ভারতকে টার্গেট করে চীনা প্রেসিডেন্টের ৩ যুদ্ধবার্তা!
ভারতকে টার্গেট করে চীনা প্রেসিডেন্টের ৩ যুদ্ধবার্তা! - সংগৃহীত
এই মুহূর্তের দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তেজনাকর, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস ইস্যুকে ছাড়িয়ে উত্তেজনাকর- এমন খবর হলো, লাদাখে চীন ও ভারতের মুখোমুখি সৈন্যসমাবেশ, গায়ে হাত না লাগিয়ে ধাক্কাধাক্কি ইত্যাদি। তা একটা নদীর দু’পারে বিমানবাহিনীর সমাবেশ ঘটানো পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার ভিডিও ক্লিপে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব দেখার পরে যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে কি না, এ নিয়ে যাদের এর পরও বিশ্বাস হয়নি; তাদেরও নাড়িয়ে দেয়া ঘটনাটা হলো চীনা প্রেসিডেন্টের ২৬ মে’র এক বিবৃতি। এটা মূলত অভ্যন্তরীণভাবে চীনা সেনাবাহিনী পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মিকে উদ্দেশ করে দেয়া তার নির্দেশ।
সেখানে তিনি বলেন- ১. ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে যেতে পারো তোমরা, এটা ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নাও। ২. যুদ্ধপ্রস্তুতির ধাপ উপরে তুলো। ৩. নির্ধারকভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার প্রস্তুতি নাও ইত্যাদি ধরনের ‘সৈনিকদের উত্তেজিত করা’ বক্তব্য তিনি ব্যবহার করেছেন। হংকং থেকে প্রকাশিত এশিয়াটাইমস-এর ভাষায়, এটা ‘চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতিবেশী ভারতকে লক্ষ্য করে বলতে সচরাচর দেখা যায় না এমন যুদ্ধবার্তা।
পুরাতন বিরোধ কিন্তু এখন কী করে তা বাইরে
গত সত্তর বছরের ইতিহাসে চীন-ভারত বিরোধ প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়া প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালের মার্চে। মূল ঘটনাটা ছিল চীনের অভ্যন্তরীণ; চীনা কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার ভারতে চলে আসাকে কেন্দ্র করে। মাও সে তুংয়ের চীনা বিপ্লব ও ক্ষমতা দখল সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৪৯ সালে।
তিব্বতে এর আগে থেকেই চালু ছিল তিব্বতীয় লামাদের শুধু ধর্মচর্চাই নয়, এর সাথে তাদের নেতৃত্বে স্থানীয় এক ধর্মীয়-কমিউনিটি প্রশাসনব্যবস্থা। চীনা বিপ্লবের পরে এ ধরনের বিশেষ স্থানীয় ক্ষমতা পার্টির সাথে কোনো প্রত্যক্ষ বিরোধ এড়িয়ে চলে টিকে গিয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫৮ সালে তাদের নতুন এক সংস্কার ক্ষমতার নতুন পর্যায় শুরু করেছিল। বলা যায়, মাও নিজেই পুরান মাও আর নতুন মাও বলে দুই তত্ত্বীয় অবস্থানে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। বিরোধ শুরু হয়েছিল মাওয়ের পুরান অবস্থানের সমর্থকের বিরুদ্ধে মাওয়েরই নতুন অবস্থানের সমর্থকদের মধ্যে। পুরান অবস্থানের লোকেরা ‘বুর্জোয়া হয়ে গেছে’ বলে তাদের বিরুদ্ধেই এক ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ করতে আহ্বান রেখেছিলেন মাও। এটাই পার্টির ভেতরে ১৯৫৮ সালে তার ভাষায় চীনা ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। সে সময়ের নতুন মাওয়ের অবস্থানই শেষে জিতেছে, সেটাই আজকের যে চীন আমরা দেখছি, তা। দলের নতুন সমর্থক, নতুন ধারার রাজনীতিকে হাজির এবং প্রধান ধারা করতে ঢেলে সাজানোর কাজটা তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামের আড়ালে শুরু করিয়ে নিয়েছিলেন। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে কোনো বাগড়া-হামলা হতে পারে, এই ভয়ে তিনি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আগেই ছিন্ন করে দিয়েছিলেন; ফতোয়া দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নও এক ‘সাম্রাজ্যবাদী’ রাষ্ট্র। তবে ওরা কমিউনিস্ট বলে সাথে আরো একটা নতুন বিশেষণ যোগ করে বলেছিলেন, তারা ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আমলে ১৯৫৯ সালে এসে তিব্বতে এবার আর মাওয়ের নতুন লাইনের পার্টি-নেতৃত্ব আর স্থানীয় ধর্মীয়-ক্ষমতা-প্রশাসন সহ্য করতে চাইল না বা পারল না। এতেই ধর্মীয় নেতা আমরা যাকে ‘দালাই লামা’ বলে জানি, তিনি ১৪তম দালাই লামা হিসেবে। পার্টির বিরুদ্ধে লামাদের প্রতিবাদ আন্দোলন পার্টি গুঁড়িয়ে দিতে এলে, চীনা হামলা থেকে রক্ষা পেতে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন ৩০ মার্চ ১৯৫৯ সালে। তিনি আসামের দিশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ঘটনা শুধু এতটা সীমাবদ্ধ থাকলে আজ বহু কিছুই হয়তো অন্য রকম থাকত। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাতে আরো অনেক বড় বড় ‘মোচড়’ ছিল।
প্রথম ‘মোচড়’ হলেন জেনারেল আইসেনহাওয়ার, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকা-রাশিয়া-ইংল্যান্ড ইত্যাদির ‘মিত্রশক্তির’ সামরিক জোটের প্রধান কমান্ডার ছিলেন। তিনিই বিশ্বযুদ্ধ জয়ের শেষের দিকে- পরের দুই টার্ম ১৯৪৪ আর ১৯৪৮ সালের আমেরিকান নির্বাচনেরও পরেরবার, ১৯৫২ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থী হন আর শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান। শপথ নেন ২০ জানুয়ারি ১৯৫৩ সালে। আর তিনিই হলেন ১৯৩২ সালের পর থেকে আমেরিকায় একনাগাড়ে পাঁচবার ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের পরে ষষ্ঠবারে এসে প্রথম রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।
শুধু তাই নয়, আরো বড় ঘটনা আছে। কমিউনিস্টরা তো আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে। আবার তা দেখে একালে ইসলামিস্ট কেউ কেউও রাগে ক্ষোভে সে আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে। কিন্তু আমরা কি জানি, কমিউনিস্টরা কবে থেকে আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলেছে? এর জবাব খুব কম কমিউনিস্টই জানে অথবা বলা যায় জানে কি না বলে বাজি রাখা যায়। নিশ্চয়ই বিশ্বযুদ্ধে তারা যখন কাঁধে কাঁধ মিলানো মিত্রশক্তি, তখন স্টালিন আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদ বলতেন না। ঘটনাটা হলো আসলে আইসেনহাওয়ারের আমল থেকেই, রাশিয়া ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটা বলা শুরু করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, তিনিই জাতিসঙ্ঘ আইডিয়ার জন্মদাতা।
কিন্তু এই প্রথম আইসেনহাওয়ারের হাতে এসে সেই আমেরিকাতেই বড় রকমের নির্ধারক ঘটে যায়। আইসেনহাওয়ার ১৯৫৩ সালে শপথ নেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে প্রথম একদল সিআইএ অপারেটিভ এজেন্ট পাঠিয়ে ইরানে প্রধানমন্ত্রী ডা: মোসাদ্দেককে খুন করেন, সরকার ফেলে দিয়ে শাহের হাতে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা আবার চালু করেন। ইরানি তেলের খনি ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ আর আমেরিকান কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে নিতে তিনি এ কাজ করেছিলেন। অথচ রুজভেল্ট বলেছিলেন ও কল্পনা করতেন যুদ্ধপরবর্তীকালে কলোনিমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের এক দুনিয়া গড়তে হবে, যেখানে ওই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমেরিকার বিনিয়োগকারীদের সম্পর্ক হবে ঋণদাতা-খাতকের, পণ্য বিনিময় সম্পর্কের। সেখানে এর ১২ বছরের মধ্যে আইসেনহাওয়ার বলতে চাইলেন, তিনি ইরানের সাথে সিআইএ অপারেটিভ পাঠানোর সম্পর্ক করবেন। এমন দুনিয়াই গড়বেন।’ চাইলেই তিনি সিআইএ পাঠাইতেই পারেন, গুম-হত্যা করতেই পারেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়, শুরু। কিন্তু সাবধান, এতদূর পড়েই কমিউনিস্টদের সাধুবাদ জানাতে যান না। কারণ, কেউ কম যায়নি। এ দিকে সোভিয়েতরা ইরানের তেলের কিছুই না পেয়ে (তারা চেয়েছিল ব্রিটিশের বদলে তাদের দিয়ে জ্বালানি তেল তোলা হোক) প্রতিপক্ষ আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে গালি দেয়ার শুরু তখন থেকে, এতে মনের দুঃখ মিটিয়েছে। কিন্তু ইরানে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়নি এ জন্যই। খোমেনির বিপ্লব বিনা কারণে হয়নি। ইরানি বিপ্লব আমাদের দুনিয়ায় ঐতিহাসিক ঘটনা। একটা লোকাল বিপ্লব, খোমেনির ক্যাসেট বিপ্লব অথচ এর তাৎপর্য গ্লোবাল। আর সেই থেকে দুনিয়া এমনি এমনি ‘ওয়ার অন টেররের’ নোংরামি পর্যন্ত আসেনি। তাই ধীরেসুস্থ বুঝেশুনে পরে যাকে খুশি সাধুবাদ দেবেন। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু দালাই লামার গল্পে কেন এত দূর এলাম?
