ইউরেপের আল-আজহার : যেভাবে গড়ে ওঠেছে ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ
ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ - সংগৃহীত
কেউ কেউ এটিকে ‘ইউরোপের আল-আজহার’ও বলে থাকেন। আবার কেউবা বলেন, ইউরোপে ইসলামিক স্টাডিজের জন্য ‘মডেল ফ্যাকাল্টি’। বলছি পূর্ব ইউরোপ তথা বলকান অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ‘ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ’-এর কথা। ইউরোপে এটিই একমাত্র ইসলামিক স্টাডিজ ফ্যাকাল্টি যা একইভাবে সরকার ও ইসলামিক কমিউনিটির সাথে সম্পৃক্ত।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ১৪৬৩ থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪১৫ বছর তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য কর্তৃক শাসিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ ইসলামী শাসনের ফলে বসনিয়ার সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা ও মানুষের মন-মননে ইসলামের সুগভীর শেকড় প্রোথিত হয়। ১৮৭৮ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য শাসনক্ষমতা লাভ করে। ফলে ইসলামী শিক্ষার ধারাবাহিকতা কিছুটা ব্যাহত হয়। তবে শরিয়াহ কোর্ট তখনো চালু থাকায় ‘কাজী’দের (বিচারক) প্রশিক্ষণের জন্য ১৮৮৭ সালের ১৪ মে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যার নাম দেয়া হয়- ‘মেকতেব-ই-নুওয়াব’ কলেজটিতে তখন পাঁচ বছরের কোর্স ছিল। উসমানী আমলের জঁংযফরুুধ তথা বিশেষায়িত গ্রামার স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করলেই ওই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যেত। সে সময়ে ফ্যাকাল্টিতে ইসলামী আইনের পাশাপাশি প্রথাগত ইসলামী শিক্ষা দেয়া হতো। তখন যে বিষয়গুলোতে শিক্ষাদান করা হতো সেগুলো হচ্ছে- তাফসির, হাদিস, আরবি ব্যাকরণ, যুক্তিবিদ্যা (মানতিক), উসুলুল ফিকহ, ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি। বেশির ভাগ পাঠ্যবই ছিল উসমানী আমলে ব্যবহৃত ক্লাসিক্যাল ইসলামী বই। সেক্যুলার বিষয়েও পাঠদান করা হতো। যেমন- রাষ্ট্রীয় আইন ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সংবিধান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সাংগঠনিক গঠন, অপরাধ আইন, বসনীয় ভাষা, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষা। ফ্যাকাল্টির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধান করত অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সরকার এবং সাধারণ দেখাশোনা ও শিক্ষাদান সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল করতেন বসনিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি (জধরং-ঁষ-টষধসধ)। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, সরকার ও গ্র্যান্ড মুফতির মধ্যে পরস্পর সহযোগিতার অন্যতম দিক ছিল- কেবল তার সুপারিশকৃত ছাত্রদেরকেই সরকার ওই ফ্যাকাল্টিতে গ্রহণ করত।
উসমানী খিলাফত থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর থেকেই বসনীয় শিক্ষিত মুসলিম চিন্তাশীলরা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি ও ইসলামী শিক্ষার স্বতন্ত্র অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিলেন। অবশেষে ১৯০৯ সালের ১৫ এপ্রিল ‘হেবসবার্গ সম্রাট’ বসনীয় মুসলিমদের ধর্মীয় ও শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন অনুমোদন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৮ সালে বসনীয়রা একটি উচ্চতর ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর ব্যাপারে চিন্তা করে। তাদের এ চিন্তা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৩৫ সালে এবং ১৯৩৭ সালে চূড়ান্তভাবে নতুন পাঠক্রমের আলোকে সেখানে পাঠদান শুরু হয়। যুগোসøাভিয়া সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ডিক্রির মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয় ‘হায়ার স্কুল ফর ইসলামিক শরিয়াহ অ্যান্ড থিওলজি’। অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে মেকতেব-ই-নুওয়াব প্রতিষ্ঠার অর্ধশতক পরে এটি ইসলামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ সময় পাঠ্যসূচিতে নতুন করে ইবাদাহ, উসুল, আকাইদ, ইলমুল কালাম, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী দর্শন, ইসলামী শিক্ষাপদ্ধতি, আরবি, তুর্কি ও ফার্সি ভাষা, সেক্যুলার আইন, রোমান আইন, ব্যক্তিগত আইন, সøাভিক আইনের ইতিহাস, প্রশাসনিক আইন যুক্ত করা হয়। কোর্সের মেয়াদ চার বছর করা হয়, যেটি আজকের স্নাতক সমমানের। নতুন প্রতিষ্ঠানটি থেকে কেবল শরিয়াহ আদালতের জন্য বিচারকই তৈরি হচ্ছিলেন না বরং, অসংখ্য মেধাবী মুসলিম বুদ্ধিজীবী তৈরি করতেও ভূমিকা পালন করেছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই কমিউনিস্ট সরকার বসনিয়ার শরিয়াহ কোর্ট ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সরকারের অনুমোদিত ইসলামিক কমিউনিটির স্বায়ত্তশাসনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং স্বাভাবিকভাবেই ওই প্রতিষ্ঠানটিকেও বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩২ বছর বসনিয়ায় কোনো ইসলামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই চালু ছিল না।
