চীনা পরিকল্পনা নিয়ে যা ভাবছে ভারত

নিজস্ব প্রতিবেদক | Jun 07, 2020 10:08 pm
চীনা পরিকল্পনা নিয়ে যা ভাবছে ভারত

চীনা পরিকল্পনা নিয়ে যা ভাবছে ভারত - সংগৃহীত

 

চীন-ভারত উত্তেজনা ব্যাপক। রোববার দুই দেশ আলোচনায় বসলেও সমাধানের বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তেজনা আরো কিছু দিন অন্তত জিইয়ে থাকবে? কেন এই উত্তেজনা? ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরা হলো।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি তখন সবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। চীন সরকার ভারত থেকে কয়েকজন সাংবাদিকের এক প্রতিনিধি দলকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে বেইজিং-সাংহাই নিয়ে গেল। প্রবীণ সাংবাদিক ডঃ স্বপন দাশগুপ্ত ছিলেন আমাদের প্রতিনিধি দলের কাণ্ডারী। মনে আছে, রওনা দেওয়ার আগে দিল্লি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে স্বপনদা বলেছিলেন, “জানো তো, এর আগে কখনই চীনে যাইনি।” বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কেন? তুমি তো গোটা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছ। তা চীন কেন যাওনি?”

শুনলাম, চীন কখনোই তাকে ভিসা দেয়নি। তাইওয়ান অবশ্য একাধিকবার তাকে সে দেশ দেখাতে নিয়ে যায়। অনেকেরই ধারণা, পাসপোর্টে তাইওয়ানের ভিসার ছবি থাকলে চীন সেই ব‍্যক্তিকে, বিশেষত কোনো ভারতীয়কে, তাদের দেশের ভিসা দেয় না। তার ওপর স্বপন দাশগুপ্ত ভারতের অন্যতম দক্ষিনপন্থী পাবলিক ইনটেলেকটচুয়াল। তাহলে ২০১৪ সালের পর এমন কী ঘটল?

আজ স্বপনবাবু রাজ‍্যসভার সদস্য, বিজেপির বিশিষ্ট নেতা। মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের ছ’বছর অতিবাহিত। আজ এত বছর পর এই তুচ্ছ ঘটনাটি মনে পড়ার কারণ একটাই। এক ভারতীয় কূটনীতিক সাংহাইয়ে বুঝিয়েছিলেন, চীন কোনো কাজ না ভেবে হঠাৎ করে ফেলে না। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পিছনেই থাকে সুপরিকল্পিত নকশা। সম্ভবত সে সময়ে নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চীন দ্রুত সখ‍্য গড়ারই অঙ্ক কষছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর ছিলেন। জয়শংকর আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ম‍্যাণ্ডারিন ভাষায় স্বচ্ছন্দ তিনি। আমরা তখন দেখেছিলাম, সুষমা এবং জয়শংকরকে সমাজতান্ত্রিক চীন কীভাবে প্রতিটি অনুষ্ঠানে কূটনৈতিক গুরুত্ব দিচ্ছিল। চীনের মিডিয়া প্রতিনিধি দল কার্যত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে, ভারত নিয়ে তাদের কৌতূহল ও উৎসাহও ছিল দেখার মতো।

এখানে একথাও মনে রাখতে হবে, মোদিকে ভোটের আগে যখন আমেরিকা ভিসা দিতেই রাজি হচ্ছিল না, তখন চীন কিন্তু গুজরাতের মুখ‍্যমন্ত্রীকে মহাসমারোহে ‘গ্ৰেট ওয়াল প্রোটোকল’ ভেঙে বেইজিং নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকেও সবরমতী নদীর তীরে ঝুলায় বসিয়ে এক যৌথ কূটনৈতিক রোমান্সের নিদর্শন দেখান। কাজেই মোদি ক্ষমতায় এসেই শপথ গ্ৰহন অনুষ্ঠানে যেমন সার্ক ভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বিশেষ খাতির যত্নের নমুনা প্রদর্শন করেন, তেমনটা করেছিলেন চীন সম্পর্কেও।

কিন্তু চীনের ভারত সম্পর্কে মনোভাবে তাতে কোনো বদল এলো না। ২০১৭ সালে ডোকলাম কান্ড। সে সময়ে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলল ৭৩ দিন ধরে। তারপর ২০২০ সালের মে মাসে লাদাখে আবার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় মুখোমুখি দু’দেশের সেনা। যখন গোটা দুনিয়া করোনা নামক এক দানব ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তখন হঠৎ চীন এই সীমান্তে আগ্ৰহী হলো কেন? চীন সেনা ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকল কেন? পাঙ্গং লেকের একটা অংশ তারা দখল করতে চাইল কেন? গালওয়াল ঘাটিতে চীন তাদের সেনা মোতায়েনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল কেন?

একটা কথা তো স্পষ্ট, যে ১৯৬২ সালে ৩,৫০০ কিমি দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার এই এলাকাতেই চীন অনুপ্রবেশ করেছিল। আকসাই চীন দখল করে নিয়েছিল, যে ভূখণ্ড ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ডবলিউ এইচ জনসনের সীমারেখা অঙ্কনের মাধ্যমে ভারত পেয়েছিল। যাকে বলা হয় জনসন লাইন। ১৯৫১ সাল থেকেই এখানে সড়ক নির্মাণ নিয়ে ভারত-চঅন বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে সে ভূখণ্ড ভারত হারায়, আজও তা পাওয়া যায়নি। অতএব চীনের প্রসারবাদ ও ভারত-বিরোধী আগ্ৰাসন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

