।
ভারতে যে স্বচ্ছতার অভাব আছে, তার প্রমাণ হলো হেন্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টটির এখনো আলোর মুখ না দেখা। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনার জন্য অপারেশন রিভিউ নামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ওই প্রতিবেদন রচনা করেছিলেন। তারা হলেন লে. জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুকস ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্রেমিন্দ্র সিং ভঅগত (ভিক্টোরিয়া ক্রস)।
চীন ও ভারতের মধ্যে ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত সীমান্ত রেখা বিরোধ নিয়ে ওই যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহের লাল নেহরু তার নতুন ফরোয়ার্ড পলিসি অনুযায়ী বিরোধপূর্ণ এলাকায় নতুন সামরিক চৌকি স্থাপন করেন। এর জের ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে ১৯৬২ সালে যুদ্ধ হয়। এতে ভারতের বিপর্যয়কর পরাজয় ঘটে।
উত্তর পূর্ব ফ্রন্টিয়ার এজেন্সিতে (এনইএফএ) চীনা হামলার মুখে চার হাজারের বেশিকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নেয়া হয়, ১৫ হাজারের বেশি সৈন্যর একটি পুরো ডিভিশন লজ্জাজনকভাবে পিছু হটে। যুদ্ধে ভঅরতের ১,৩৮৩ সৈন্য নিহত হয়, ১,০৪৭ জন আহত হয়, ১,৬৯৬ সৈন্য নিখোঁজ হয়। এক হাজারের বেশি সৈন্য ওই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে আশ্রয় গ্রহণ করে। বেইজিং হঠাৎ করে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং সে তার সৈন্যদের সাবেক অবস্থানে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়।
সরকারিভাবে ভারত এই পরাজয়কে আড়াল করার চেষ্টা করে এবং এখন পর্যন্ত যুদ্ধের জন্য চীনকে দায়ী করছে। কিন্তু নিজেদের অপরাজেয় বিবেচিত ভারতীয় সেনাবাহিনী কেন এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করল, তা নির্ধারণ করার জন্য ব্রুকস-ভগত কমিশন গঠন করে। আলোচনার জন্য চীনা অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নেহরু এবং ফরোয়ার্ড পলিসির ব্যাপারে তার জেদের কারণেই ভঅরত পরাজিত হয় বলে ১৯৭০ সালে প্রকামিত নেভিল ম্যাক্সওয়েলের লেখা বই ইন্ডিয়াস চায়না ওয়ার-এ বলা হয়েছে।
ম্যাক্সওয়েল তার তদন্তের সময় ব্রুকস-ভগত প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ওই প্রতিবেদন অনেক বছর গোপন রাখা ছিল। নেভিল ম্যাক্সওয়েল তার দুই খণ্ডের প্রতিবেদনের প্রথমটি তার ওয়েবসাইটে পোস্ট করার পর ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ এর কিছু অংশ (৫ দশক পর) আলোর মুখ দেখে। বর্তমানে কিছু পৃষ্ঠা না থাকলেও বৃহত্তর পাবলিক অনলাইনে পাওয়অ যায়। প্রতিটি পৃষ্ঠায় টপ সিক্রেট চিহ্নিত ১৯৬৩ সালের প্রতিবেদনটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে।
এই প্রতিবেদনে জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুকস বাস্তবসম্মতভাবেই অপ্রস্তুত অবস্থায় ভারতকে যুদ্ধে জড়িত করার জন্য পুরো বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বকে দায়ী করেন। শীতকালে পাহাড়ি এলাকার তীব্র ঠাণ্ডায় সৈন্যদের গরম পোশাক না দিয়েই যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। নিরাপদ সরবরাহের জন্য রাস্তা না থাকায় লজিস্টিকস ছিল বড় সমস্যা। এয়ার ড্রপের প্রয়োজন থাকলেও সেগুলো ভুল স্থানে ফেলা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে সৈন্যদের অবস্থান ও ফেলার জায়গার মধ্যে অনেক ব্যবধান ছিল। এর ফলে খাদ্য, গোলাবারুদের স্বল্পতা দেখা দেয়, আর এতে করে সৈন্যদের উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে।
এই প্রতিবেদনে যাদেরকে দায়ী করা হয়, তাদের একজন হলেন কৃষ্ণ মেনন। তিনি তখন ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের আগে সামরিক নেতৃত্বের সাথে সভাগুলোর কার্যবিবরণী না রাখার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ব্রুকস ‘বিস্মিত’ বলে জানান। ব্রুকস বলেন, এর পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। কারণ এতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য ইন্টিলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক (ডিআইবি) বি এন মল্লিককে তীব্রভাবে সমালেচানা করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মনে হচ্ছে ডিআইবির অভিমত ছিল এই যে চীনারা নতুন সীমান্ত চৌকি প্রতিষ্ঠায় প্রতিক্রিয়া দেখাবে না এবং তাদের শক্তি থাকলেও কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করবে না। এর ফলে চীনার যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে তখন আইবি ঘুমিয়ে থাকে।
সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রধান অপরাধী হিসেবে অভিহিত করা হয় লে. জেনারেল বি এম কাউলকে। তিনি ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ ও পরে কমান্ডার ৪ কোর। প্রতিবেদনে পরোক্ষভাবে তাকে দায়ী করে বলা হয়, ইস্টার্ন সেক্টরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়। ব্রুকস তীব্র ভাষায় চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) কাউলের সমালোচনা করে বলেন যে তিনি সৈন্যদের ওপর অসম্ভব টার্গেট নির্ধারণ করে দেন। লেফটেন্যান্ট থাকার সময় কাউলকে আর্মি সাপ্লাই কোরে বদলি করা হয় এবং ব্রিগেডিয়ার হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে লড়াই করার কোনো অপারেশনাল ইউনিটের কমান্ডার করা হয়নি। ইনফেন্ট্রি, আরমার, আর্টিলারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং (কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারদের পদাতিকের চেয়ে অনেক কঠিন ভূমিকা পালন করতে হয়) বিভাগের সিনিয়র অফিসারদেরকেই কমব্যাট ইউনিটের কমান্ডে থাকতে হয়। কিন্তু কিভাবে যেন সাপলাই কোরের কেউ হয়ে গেলেন। তিনি কিভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অপারেশনাল কোরের প্রধান হয়ে গেলেন, তা বোধগম্য নয়। তবে কাউলের বেশির ভাগ পদোন্নতি ও পদায়ন হয়েছে তার ‘ব্রাহ্মণ’ কানেকশনে। তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহরুর খুবই কাছের লোক ছিলেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের প্রিয়পাত্র ছিলেন।
সিজিএস হিসেবে জেনারেল কাউল সরকারের এই মিথকে গ্রহণ করেছিলেন যে চীনারা নেহরুর ফরোয়ার্ড পলিসিতে প্রতিক্রিয়া জানাবে না। এছাড়া স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি মাঠ পর্যায়ের অভিযান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন, কমান্ডের দায়িত্বে থাকার সময় দিল্লিতেই অবস্থান করে নির্দেশ দিতে থাকেন।
১৯৬৮ সালে ব্রিগেডিয়ার জন ড্যালভি, ৭ম ইনফ্যানিট্র ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডিং অফিসার ও ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, হিমালয়ান ব্লান্ডার নামের একটি বই লিখেন। এতে তিনি ভারতের পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ বিবরণ দেন। জেনারেল কাউল সম্পর্কে তিনি বলেন, তিনি কষ্ট থেকে এবং জুনিয়র হিসেবে সামরিক কমান্ডারের জ্ঞান শেখা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হলেও তার সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্মি সিনিয়র কমান্ডে নিয়োগ লাভে সক্ষম হন। জওহেরলাল নেহরুর সাথে তার সম্পৃক্ততা চীনাদের হাতে লজ্জাজনক পরাজয় ও ভারতীয় সৈন্যদের গণহারে নিহত হওয়ার একটি বড় কারণে পরিণত হয়।
কাউল ছিলেন নেহরুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বিদায়ী সেনাপ্রধানের পরামর্শ না শুনে ও যুদ্ধ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন তাকে জেনারেল স্টাফের চিফ করেন। জেনারেল কাউলকে ১৯৬২ সালের বিপর্যয়ের পর পদত্যাগ করতে হয়। তার ব্যক্তিগত সুপারিশের কারণেই ভারতীয় বাহিনী এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী জওহের লাল নেহরু ও ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল পি এন থাপারের ভূমিকা নিয়ে অনেকটাই নীরবতা পালন করা হয়। অবশ্য নেহরুর ফরোয়ার্ড পলিসির ব্যাপারে পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তোলা হয়।
তবে নেহরু ও থাপারই ওই যুদ্ধের কারণে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে পড়েন। চীনারা যেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, তার এক দিন পরই, ২২ নভেম্বর, ১৯৬২ তারিখে জেনারেল থাপার পদত্যাগ করেন। পরাজয়ের দুই বছর পর ভগ্নহৃদয়ের মানুষ হিসেবে ওই ফরোয়ার্ড পলিসিরি কৌশলগত ভুলের দায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতের ইতিহাসে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ স্রেফ কোনো দুর্ভাগ্যজনক ও ক্ষণস্থায়ী ঘটনা ছিল না। বিরোধপূর্ণ সীমান্তে নয়া দিল্লির অবস্থান প্রশ্নে এখনো ওই যুদ্ধ সজীব রয়েছে। তারা এখনো চীনের উত্থান নিয়ে ভীত এবং সামরিক বাহিনীর ঘাটতি নিয়ে চিন্তিত, ভারতের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অবস্থান শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
সূত্র : এসএএম