মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

হামিদ মীর | Jun 02, 2020 09:50 pm
মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য - সংগৃহীত

 

-আপনি কি নসিম হেজাজির উপন্যাস ‘মুহাম্মদ বিন কাসিম’ পড়েননি?

-জ্বী, পড়েছি।

- যদি পড়ে থাকেন, তাহলে এটা কীভাবে লিখলেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স সতেরো বা আঠারো নয়, বরং তার বয়স ছিল আটাশ বছর? আপনি এটাও লিখেছেন যে, পাক-ভারত উপমহাদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম ইসলাম আনেননি, বরং তার আগে সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর যুগে ইসলাম এখানে এসেছে। আমরা শৈশব থেকে স্কুল-কলেজে যা পড়েছি এবং পড়িয়ে আসছি, আপনি তা অস্বীকার করছেন কেন?

-মুহতারাম, একটু থামুন। আপনি তো রেগে আছেন। নসিম হেজাজি তার উপন্যাসে যা কিছু লিখেছেন, ‘তার নির্ভরযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি তিনি দেননি। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে আমার কলামে যা কিছু লিখেছি, তার উদ্ধৃতি পেশ করতে পারব।’

আমার আবেদন শুনে ইসলামাবাদের এক বিখ্যাত কলেজের প্রিন্সিপাল কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন, ‘আমি আপনার নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতি নিজের চোখে দেখতে চাই।’ এই প্রিন্সিপাল সাহেবকে পরের দিন ডাকলাম। তিনি বললেন, ‘না, কাল তো রোববার। বর্তমানে আমাদের ছাত্ররা অনলাইনে ক্লাস করছে। করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিন্তু আপনার কলাম প্রকাশের পর কিছু ছাত্র আমাদের বলেছে, মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে তাদের যা কিছু পড়ানো হয়েছে, আপনি তা নাকচ করে দিয়েছেন। এ জন্য আমার আজকেই নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতি চাই। আমার ছাত্রদের নিশ্চিন্ত করতে চাচ্ছি।’ আমি তৎক্ষণাৎ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টির ‘বাররে সাগীর মেঁ ইসলাম কে আওয়ালীন নুকূশ’ (উপমহাদেশে ইসলামের প্রথম আগমন) গ্রন্থের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট তৈরি করলাম। এরপর তা হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তাকে এ কথাও বলে দিলাম, এ গ্রন্থ ইসলামিক সাংস্কৃতিক দফতর (২ ক্লাব রোড, লাহোর) কর্তৃক ১৯৯০ সালে প্রকাশিত। সুতরাং এ গ্রন্থ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত এবং একটি সরকারি কলেজে আপনি নির্দ্বিধায় এর উদ্ধৃতি দিতে পারেন।

মওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টি এ গ্রন্থ তারিখে ইবনে খালদুন, আবু রায়হান আল বেরুনির কিতাবুল হিন্দ, চাচনামা, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ি এবং আবুল হাসান আহমদ বিন ইয়াহইয়া বালাযুরীর ফুতুহুল বুলদানসহ ৬৩টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন। এ গ্রন্থের তথ্যমতে, উপমহাদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগে ২৫ জন সাহাবি রা: আগমন করেছিলেন। ১২ জন আগমন করেছেন হজরত উমর ফারুক রা:-এর খেলাফতকালে, পাঁচজন আগমন করেছেন হজরত উসমান রা:-এর খেলাফতকালে, তিনজন হজরত আলী রা:-এর খেলাফতকালে, চারজন হজরত মুআবিয়া রা:-এর সময় এবং একজন সাহাবি আগমন করেছেন ইয়াজিদ বিন মুআবিয়ার সময়। মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টি সব সাহাবির নাম উল্লেখ করে তারা ভারতের গুজরাট, মাকরান ও সিন্ধুতে কোথায় কোথায় লড়াই করেছেন এবং কোন কোন এলাকা জয় করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। ভারতে প্রথম হামলাটি হয়েছিল হজরত উমর ফারুক রা:-এর খেলাফতকালে হজরত উসমান বিন আবুল আস সাকাফী রা:-এর নেতৃত্বে, যিনি ওমান ও বাহরাইনের গভর্নর ছিলেন। এটা ছিল প্রথম আরব বাহিনী, যারা নৌবহর নিয়ে মুম্বাইয়ের নিকটবর্তী থানা ও ভারুচের বন্দরগুলো জয় করতে সফল হন। তবে তারা নিজেদের দখল ধরে রাখতে পারেননি। তারা ফিরে চলে গেলেন। এরপর হাকাম বিন আবুল আস সাকাফী রা: পুনরায় থানা, দেবল ও মাকরানে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ভাট্টি তার গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাহিনীও বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