প্রশ্ন হলো, এরকম করোনা আক্রান্ত এক বিধ্বস্ত সময়ে চীন এটা কেন করল? আর এখনো চীন ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে তার সমস্ত সেনা প্রত‍্যাহারও কিন্তু করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসময়ে চীনের আক্রমণের কারণ বিবিধ। মূল কারণ হলো, করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীন। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই ভাইরাসের নাম চীনা ভাইরাস দিতে চেয়েছিলেন। জাতিসঙ্ঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ পৃথিবীর নানা দেশের কাছে চীন আজ ব্রাত্য। জাপান সরকার তো ঘোষণাই করেছে যে চীন থেকে সমস্ত জাপানি ব‍্যবসায়ী তাদের বিনিয়োগ প্রত‍্যাহার করুন। ওই অর্থ জাপান সরকার তাদের দেবে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, করোনা কাণ্ডে চীনের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করার আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত কমিটির প্রধান এবার ঘটনাচক্রে ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। চীনের শঙ্কা রয়েছে। তদন্তে যদি এটা বোঝা যায় যে চীন তথ‍্যের কারচুপি করেছে, অনেক তথ্য জানায়নি, তবে কিন্তু চীনের সমস্যা বাড়বে। তৃতীয়ত, আমেরিকা প্রকাশ‍্যে চীন সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, করোনা বিবাদ না মেটা পর্যন্ত আমেরিকা চীনের সঙ্গে কথা বলবে না‌।

চতুর্থ, হংকং-এর বিদ্রোহ এবং পঞ্চম, সেই তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসনের হুঙ্কার, এইসব চীনকে বেশ চাপের মধ‍্যে ফেলে দিয়েছে। সম্ভবত এই কারণেই চীন এখন কোনো অস্ত্র ব‍্যবহার না করে ভারতীয় সেনার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এছাড়া ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি ও কাশ্মীর ইস‍্যুতেও চিনের প্রতিক্রিয়া আছে। পাকিস্তানকেও খুশি রাখা চীনের প্রয়োজন। গোটা পৃথিবীতে যখন উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরাইল, ফিলিস্তিন প্রভৃতি বিবাদমান দেশগুলো কোথাও কোনো ঝামেলা করছে না। তখন চীন এমন একটা কান্ড করল। এটা আচমকা প্রতিবর্ত নয়। এটা সচেতন। পরিকল্পিত। এটাই চীনের ডিএনএ।

এবার প্রশ্ন হলো, নরেন্দ্র মোদি কী করলেন? বা কী করছেন? একথা সত্য, করোনা নিয়ে ব‍্যস্ত সরকারের কাছে এহেন চীনা সেনা অনুপ্রবেশ ছিল অপ্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে মোদি ব‍্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি চীন সঙ্কট নিরসনে তিনজনের সঙ্গে বৈঠক করেন বিশেষভাবে। এরা হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর এবং চিফ অফ ডিফেন্স বিপিন রাওয়াত। ডোকলামের সময়ও কিন্তু এই তিনজনই ছিলেন প্রধান কুশীলব। শুধু তখন জয়শংকর ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এবং রাওয়াত সেনা প্রধান। মোদীর নির্দেশে রাজনাথ সিংহও হুমকি দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যেকোনো ধরনের সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এটা বলার প্রয়োজন ছিল, কারণ তার আগে শি জিনপিং ও তার সেনাবাহিনীকে একই বার্তা দেন।

নরেন্দ্র মোদির রণকৌশল ছিল একদিকে শক্তি প্রদর্শন, অন‍্যদিকে সংযম। আমেরিকা মধ্যস্থতা করতে চাইলেও ভারত তাতে রাজি হয়নি। আবার আমেরিকা এখন জি-৮ শীর্ষ বৈঠকে ভারতকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। চীন কখনোই চাইবে না, ভারত আমেরিকার পেন্টাগন ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হয়ে যাক। চীন বিভিন্ন দেশে সড়ক নির্মাণ করে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিচ্ছিল, নেপালের মতো রাষ্ট্রকে তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিল, মোদির কৌশলে তা রদ হয়েছে।

নেপালের সংসদ তাদের মানচিত্র বদলে বেশ কিছু ভারতীয় ভূখণ্ড নেপালের জমি বলে দাবি করার তালে ছিল। চীনের ইশারাতেই নেপালের ‘অসুস্থ’ প্রধানমন্ত্রী এসব করছিলেন। ভারতের চাপে নেপাল আবার ব‍্যাকফুটে গেছে। চীন ব‍্যাক চ‍্যানেল কূটনীতিও শুরু করে দিয়েছে। ভোল পাল্টে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। চিনের বিদেশমন্ত্রক বলেছে, যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা নেই। দিল্লিতে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ড্রাগন আর হাতি আবার যৌথভাবে নৃত্য করবে। মোদি সরকারের শক্তি ও সংযমের যৌথ রণকৌশলের সাফল্য এটি। ৬ জুন, শনিবার দু’দেশের সেনা পর্যায়ের বৈঠক হয়। নয়া দিল্লিরই প্রস্তাব। চীন মেনে নিয়েছে। এর আগে জেনারেল পর্যায়ের আট-দফা বৈঠক হয়েছে। চীন ও ভারত দু’পক্ষের সেনা পিছু হঠেছে।

লাদাখ সীমান্তের চুশল মলডো সেনা ছাউনিতে এই বৈঠক। নেতৃত্ব দেন ১৪ কোরের কমান্ডার। দু’দেশই আপাতত এই সংঘাতের আবহকে শান্তির পথে আনতে উদ‍্যোগী। এ হলো আশার কথা। কিন্তু দেশের অভ‍্যন্তরে ও বিশ্বের দরবারে নানা সমস্যায় জর্জরিত চীনের দীর্ঘমেয়াদি প্রসারবাদের ডিএনএ সম্পর্কে ভারতকে সর্তক থাকতে হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us