যে পথে এসেছে করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস - সংগৃহীত
এখন বিশ্বজুড়ে চলছে করোনার লকডাউন। এরই মধ্যে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের ৬০ লাখের বেশি মানুষ এ ভয়ঙ্কর ভাইরাস সংক্রমণের শিকার। এর শিকার হয়ে মারা গেছে ৩৬ লাখেরও বেশি। তা ছাড়া এই লকডাউন এরই মধ্যে মানবসমাজকে এক ধরনের অস্তিত্ব-সঙ্কটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। বলতে গেলে, বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতিই এখন বিপর্যস্ত। এই লকডাউন এভাবে চলতে থাকলে, নিশ্চিতভাবে আরো লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে, অর্থনীতি আরো ভেঙে পড়বে। বিশ্বজুড়ে তখন সৃষ্টি হবে এক অভাবনীয় মানবিক সঙ্কট।
প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কী করে আজকের এই পরিস্থিতিতে পৌঁছলাম? এমনটি কি হওয়ার কথা ছিল? করোনার আসাটা কি অপরিহার্য ছিল? যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চীন পরাশক্তি হয়ে ওঠার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাদের ল্যাবরেটরি থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। এই দাবি কি সঠিক? চীন বলছে, চীনকে দুর্বলতর করার জন্য অলিম্পিক গেমের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে- এই দাবি কি সঠিক? কিংবা এর পেছনে কি রয়েছে অন্য কোনো কার্যকারণ? এসব প্রশ্ন খতিয়ে দেখা দরকার। আসলে এর পেছনে রয়েছে বড় ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতি। এই অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক অর্থনীতিটা সাধারণ মানুষের উপলব্ধির বাইরেই থেকে যায়।
এ সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কী বলে? ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ কোভিড-১৯-এর জিন-কাঠামো নিয়ে গবেষণা করে প্রমাণ করেছে, করোনাভাইরাস ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। অতএব এর উদ্ভব ঘটেছে নিজে নিজে, প্রাকৃতিক রূপান্তর বা মিউটেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ এই ভাইরাস সৃষ্টির পেছনে কোনো দেশেরই হাত ছিল না। এটি নতুন ধরনের একটি ভাইরাস পরিবার, সার্স ভাইরাসও একই ‘পরিবার’ভুক্ত। এ ভাইরাসটি হচ্ছে ঈড়ারফ-১৯ ঝঅজঝ-২। সার্স ভাইরাসও ২০০৩-২০০৪ সালে বিশ্বে একই ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।
এবারের করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের উহান প্রদেশ থেকে। তবে সুপরিচিত মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যান্সেট’ জানিয়েছে, ৪৩ জন করোনা রোগীর মধ্যে ১৩ জন রোগী ছিল উহান প্রদেশের বাইরের এবং এদের সাথে উহানের কোনো করোনা রোগীর সংস্পর্শ ছিল না। কিংবা সেখানকার ‘ওয়েট’ মার্কেটের সাথেও তাদের কোনো যোগসূত্র ছিল না। উহানের ওয়েট মার্কেট হচ্ছে একটি স্থানীয় ছোট মাছ বাজার। অনেক গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে- উহানের এই ওয়েট মার্কেট থেকেই বিশ্বব্যাপী এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ওয়েট মার্কেটের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, মিউটেশনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ ও এর জিন-কাঠামোর যেভাবে উদ্ভব ঘটেছে, তার জন্য প্রয়োজন প্রাণীদের ঘনবসতি। আর একমাত্র সম্ভাব্য স্থান হচ্ছে, যেখানে শিল্প উৎপাদন হিসেবে পশু উৎপাদন চলে এবং উৎপাদনের পর এগুলোকে একসাথে রাখা হয়। মুরগি ও শূকরের খামারে ঠিক এভাবেই এ কাজটি চলে। গবেষণা সূত্রে বলা হয়েছে, যেহেতু শূকরের ও মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি, তাই এই ‘কোভিড-১৯’ মানবদেহে এসেছে শূকরের মাধ্যমে।