যুগোসøাভিয়ার শাসন কিছুটা নমনীয় হলে বসনীয় মুসলিমরা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, ১৯৭৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘ইসলামিক থিওলজি ফ্যাকাল্টি’ প্রতিষ্ঠা করে। যেহেতু ইতোমধ্যে শরিয়াহ কোর্ট বিলুপ্ত হয়েছে সুতরাং, ইমাম ও খতিব তৈরির উদ্দেশ্যে ফ্যাকাল্টি তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। যুগোসøাভিয়া ভেঙে গেলে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মতো বসনীয়রাও স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ফ্যাকাল্টির নামকরণ করা হয় ‘ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ’। ইসলামিক থিওলজির পাশাপাশি ১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে ‘রিলিজিয়াস পেডাগজি’কে (ধর্মীয় শিক্ষাবিজ্ঞান) পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনুষদটিতে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়।
বর্তমানে অনুষদে তিনটি বিভাগ চালু রয়েছে- থিওলজি, পেডাগজি ও ইমাম ট্রেনিং। ২০০৬ সালে ইমাম ট্রেনিং নামে স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হয়। একই বছর থেকে ‘ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্টাডিজ’ নামে তিন মাস মেয়াদি একটি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করে। ২০০৪ সালে অনুষদটি ইউনিভার্সিটি অব সারায়েভোর পূর্ণাঙ্গ সদস্যের মর্যাদা লাভ করে।
১৭ জন ডক্টরেট ও ১০ জন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষকসহ প্রায় ৪০ জন স্টাফ নিয়ে অনুষদটি শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেশির ভাগ প্রফেসরই অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, আল-আজহার, ওওটগ-সহ পৃথিবীর নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। সাবেক ডিন প্রফেসর ড. এনেস কারিচ ইউরোপের অন্যতম সেরা ইসলামী শিক্ষাবিদ। তিনি অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, আল-আজহার, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও সার্বিয়ার বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। আমেরিকা, তুরস্ক, নরওয়েসহ পৃথিবীর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বসনিয়ার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অনুষদের ভিজিটিং প্রফেসর ড. ফিকরেত কারচিচ আমেরিকা, তুরস্ক, নরওয়েসহ কেবল মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ভাইস ডিন প্রফেসর ড. আহমেত আলী বাসিচ মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ‘ইউরোপিয়ান মুসলিম নেটওয়ার্ক’ এর সদস্য ও বলকানের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ। অনুষদের হাদিসের প্রফেসর ড. কেনান মুজিচ আল-আজহার ও দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এবং দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। প্রফেসর কেনান সারায়েভো শহরের প্রধান ইমাম। প্রফেসর আসিম জুবজেভিচ ভারতের আলীগড় এবং অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। অনুষদটির বর্তমান ডিন প্রফেসর ড. জুহদিয়া হাসানোভিচ।
বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময় বিখ্যাত শিক্ষাবিদরা ফ্যাকাল্টি পরিদর্শনে এসেছেন। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সেরা দার্শনিক, প্রফেসর ড. সাইয়েদ হুসেইন নাসর, ইউরোপের অন্যতম ইসলামী চিন্তক ড. মুরাদ হফম্যান, সাবেক তুর্কি প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষাবিদ ড. আহমেত দাউতুগ্লু, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা তাকী উসমানী, বিখ্যাত লেবাননী লেখক সাকিব আরসালান, ড. জাসের আওদা, ড. অলিভার রয়, ড. জন আসপসিতো, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ও প্রভাবশালী ইসলামী চিন্তাবিদ ড. তারিক রামাদান, তুরস্কের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ প্রফেসর মেহমেত গরমেজ, ইবনে খালদুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আবদুল্লাহিল আহসান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রীরা ফ্যাকাল্টিতে বিভিন্ন উপলক্ষে আগমন করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বিত শিক্ষা কাঠামোর ‘ইরাসমাস’ আওতায় তুরস্ক, জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অনুষদটির ইরাসমাস এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম (শিক্ষার্থী বিনিময় চুক্তি) রয়েছে। ফলে প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসে এবং এখান থেকেও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশে যায়।
অনুষদটির বেশির ভাগ প্রফেসর বিভিন্ন দেশের একাডেমিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে অনুষদের পাঠ্যসূচিকেও আল-আজহার, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইইউএম এবং অন্যান্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের আলোকে সাজানো হয়েছে। ফলে এটি ইউরোপের অন্যতম সেরা ইসলামী শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর রমজানে ফ্যাকাল্টির শতাধিক ছাত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসনীয় মুসলিম কমিউনিটিতে তারাবিহ পড়ানো এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য যায়। বসনিয়ার ‘ইসলামিক কমিউনিটি’ তাদের যাতায়াত খরচসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে। ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে অনুষদটি বসনিয়া তথা বলকানের মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচিতি ও চেতনা ধরে রাখা এবং ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
লেখক : স্নাতকোত্তর গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ : ইসলাম ইন ইউরোপ, ইউনিভার্সিটি অব সারায়েভো, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা