এবার যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়বে না চীন!
ট্রাম্প ও শি - সংগৃহীত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্রদের মধ্যে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল ইতিহাসে তা-ই স্নায়ুযুদ্ধ বা (ঈড়ষফ ডধৎ) নামে পরিচিতি পেয়েছে। এই যুদ্ধ ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী এই দুই ক্ষমতাশালী প্রতিপক্ষের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের সপক্ষে; আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশগুলো ছিল সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রপন্থী। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সাবেক পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডা। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র- বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া। যেসব দেশ দু’পক্ষের কাউকেই সরাসরি সমর্থন করত না, তাদের ‘নিরপেক্ষ’ দেশ বলা হতো। তৃতীয় বিশ্বের নিরপেক্ষ দেশগুলো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাটকীয় পতনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান হয়।
‘শীতল যুদ্ধ’ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অতিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সমগ্র বিশ্ব দু’টি শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পর্বে মার্কিন আধিপত্যবাদের সূচনা হয় এবং জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি আণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্বের জানান দেয়। এই ঔদ্ধত্য রুশ শিবিরকে ঠাণ্ডা যুদ্ধে শামিল করে। বিশ্ব অর্থনীতির দিক থেকে শক্তিশালী, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ‘রুশ আধিপত্যবাদ’বিরোধী হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা ও ১৯৪৭ এর মার্শাল পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
এভাবে স্নায়ুযুদ্ধ শুধু ইউরোপীয় রাজনীতিকেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তী সঙ্কটগুলো যেমন- কিউবা, কোরিয়া এবং নানা সঙ্ঘাত ও ছোটখাটো যুদ্ধগুলো আন্তর্জাতিক আঙিনায় এক জটিলাবস্থা ও রেষারেষির উদ্ভব ঘটায়। এশিয়ার মাটিতে এই রেষারেষি বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনিশ্চয়তা ও রুদ্ধশ্বাস টানাপড়েনের জন্ম দেয়। ফলে বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হয়। ন্যাটো ও সিয়াটোর পাশাপাশি রুশশক্তির গঠিত ‘ওয়ারশ জোট’ স্নায়ুযুদ্ধকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। জার্মানির বিভক্তিকরণ এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার সন্ধান এই সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা ঠাণ্ডাযুদ্ধ কর্তৃক প্রভাবিত হয়। চিরায়ত, বাস্তববাদী ও সংশোধনবাদী ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় এই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।
মূলত ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়। ফলে বিশ্ব পরাশক্তি এক কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে আবির্ভূত হয়। অবশ্য স্œায়ুয্দ্ধুকালে বিশ্ব পরাশক্তিতে একটা ভারসাম্য লক্ষ করা গেছে। এক পরাশক্তি কোনো ক্ষুদ্র বা দুর্বল রাষ্ট্রের প্রতি বৈরী আচরণ করলে অপর পরাশক্তি তার সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর তা আর অবশিষ্ট থাকেনি। ফলে ভারসাম্যহীন বিশ্ব পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে ‘একচ্ছত্র দণ্ডমুণ্ডের কর্তা’।
সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এশিয়ার বৃহত্তর রাষ্ট্র হিসেবে নীরবে-নিভৃতে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ায় মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে উদীয়মান পরাশক্তি চীন। ফলে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সে আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে বিশেষ এক সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ওয়াশিংটনের প্রতি স্পষ্ট কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন, যা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধেরই ইঙ্গিত বহন করে। তার ভাষায়, কোভিড প্যানডেমিক নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ছড়িয়ে মার্কিন কিছু রাজনীতিবিদ দুই দেশের মধ্যে নতুন এক শীতল যুদ্ধ শুরুর পাঁয়তারায় লিপ্ত। চীনা মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমেরিকাকে বদল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও চীনের নেই। সুতরাং চীনকে বদলের অবাস্তব যে স্বপ্ন আমেরিকা লালন করছে, তা তাদের পরিহার করা উচিত।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘গত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সহযোগিতার ফলে যে সুফল তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট করলে তাতে আমেরিকার নিজের ক্ষতি তো হবেই, পুরো বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং সচ্ছলতা হুমকিতে পড়বে।’ চীনের কাছ থেকে এমন জোরালো বক্তব্য এমন সময় এলো যখন করোনাভাইরাসের সব দায় চীনের ওপর চাপানোর চেষ্টায় রাশ টানার কোনো লক্ষণই দেখাচ্ছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজ অভিযোগ করেছে, ‘চীন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত লাখো মানুষকে বিমানে উঠিয়ে সারা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে, যাতে একটি প্যানডেমিক তৈরি হয়।’ এ অভিযোগের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেইজিং। এ দিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে শায়েস্তা করতে দেশটির সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তেমন আভাসই পাওয়া গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সময় চীনকে কোণঠাসা করে নতুন এক শীতল যুদ্ধের চেষ্টা কি শুধুই ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তার কিছু সহযোগীর কাজ? পর্যবেক্ষকরা অবশ্য তা মনে করছেন না। তাদের দাবি, বেশ আগে থেকেই বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈরিতা দিনে দিনে বাড়ছে। করোনাভাইরাস প্যানডেমিক তাতে শুধু নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে পুরোমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর পারস্পরিক অবিশ্বাস এত খারাপ কখনো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা এশিয়া সোসাইটির মার্কিন-চীন সেন্টারের পরিচালক অরভিল শেল বিজনেস ‘ইনসাইডার’ পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা একটি শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।’ হংকংয়ের ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক জ্যঁ পিয়ের সেবাস্টিয়ান লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নতুন একধরনের শীতল যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনকে আমেরিকা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল নেয়। তাতে পরিষ্কার বলা আছে, আর কোনো দিনই বিশ্বের কোথাও তারা এমন কোনো শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেবে না, যারা আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আর অনেক দিন ধরেই চীনকে তারা ভবিষ্যতের জন্য সে ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক সরকারি সব নথিপত্র ও দলিলে তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়, সুযোগ পেলেই চীনকে ঘায়েল করার বিষয়ে আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য রয়েছে। মূলত চীনের প্রতি বৈরিতা আমেরিকা শুধু নথিপত্রের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বেশ কিছু দিন ধরেই কার্যকর করতে শুরু করেছে।
চীনের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে, যেমন ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম- সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশগুলোর সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করছে। ডব্লিউটিও বা ডব্লিউএইচও’র মতো যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চীনের প্রভাব রয়েছে, যেগুলোর সুবিধা চীন নিচ্ছে, সেগুলোকে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর চীন চোখের সামনে এগুলো দেখছে। তাদের মধ্যে একধরনের উৎকণ্ঠা জোরদার হচ্ছে যে, আমেরিকা তাদের নথিপত্রে লেখা কৌশল বাস্তবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে এই উদীয়মান পরাশক্তিকে। অবশ্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, “যে ‘শীতল যুদ্ধ’ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলেছে, তেমনটি শুরু হয়েছে বা অদূরভবিষ্যতে হবে বলে মনে করার মতো সময় এখনো আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র সে ধরনের তথাকথিত শীতল যুদ্ধ শুরু করলেও, চীন এখনো কিছুই করেনি বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তির সাথে সব দিক থেকে পাল্লা দেয়ার সেই প্রভাব-প্রতিপত্তিও চীনের নেই। চীন এ বার্তা আমেরিকা এবং তাদের মিত্রদের দিতে চাইছে যে, তাদের ওপর খুব বেশি চাপ তৈরি করা হলে তারা বসে থাকবে না। চাপের কাছে বেইজিং আর কখনো নতি স্বীকার করবে না এবং চীনকে খুব বেশি আঘাত করার চেষ্টা করলে আমেরিকা ভুল করবে।”
অবশ্য অদূরভবিষ্যতে দুই পরাশক্তির মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাতের কথা কেউ এখনো বলছেন না। বেইজিংয়ে চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশন-এর ওয়াং হুইয়াও বলছেন, সামরিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কা কম, ‘কিন্তু মুক্তবাণিজ্যের কারণে গত কয়েক দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা হয়তো দেখব, পুরো বিশ্বব্যবস্থা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।’
smmjoy@gmail.com