মোদি কী দ্বিতীয় নেহরু হতে চাচ্ছেন?

গৌতম দাস | May 30, 2020 09:45 pm
মোদি কী দ্বিতীয় নেহরু হতে চাচ্ছেন?

মোদি কী দ্বিতীয় নেহরু হতে চাচ্ছেন? - সংগৃহীত

 

বাষট্টি সালের পর থেকে বলাই বাহুল্য, সারা ভারত জানত নেহরু পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু কেউ এতে নিমক ছিটায়নি। তবে অনেকে মনে করেন এই ব্যর্থতার যে লজ্জা যে নিজস্ব একান্ত ‘শক’, তা খুবই মারাত্মক হয়েছিল বলেই তিনি দুই বছর পরই ১৯৬৪ সালে হার্টফেল করে মারা যান। আবার ভারতের চীনা কমিউনিস্টরা দেশদ্রোহিতার মামলা ভয়ে ইস্যুটা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মূল্যায়ন তোলে না। এমনকি এ নিয়ে ভারতে কেউ একাডেমিক আলাপ করেছেন বলেও জানা যায় না। তবে সব কিছুই সামলানো হয়ে আসছে উগ্র (প্রকাশ্য বা ‘ছুপা’) হিন্দুজাতিবাদ দিয়ে। যেমন, সেই থেকে এখনো সব দল-পক্ষের মিডিয়াই সাধারণভাবে প্রবল অ্যান্টি-চায়না টোন বজায় রেখে চলছে। অথচ দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য চলছে সমানে- বছরে ৭০ বিলিয়ন ডলারের। এর বাইরে ভারতের বিপুল চীনা বিনিয়োগ, সেসব তো আছেই। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, চীন-ভারত সীমান্ত মানে পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, অর্থাৎ দু’পক্ষই মানে এমন ডিমার্কেটেড সীমান্ত নেই। গত ২০১৩ সালের অক্টোবরে এই ইস্যুতে প্রথম এক বিরাট অগ্রগতি হয়েছিল।

দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল। তার মুখ্য বিষয় হলো, পরস্পর কথা বলে আপসে এই নীতিতে ডায়ালগ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে কার কোনটা সীমান্ত তা চিহ্নিত করে ফেলবে। এর জন্য অনেক বিষয়েই মোড ও প্রটোকল ঠিক করা হয়েছিল, আলোচনায় দু’পক্ষেরই স্থায়ী প্রধান ব্যক্তি কে হবেন তাও ঠিক করা আছে এখনো। মাঠপর্যায়ে সীমান্ত পোস্টের কমান্ডার পর্যায়ে টেলিফোন হটলাইন থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক ডায়ালগের সুযোগে থাকার সব বন্দোবস্ত ও মোড ঠিক করা আছে। যাতে ভুলেও কোনো গুলি তো দূরে থাক একটা হাতাহাতিও যেন হয়ে না যায়, এরই সব মোড আর প্রটোকল ঠিক করা আছে সেখানে। গত কয়েক দিন ধরে বিশেষ করে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে বিপুল পরিমাণ ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় খেয়াল করে দেখেছেন অনেকে- অনুমান করছি। সেখানে দেখে থাকবেন, চীনা আর ভারতীয় সৈন্য কেউ কারো গায়ে হাত লাগাচ্ছে না, ওই প্রটোকলের কারণে সেটা বারণ করা আছে সেখানে। তাই বুকে বুক দিয়ে ঠেলাঠেলি আর ক্যামেরায় ছবি তুলে প্রমাণ এ মর্মে সংগ্রহ করে রেখে দেয়া যে, ‘আমি দোষী নই।’ কারণ ওই ঠেলাঠেলিই শেষ নয়, বরং পরস্পরের ক্যামেরায় তোলা ওইসব ছবি হয়তো, আগের কোনো ঐকমত্য হওয়া থাকায় তার প্রটোকল মেনে চলার প্রমাণ দেখাতে হতে পারে পরের কোনো যৌথ মিটিংয়ে।


কিন্তু এত কিছুর পরও সীমানা চিহ্নিত করার মিটিংয়ে বসার অগ্রগতি খুবই কম। এর একটা অবজেকটিভ আমরা ধরতে পারি যে, দু’পক্ষই অগ্রগতি না হওয়ার মধ্যে এখনো কোনো-না-কোনো স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে। তাই অগ্রগতি নেই। যেমন খুবসম্ভবত এটা হতে পারে যে, ‘ভারতের আশা-আমেরিকাকে যদি ভারতের পক্ষে পাশে পেয়েই যাই, তবে নেগোসিয়েশনে সেটা আমার জন্য ওজনদার শক্তি হিসেবে হাজির হতেও পারে। কাজেই অপেক্ষায় থাকি।’