কারণ দালাই লামাকে আসামের দিশপুর দিয়ে ‘হিজরত’ করিয়ে আনছিল সিআইএ’র কিছু অপারেটিভ এজেন্ট। অর্থাৎ সিআইএ পাঠানো আর তা অস্বীকার করা তখন আইসেনহাওয়ারের কাছে ডাল-ভাত হয়ে গেছে। এর মানে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরু শুধু দালাই লামার আশ্রয়দাতাই ছিলেন না, এশিয়ায় এই অঞ্চলে আইসেনহাওয়ারের সহযোগী হয়ে সিআইএ অপারেটিভ এজেন্টের আনাগোনা আর আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তেলের খনির মতো এখানেও যা যা লাভ আসে এর বখরা পেতেও নেহরু মহা আগ্রহী ছিলেন বলে দেখা যাচ্ছে। সিআইএ’র কিছু অপারেটিভের সহায়তায় যে দালাই লামা এসেছিলেন, এ তথ্য পাওয়া খুব সহজ নয়। অথচ ভারতের কূটনীতিকপাড়ার আলোচনায় মুখে মুখে এটা খুবই চালু। ভারতীয় চীনপন্থী কমিউনিস্টদের মহলেও খুবই চালু তথ্য এটা। তবু ভারতে একাডেমিক সার্কেলে পাওয়া মুশকিল, দেশদ্রোহিতার মামলার ভয়ে। তবু একটা সহজ রেফারেন্স দিয়ে রাখি। ‘উইকি’কে বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু উইকিতে 14th Dalai Lama - বলে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। ওর ভিতরে ৭৯ নম্বর রেফারেন্স। সেটা একটা বইয়ের নাম- যেটা হলো, ‘সিআইএ-স সিক্রেট ওয়ার ইন টিবেট’, কানসাস ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০২।
কিন্তু দুর্ভাগ্য নেহরুর। মাওয়ের চীন সেকালের নিরীহ ইরানিদের মতো নয় যে, মোসাদ্দেকের খুন তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। তাই, ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণ ঘটেছিল। একটা শিক্ষা দেয়ার জন্য এ হামলা। পুরো আসাম দখল করে নিয়ে কয়েক দিন-ঘণ্টা রেখে দিয়ে এরপর চীনা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। সামরিক ভাষায়, প্রতিপক্ষের এ রকম একটা পুরো শহর কিংবা খোদ রাজধানী অথবা একটা রাজ্য বা এলাকা দু-একদিন দখল করে রেখে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে কার মুরোদ কতখানি- এটাকে বলে ‘শিক্ষা দেয়ার’ হামলা। আমেরিকাকেসহ সব পক্ষকে শিক্ষা দিতে মাও এটা যেভাবে চেয়েছিলেন, আজ দেখা যাচ্ছে এটা সত্যিই কাজ করেছিল। আজো এটা ভারতের জন্য একটা ‘ট্রমা’ হয়ে আছে।
নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের জীবনে দুটো মারাত্মক ভুল যার ফলে তার চিন্তা করার অযোগ্যতাকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করা যায়, তার একটি হলো- জাতিসঙ্ঘ কী তা না বুঝেই কাশ্মির দখল করা। কাশ্মিরের জনগণকে ফেলে রাজার ওপর ভরসা করা। আরেকটা হলো, আমেরিকান সিআইএকে ভারতের হোস্ট করতে যাওয়ার কুবুদ্ধি; আম্পায়ারগিরিতে উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সীমাহীন লোভ- কিন্তু কাকে নাড়া দিয়েছে খবর নেই। অথচ তিনি তো শরণার্থীর কেবল আশ্রয়দাতার ভূমিকাতেই আটকে থাকতে পারতেন। এতে উল্টো তিনি ‘হিরো’ হতে পারতেন। আজীবন নেহরু এমন ভুল ব্যাট হাঁকিয়ে গেছেন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com