সুপরিচিত ওয়েবসাইট মৎধরহ.ড়ৎম এ বিষয়টি নিয়েই কাজ করেছে। ওয়েবসাইটটিতে দাবি করা হয়েছে, করোনার এই প্রাদুর্ভাব-সময়ে অপপ্রচার চালানোর কারণ হলো, ওয়েট মার্কেট বন্ধ করে দেয়ার এক ‘ষড়যন্ত্র’। কারণ, এই ওয়েট মার্কেটে গরিব মানুষ কম দামে মাছ ও গোশত কেনার সুযোগ পায়। আর এই বাজার চালায় লাখ লাখ গরিব মানুষ। এই মার্কেটের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভর করে। এই গরিব মানুষ হচ্ছে তারা, যাদের সমবায় সমিতি ও কমিউনগুলো ভেঙে দেয়া হয় এবং তাদের জমি সরকার নিয়ে গেছে সমাজতন্ত্রের পতনের পর। তখন গোশত শিল্পকারখানাসহ বহু ধরনের কলকারখানা ও কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অতএব এটি সহজবোধ্য, এই ওয়েট মার্কেট বন্ধ হলে এসব শিল্পকারখানার সম্প্রসারণ ঘটবে।
এর আগে ২০০৩-২০০৪ সালে করোনা ফ্যামিলির আরেক ভাইরাস সার্সও বিশ্বে বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সেই ভাইরাস শুধু প্রাণী থেকেই মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছিল। এরও আগে ঝরিহব ভষঁ (ঐ১ঘ১)-এর কারণেও বিশ্বে বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিল ১২০০-এর বেশি মানুষ। এর উদ্ভব ঘটেছিল মেক্সিকোয়। প্রথম দিকে একে বলা হতো ‘মেক্সিকান ফ্লু’। যেমন আজকের দিনের করোনাভাইরাসকে কেউ কেউ অভিহিত করেন ‘চাইনিজ করোনা’ নামে। সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ মানবদেহে ছড়িয়েছিল শিল্পকারখানায় উৎপাদিত শূকর থেকে। মেক্সিকোর কারখানায় উৎপাদিত শূকর থেকে এর উদ্ভব ঘটেছিল। শূকরের গোশত উৎপাদক এ কারখানাটির নাম ‘স্মিথ ফিল্ড ফুড কোম্পানি’। এই আমেরিকান কোম্পানি শূকরের গোশত উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিক থেকে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। এই কোম্পানির বিভিন্ন কারখানায় প্রতি বছর দুই কোটি ৮০ লাখ শূকর জবাই করে এগুলোর গোশত প্রক্রিয়াজাত করে লবণ মেশানো ঝলসানো রান কিংবা লবণজারিত গোশত আকারে বিশ্বব্যাপী রফতানি করা হয়। এর প্রধান প্রধান ক্রেতা-কোম্পানি হচ্ছে ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি ইত্যাদি।
তাছাড়া সস্তায় শ্রম শোষণের জন্য অ্যাপল, পেপসি, নাইক, জেনারেল মোটর ইত্যাদির মতো আরো অনেক আমেরিকান কোম্পানি চীনে বড় বড় কারখানা স্থাপন করেছে। স্মিথফিল্ড ফুড কোম্পানিরও একটি বড় কারখানা রয়েছে চীনে। ডেনমার্কের কোম্পানি ‘ড্যানিশ ক্রাউন’ শূকরের গোশত উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। এ ক্ষেত্রে জার্মানির ‘টনি’ কোম্পানির স্থান সপ্তম। এ সবগুলোরই বড় আকারের কারখানা রয়েছে চীনে। এখান থেকে শূকরের গোশত সরবরাহ করা হয় চীনসহ বিশ্ববাজারে। এই প্রতিযোগিতায় চীনও রয়েছে। ২০০৮ সালের মন্দার পর বিশ্বের বৃহত্তম বিনিয়োগ কোম্পানি ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্যে ৩০ কোটি ডলার দিয়ে কিনে নেয় ১০টি চীনা মুরগির খামার। এর বাইরে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে চীনের শূকরের গোশত উৎপাদক কোম্পানিতে। এ ছাড়া সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে আরেকটি বড় আমেরিকান কোম্পানি ‘ওএসআই’ নিয়ে। এই কোম্পানি প্রধানত প্রক্রিয়াজাত করে থাকে মুরগির গোশত। এর ১০টি বড় কারখানা রয়েছে চীনে। এটি ম্যাকডোনাল্ড এবং কেএফসিসহ অন্যান্য আমেরিকান কোম্পানির মাধ্যমে চীনসহ বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন ধরনের গোশতও সরবরাহ করে আসছে। অভিযোগ উঠেছে, এটি চীনের বাজারে সরবরাহ করেছে পচা গোশত। এর ফলে চীন এ কোম্পানির বড় অঙ্কের জরিমানা করে এবং এর ১০ জনকে জেলেও পাঠায়। এখন এই করোনা সঙ্কট এবং চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বৈরী-সম্পর্ক বিশ্বের সাড়ে ৯৪ হাজার কোটি টাকার বিশ্ব গোশত-বাজার এক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