তবে এসবের বাইরে মোদি-ট্রাম্পের আরেক সমীকরণ আছে। সে কারণে, খুবসম্ভবত আগামী নভেম্বর পর্যন্ত এই টেনশন টেনে নিতে চাইবেন তারা দু’জন। কারণ হলো, ব্যক্তিগত নির্বাচনী স্বার্থ। এর আগে মোদি-ট্রাম্প দু’বার দুই দেশে পাবলিক সমাবেশে পরস্পরকে সুবিধা করে দিতে হাজির হয়েছিলেন। আমাদের নিশ্চয়ই তা মনে আছে। নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প দেখাতে চান তিনি চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সব ধরনের স্বার্থ নিয়ে লড়াকু- বেস্ট ক্যান্ডিডেট। যেহেতু চীনের উত্থানেই আমেরিকার গৌরব সব ধূসর হয়ে গেছে। কাজেই সেই চীন-ধোলাই করতে সক্ষম, ডোনাল্ড ট্রাম্পই আমেরিকার জন্য বেস্ট ক্যান্ডিডেট।

আর এই ইমেজ তৈরি করায় বাতাস দিতে নরেন্দ্র মোদি এগিয়ে এসেছেন। এতে তারও স্বার্থ আছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের মোদি সরকার খুবই খারাপ অবস্থায়। এর ওপর এখন করোনায় অবস্থা আরো খারাপ। কাজেই তার সরকারের পারফরম্যান্স এখন পাবলিকের কাছে বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি। অতএব মানুষের মন ও চোখ সরাতে হয় পাকিস্তান অথবা চীনের সাথে কোনো সীমান্ত টেনশন তৈরি করা আর সেখান থেকে, অবাস্তব হলেও, মোদি নিজেকে অন্তত একবার বিজয় অর্জনকারী বীরের ভূমিকায় হাজির করতে পারলে সেটা এক ‘বিরাট অর্জন’ হতে পারে। মোদির লক্ষ্য হচ্ছে, ট্রাম্পের ‘ক্ষ্যাপ মেরে দেয়া’র বিনিময়ে নিজের জন্য এটা তিনি অর্জন করতে চান। তাই তিনি ইতোমধ্যে ‘ট্রাম্প মধ্যস্থতা করতে চান’- এই প্রস্তাব বাজারে ট্রাম্পকে দিয়েই হাজির করাচ্ছেন। যদিও এটা আরো করাচ্ছেন নিজের ওপর নিজ দেশের এলিট-মাতবর লোকদের অনাস্থা-ভয় কাটাতে। যেমন ভারতের কূটনীতিক মহলেই এখন খোলাখুলি টুইটের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া চলছে যে, রাশিয়ার পুতিনকে দিয়ে মোদি যেন চীনকে থামানোর চেষ্টা করেন, এতেই লাভ হবে। অর্থাৎ সমাজের এই সেকশন ভয় পেয়েছে।

কথা সত্য! আর বলাই বাহুল্য এটা খুবই ‘রিস্কি গেম’! কেন? কারণ খুবই সম্ভাবনা হলো, চীন ১৯৬২ সালের মতো এবার লাদাখে আবার একটা ‘শিক্ষার আয়োজন’ করে ফেলতে পারে। তবে মোদি ব্যাপারটাকে নিয়েছেন নির্বাচনী ভোটার নাচানোর বিষয় মনে করে রেখে দিতে। কিন্তু এটাতেই চীনারা সবচেয়ে অসন্তুষ্ট। খেলার উপকরণ হিসেবেই যেন এটাকে দেখা বা দেখানোর সুযোগ না থাকে, তাই চাচ্ছে তারা এবার।

আর ঠিক এই মেসেজই পেয়ে গেছে ভারতের এলিট, বিরোধী দল, মিডিয়া- সবাই। তারা একেবারে অস্থির। যেমন- আনন্দবাজার পত্রিকা সঠিক জায়গাটা ধরে প্রকাশ্যে আর্টিকেল লিখে বলছে, সব ‘নষ্টের গোড়া’ অমিত শাহ। কাশ্মির নিয়ে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর থেকেই ভারতের ওপর সব বিপদ-আপদ এসে হাজির হয়েছে। তিনি কেন লাদাখ কোনো রাজ্যের অংশ নাকি কেমন প্রদেশ, সেসব স্ট্যাটাস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলেন?