তিনি লিখেছেন, যখন বিন কাশিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে সিন্ধু অভিমুখে রওয়ানা হন, তখন তার বয়স ছিল আটাশ বছর। এর আগের কলামে (নয়া দিগন্তে প্রকাশ বিগত ২৩ মে) মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিষয়ে আলোচনা অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের এক শিক্ষকের ভাষায় উঠে এসেছিল। অধিকৃত কাশ্মিরের শিক্ষকের মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে অত্যন্ত সঠিক তথ্য জানা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানে কোথাও ভুল, কোথাও অসম্পূর্ণ ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে।

আমার কলামে কোথাও মুহাম্মদ বিন কাসিমের ঐতিহাসিক কৃতিত্ব অস্বীকার করিনি। শুধু কিছু ঘটনাকে সংশোধন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যেখানে আমাদের সন্তানদের ইতিহাসের নামে মিথ্যা পড়ানো হয়, সেখানে যারা সত্য বলেন ও লিখেন। তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হচ্ছে। গত কলাম নিয়ে কিছু লোক আপত্তি তুলেছেন যে, নসিম হেজাজি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ‘অল্পবয়সী সেনাপতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাহলে আপনি তাকে আটাশ বছরের বানিয়ে দিলেন কেন? কিছু বন্ধু অভিযোগ করে বললেন, আপনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হিরো কেন বানালেন, কেননা সিন্ধুর আসল হিরো তো রাজা দাহির? সোশ্যাল মিডিয়াতে এ কথাও বলা হলো, যদি রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবের হিরো হতে পারেন, তাহলে রাজা দাহির সিন্ধুর হিরো হতে পারবে না কেন? যদি কেউ রাজা দাহিরকে তার হিরো ভাবে, তা অবশ্যই ভাবতে পারে। কিন্তু শুধু ভাষা, বর্ণ, বংশ ও ধর্মের কারণে হিরো হন না। তিনি তার কৃতিত্বের কারণেই হিরো হিসেবে গণ্য হন। সিন্ধুতে পোর্ট কাসিম থেকে নিয়ে পিএনএস কাসিম এবং বিন কাসিম টাউন থেকে বাগে ইবনে কাসিম পর্যন্ত অনেক স্থান মুহাম্মদ বিন কাসিমের নামের সাথে জড়িত। যদি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কারো কাছে ভালো না লাগে, তার অর্থ এই নয় যে, তিনি সবার কাছেই খারাপ হবেন।

আর এটাও ভালো কথা নয় যে, কেউ রাজা দাহিরকে হিরো বানানোর জন্য রঞ্জিত সিংকে সমস্ত পাঞ্জাববাসীর হিরো বানিয়ে দেবে। হতে পারে, রঞ্জিত সিংও কিছু মানুষের কাছে বেশ প্রিয়, কিন্তু বহু পাঞ্জাবির কাছে হিরো হচ্ছেন দুল্লা ভাট্টি, যাকে শাহেনশাহ আকবর লাহোরে ফাঁসি দিয়েছেন। কেননা তিনি আকবরের দীন-ই-ইলাহীকে মানতেন না। কিছু পাঞ্জাবি রায় আহমদ খান খাড়ালকে তাদের হিরো ভাবে, যিনি ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে লড়াই করতে করতে মারা গেছেন। আর কিছু পাঞ্জাবির হিরো হচ্ছেন ভগত সিং, যাকে ইংরেজরা লাহোরে ফাঁসি দিয়েছে। রঞ্জিত সিং কিছু ভালো কাজ হয়তো করেছেন, তবে তিনি লাহোরের বাদশাহী মসজিদে ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়ে এবং মোতি মসজিদকে মোতি মন্দির বানিয়ে নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। তার সময় জম্মু-কাশ্মিরে যে জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। এ জন্য কাশ্মিরিদের হিরো হচ্ছেন মুজাফ্ফারাবাদের হাকিম রাজা জবরদস্ত খান, যিনি সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ:-এর সাথে একাত্ম হয়ে শিখদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।

কয়েকজন মীর জাফরের বংশ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের নাম জানতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থটি হচ্ছে হুমায়ুন মির্জার ঋৎড়স চষধংংবু ঃড় চধশরংঃধহ। হুমায়ুন মির্জা পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার পুত্র ও সাইয়েদ জাফর আলী খান নাজাফির প্রপৌত্র। তিনি লিখেছেন, সাইয়েদ জাফর আলী খান নাজাফি মূলত নাজাফের গভর্নর সাইয়েদ হুসাইন নাজাফির পৌত্র ছিলেন। তিনি সিরাজুদ্দৌলার বাহিনীর সেনাপতি হয়েছিলেন। ওই মীর জাফরের বংশেরই ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।

নসিম হেজাজির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, তার উপন্যাসে মীর জাফরের আলোচনা তো পাওয়া যায়, কিন্তু মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার ওপর আলোচনা পাওয়া যায় না। কেননা আমরা আমাদের পছন্দের ইতিহাস পড়তে আগ্রহী, যেখানে হিরোও আমাদের পছন্দের, ভিলেনও হয় আমাদের পছন্দমাফিক।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৮ মে,
২০২০ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,

প্রেসিডেন্ট, জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us