লেখক আপটন সিনক্লেয়ার ১৯০৬ সালে প্রকাশ করেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘জাঙ্গল’। এতে তিনি আমেরিকার তৎকালীন গোশত-শিল্পের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, এখানে শুধু শূকরের আর্তনাদ ছাড়া আর সবকিছুই বিক্রি হয়। এরপর আরো এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আজকের দিনে জুতা, পোশাক যেমন তৈরি হচ্ছে শিল্পকারখানায়, তেমনি শূকর, মুরগি ইত্যাদির মতো জীবন্ত প্রাণীও উৎপাদিত হচ্ছে কারখানায়।
এগুলো উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও জিন-প্রকৌশল প্রয়োগ করে। সব ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয় এদের উৎপাদন ও বেড়ে ওঠা ত্বরান্বিত করার জন্য। কারণ, এগুলো যত দেরিতে বেড়ে উঠবে, খরচও তত বেড়ে যাবে। একইভাবে, খরচ কমানোর জন্য এগুলো কম জায়গায় গাদাগাদি করে রাখা হয়। এমনকি এগুলো নড়াচড়া করার সুযোগও পায় না। পুঁজিবাদীদের যুক্তি অনুসারে, খরচ কমানোর জন্য এগুলোর জিন-কাঠামোও অব্যাহতভাবে পরিবর্তন করা হয়। উদাহরণত- মুরগির পাখা ছাড়ানো কারখানা মালিকদের বাড়তি ঝামেলা। এতে বাড়তি শ্রম ও অর্থ খরচ করতে হয়। এর ফলে এগুলোর জিনে এমন পরিবর্তন আনা হয়, যাতে পাখা গজায় অপেক্ষাকৃত কম। একইভাবে সব মুরগির পা, রান ও দেহের অন্যান্য অংশ যেন একই আকারের হয়, তার জন্য জিন-কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়। এগুলো ছোট-বড় হলে আবার ওজনের ঝামেলা থাকে। শূকরের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
এভাবে শিল্পকারখানায় উৎপাদিত প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশ বেঁচে থাকতে পারে না। যেমন পাখা ছাড়া মুরগি শুধু একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। তাই এগুলোর জন্য প্রয়োজন কৃত্রিম পরিবেশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই প্রক্রিয়ায় কী ঘটে? এ প্রক্রিয়ায় এসব প্রাণী রোগ প্রতিরোধ বা সংক্রমণ ক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। এখানে ডারউইনের কথিত ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর প্রয়োগ হয় না; বরং এর জায়গায় প্রয়োগ হয় ‘ক্যাপিটালিস্ট সিলেকশন’। এ পরিস্থিতিতে করোনার মতো ভাইরাস যখন এসব প্রাণীর দেহের সংস্পর্শে আসে, তখন এগুলোর মাধ্যমে এই ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। আর যেহেতু এসব প্রাণী একসাথে গাদাগাদি করে থাকে, তাই এগুলো এ ভাইরাস ছড়ায় দ্রুত। অপর দিকে, যখন এসব প্রাণী প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তখন এগুলোর রোগ বা সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে প্রবল। ফলে এগুলোর সংস্পর্শে যখন কোনো ভাইরাস আসে, তখন এগুলোর মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণ ও ছড়িয়ে পড়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ভাইরাসের সামনে বাধার নানা দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়। তখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রাণী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এর বদলে যখন বাজারের চাপে এসব প্রাণী শিল্পকারখানায় উৎপাদিত হয়, ভাইরাস তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য পেয়ে যায় এক ‘রেড কার্পেট’। এসব শিল্পকারখানায় কর্মরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে। আর বিশ্বায়নের যুগে শেষ পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা এসব প্রাণীর সংস্পর্শে থাকে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা। অতএব আজকের করোনাভাইরাস ও সার্স, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, জাইকা, এমইআর ইত্যাদির মতো ভাইরাসের সাথে গোশত উৎপাদক শিল্পকারখানার সংশ্লিষ্টতা এখন সুস্পষ্ট।