বিশেষ করে চীনের দখলে থাকা ‘কাশ্মিরের অংশও’ ভারতের বলে পার্লামেন্টে বিবৃতি দিতে গেলেন? আসলে এ থেকেই তো সব কিছু অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। আগে বহুকিছুই অমীমাংশেয় ছিল সত্য কিন্তু একটা স্থিতাবস্থা বজায় ছিল। সেটা উগ্র জাতিবাদ দেখাতে গিয়ে অমিত শাহ-ই নাড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন। তাই এই লাইনে ভারতের ভেতর থেকেই অমিত শাহের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক প্রকাশ্যেই শানিয়ে উঠছে সবার আগে। বুঝাই যাচ্ছে, এরা শক্তের ভক্ত হয়ে অমিত শাহের হাত আগেভাগে ছেড়ে নিজেরা নতুন অবস্থান নিয়ে বাঁচতে চাইছেন। অর্থাৎ মোদির নির্বাচন বা ভোটার নিয়ে খেলা চালানোতে ভারতের এলিট, বিরোধী রাজনীতিক, মিডিয়া ইত্যাদি সবাই মোদির দায় ত্যাগ করে ফেলতে চাইছেন। এতে পুরাপুরি একটা মেরুকরণ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

এখন চীন মিথ্যা করেও একটা হামলার অবস্থায় যাচ্ছে দেখালেও তাতে সব ভেঙে পড়ে যেতে পারে। হয়তো দেখা যাবে, মোদির বিরুদ্ধেই ‘দেশকে বিপদের মুখে ফেলার অভিযোগে’ মিছিল শুরু হয়ে গেছে। এ দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই প্রথম সম্ভবত একটি দলের মান বাঁচানোর প্রোগ্রামে শামিল হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর ওপর দিকের নেতৃত্ব যেন বিজেপির কর্মী। এতে সেনা সদস্যরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়দায়িত্বের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অবসরে যাওয়ার আগে-পরে নানান সুবিধার লোভে তাদের পা পিছলিয়ে যাচ্ছে। আর তাতে পুরো সেনা প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব ধুলায় লুটাচ্ছে। মোদি-ট্রাম্পের দলীয় বা ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা- এগুলো খুবই বিপজ্জনক।

সর্বশেষ চীনা ‘গ্লোবাল টাইমস’ ম্যাগাজিন পরামর্শ দিয়েছে ভারত-চীনের ইস্যু থেকে আমেরিকাকে দূরে রাখতে। এর মানে হলো, এমন পদক্ষেপ না দেখলে চীন ‘শিক্ষা দেয়ার’ অ্যাকশনে যেতেও পারে? এটা কি সেই ইঙ্গিত?
ওদিকে নেপাল ইস্যু, বলাই বাহুল্য, এটা ‘মাছের তেলে মাছ ভাজার’ জন্য মোদির চেষ্টা। মোদি ও ট্রাম্পের নির্বাচনী খেলার কালে এই ভয় দেখিয়ে নেপালের সাথে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ভূমি দখলটা সেরে ফেলতে পারবে অনুমান করে ভারত এগিয়েছে। এ দিকে নিজেই উসকানি দিয়ে ভারতের সেনাপ্রধান বলেছেন, নেপাল নাকি চীনা উসকানিতেই প্রতিবাদ করছে। কথাবার্তা ছাড়াই নেপালের ভূমি দখল বিতর্ক শুরু করল ভারত, সেটা উসকানি নয়; বরং নেপালের প্রতিবাদ, সেটার উসকানিদাতা হলো নাকি চীন? আর চীন-ভারত ইস্যু একটু হালকা হলেই এই ইস্যুতেও ভারত হারবে এবং সবার আগে কূটনৈতিক পশ্চাৎ অপসারণ শুরু হবে সম্ভবত এখান থেকেই।

যেটা সিরিয়াস বিষয় তা নিয়ে নির্বাচনী খেলা খেলতে গিয়ে মোদি কি নিজের ‘পেটব্যথা’ ডেকে আনবেন? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চেয়েও খারাপভাবে শিক্ষা নেবেন? সব কিছুই অস্থির ও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us