বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে!
করোনাভাইরাস - সংগৃহীত
বাংলাদেশে শুধু লক্ষণযুক্ত রোগীর কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো হচ্ছে। কোনো র্যান্ডম (সাধারণভাবে) স্ক্রিনিং করানো হয় না। এ কারণে কোনো অ্যাসিম্পটোম্যাটিকেল (লক্ষণহীন) রোগীকে আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না। ফলে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, জনসংখ্যার কতভাগ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ শিগগিরই করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ রেখাটি দেখতে পাবে না। ফলে আমাদের ভোগান্তিও কমছে না শিগগিরই। সামনে সব কিছু খুলে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যেসব দেশে রেখাচিত্রে কোভিড-১৯ অবস্থান পিক বা সর্বাধিক অবস্থায় পৌঁছে নামতে শুরু করেছে সেসব দেশে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। যেমন, আমরা চীনের উহান শহর বা হোবেই প্রদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের নাম বলতে পারি। এই দেশগুলো লকডাউন করে কৃত্রিমভাবে সংক্রমণ কমিয়ে এনেছে সফলতার সাথে। এরা লকডাউন করার পাশাপাশি র্যান্ডম টেস্ট করেছে ও কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সংস্পর্শে যারা এসেছে এদের সবাইকে ট্রেসিং (চিহ্নিত) করেছে। আবার এদের সবাইকেই খুবই দ্রুততার সাথে সুস্থ মানুষ থেকে আলাদা করেছে। এরা সংক্রমণকে কৃত্রিম ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে হাল তা থেকে স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, এখানে পিক সময়টা আসবে তবে তা স্বাভাবিক গতিতে। কৃত্রিমভাবে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এ দেশে যথাযথ প্রক্রিয়ায় লকডাউন করা হয়নি। তা ছাড়া আমাদের টেস্টিং, ট্রেসিং ও আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ মানুষের কাছ যথাযথভাবে পৃথকও (কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন) করা হয়নি। এখনতো কোয়ারেন্টিন অথবা আইসোলেশন ব্যবস্থাটাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন রোগীর সংখ্যা ধারণার চেয়েও বেশি।
তারা জানান, এক সময় কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে আমরা খুব তাড়াতাড়ি পিকে পৌঁছে যাব। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ লকডাউন, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন সঠিকভাবে না হওয়ায় তাড়াতাড়ি পিকে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশে পিক সময়টা আসবে খুবই স্বাভাবিক (অর্থাৎ দেরিতে) গতিতে। এখানে বহু লোক আক্রান্ত হতে পারে। ফলে অনেকের দুঃজনক পরিণতি হওয়ারই আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জ্যামিতিক হারে অর্থাৎ ২ থেকে ৪ এবং ৪ থেকে ৮ চক্রে (সাইকেলে) বৃদ্ধি পেতেও অনেক বেশি দিন লেগে যাবে।
চিকিৎসকরা বলেন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিনে ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হলেই এক মাস পরে আমরা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে কোনো বিছানা দিতে পারব না। এর আগেই হাসপাতালের প্রতিটি বিছানা ভর্তি থাকবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীতে। এখানে বেশি মানুষ থাকার কারণে জীবাণুটির একাধিক মিউটেশন হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ভাগ্য খারাপ থাকলে তখন ভাইরাসটি আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। আবার ভাগ্য ভালো হলে মিউটেশনের কারণে জীবাণুটি দুর্বলও হয়ে যেতে পারে। দুর্বল হয়ে গেলেতো ভালো কিন্তু জীবাণু ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলে তখন আমরা কী করব? তখন হয়তো নিজেদের ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। এটা হবে আমাদের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে। এ কারণে পিক সময় অথবা রেখাচিত্র (গ্রাফের চূড়া) উঠতে পারে অনেক উঁচুতে এবং এটা হতে পারে অনেক দেরিতে। আর রেখাচিত্র যত দেরিতে উঠবে তা নামবেও তত দেরিতে।
তারা বলেন, জীবন আগে না জীবিকা আগে তা নির্ধারণ করতে না পেরে আমরা সঠিকভাবে লকডাউনও করতে পারলাম না। এ কারণে অনেকটা সময় আমাদের নষ্ট হয়েছে। এখন আবার জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে ১ জুন থেকে ‘সীমিত আকারে’ নাম দিয়ে সব কিছুই চালু করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সব কিছু চালুর ঘোষণা শুনে গতকাল শুক্রবার থেকে রাজধানীসহ শহরগুলোতে মানুষ ও যানবাহন চলাচল বেড়ে গেছে। ফলে রোগটি আগের চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাদের মতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দেশে করোনার কেন্দ্র (এপিসেন্টার) রাজধানী শহর, ঢাকা। এখনো যদি ঢাকা ও পাশের এলাকাকে পূর্ণ লকডাউন করে এবং সারা দেশে প্রচুর পরীক্ষা করা যায় তাহলেও রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতে পারে। তা না হলে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে এটা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। বলা হচ্ছে, সরকার আগামী ১ জুন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু করতে বলেছে। দুর্ভাগ্য হলোÑ মানুষের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রতিদিনই বলা হচ্ছে বাইরে চলাচলে মাস্ক ব্যবহার করতে। কিন্তু বাস্তবে খুব কম মানুষই আছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্কটা ব্যবহার করছেন। রাজধানীর মানুষের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মাস্ক ব্যবহার করেন। কিন্তু যথাযথভাবে খুব কম মানুষই মাস্ক ব্যবহার করেন। কারো মুখে মাস্ক আছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা নাকের নিচে। কেউ মাস্ক ব্যবহার করছেন কিন্তু এটা খুবই ঢিলা। এভাবে মাস্ক ব্যবহার করলে জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন।
চিকিৎসকরা বলছেন, অফিস ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী সেপ্টেম্বরের আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে বলে মনে হয় না। জীবনকে বাদ দিয়ে জীবিকার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই হয়তো আমরা হয়ে উঠতে পারি প্রিয়জনদের হত্যাকারী।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাংলাদেশে যারা চিন্তা করছেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক। তিনি জানান, করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিজ্ঞান শুনছে না এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। বিপরীতে জাতিকে আরো সংক্রমণ ঝুঁকিতে ফেলছে।