প্রাণিবিজ্ঞানী রব ওয়ালেস ‘বিগ ফার্মস মেইক বিগ ফ্লু’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘ভাইরাস কেন আগের চেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে- যদি কেউ তা জানতে চায়, তবে তাকে খতিয়ে দেখতে হবে কৃষিশিল্পের মডেল, বিশেষত শিল্পকারখানায় পশুপ্রাণী উৎপাদনের বিষয়টি। এক কথায় বলতে গেলে তাকে বুঝতে হবে ক্যাপিটালিজম।’ রব ওয়ালেস অন্যত্র বলেছেন, এসব কোম্পানি শুধু গোশতই উৎপাদন করে না, বরং একই সাথে ভাইরাসেরও চাষ করে; যা ভয়াবহ রোগের কারণ। প্রায় একই পরিস্থিতি বিদ্যমান কৃষিক্ষেত্রেও। আসলে গাছ-গাছড়ার সরল জিন-কাঠামোতে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় জিন টেকনোলজি। তা ছাড়া, যেভাবে কীটনাশক ও আগাছানাশক রাসায়নিক কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা শুধু পৃথিবীর তাপমাত্রাই বাড়িয়ে তুলছে না, সেই সাথে এর পরিবেশগত ভারসাম্যকে ভয়াবহভাবে বিনাশ করছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদিত শূকরকে সয়াবিন আটা খেতে দেয়া হয়। আজ আমাজন বন ধ্বংস করা হচ্ছে এই সয়াবিন চাষের জমির জন্য। এতে শুধু পরিবেশের ক্ষতিই হচ্ছে না, সেখানে থাকা ভাইরাস আজ মানবদেহের সংস্পর্শে আসছে। আগে সে সুযোগ ছিল না। এগুলো বনের মধ্যেই থেকে যেত। প্রকৃতির জটিল গঠন কাঠামোর কারণেই এসব ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা মতে, যেভাবে আমাজন বন ধ্বংস করা হচ্ছে, এর ফলে আগামী দেড় দশকের মধ্যে আমাজনের এই কার্বনশোষক এলাকাটি পরিণত হবে একটি কার্বন-নির্গতকরণ এলাকায়। পুঁজিবাদীদের অর্থলিপ্সার কারণে আমরা আজ প্রকৃতির জটিল কাঠামো বিনাশ করে ভাইরাসের উন্মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র করে তুলছি আমাদের পুরো পৃথিবীকে।
অবাক করা বিষয়, বীজ ও কীটনাশক উৎপাদক বেশির ভাগ কোম্পানি আজকে উৎপাদন করছে এমন সব বিষাক্ত গ্যাস, যা ব্যবহার করা হয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ ভিয়েতনাম যুদ্ধে। ডুপোঁ, মনসান্তো, ডাউ কেমিক্যালসের কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলোকে বিষাক্ত গ্যাস সরবরাহ করেছিল, তা সবারই জানা। কীটনাশক খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বেয়ার বিষাক্ত গ্যাস সরবরাহ করে আসছিল হিটলারকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ডাউ কেমিক্যালস ও মনসান্তো যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ করেছিল কুখ্যাত ‘অ্যাজেন্ট অরেঞ্জ’ ও ‘নাপাম বোমা’। আজকের দিনে এসব কোম্পানি কীটনাশকের আকারে একই ধরনের বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছে পরিবেশে। কৃষিবিজ্ঞানী দেবিন্দর শর্মা বলেছেন, ৯৯.৯ শতাংশ কীটনাশক সরাসরি পরিবেশে গিয়ে মিশে এবং .১ শতাংশ তাদের লক্ষ্য পূরণ করে। এসব কীটনাশক মানববান্ধব ব্যাকটেরিয়া এবং উপকারী কীটপতঙ্গ ও প্রাণী ধ্বংস করে দেয়। এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে ক্যান্সার রোগী বেড়ে যাওয়ার বিষয়ও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১-২০১৮ সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করেছে ১৪৮৩টি মহামারী। এগুলো আঘাত হেনেছিল ১৭২টি দেশে। এসব ভাইরাসের (প্রধানত সার্স, মার্স, ইবোলা, জাইকা, প্লেগ, পীতজ্বর) ওপর সমীক্ষা চালিয়ে জিপিএমবি (গ্লোবাল প্রিপেয়ার্ডনেস মনিটরিং বোর্ড) কোভিড-১৯ সম্পর্কে সঠিক সতর্কবার্তা দিয়েছিল ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড অ্যাট রিস্ক’ শীর্ষক রিপোর্টের মাধ্যমে। কিন্তু কেউই এই রিপোর্ট আমলে নেয়নি। এমনকি, এর আগে ২০০৩-২০০৪ সময়ের সার্চ ভাইরাস সম্পর্কেও বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিন বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশকে বলেছিল, ভাইরাসবিশেষ বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য প্রতিটি দেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা? আজ এই করোনা ভাইরাসের সময়ে জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরের ব্যাপক অভাবের কথা শুনি, অথচ আমাদের হাতে রয়েছে এমন সব মারণাস্ত্র, যা দিয়ে এই পৃথিবীকে অন্তত ৯ বার ধ্বংস করা যাবে। এটাই আমাদের চরম দুর্ভাগ্য।