সৌদি আরব ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন গাদ্দাফি!

গাদ্দাফি - সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যে আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে তার বাস্তবায়ন কাল বলা হচ্ছে, এখন থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ। পরিকল্পনা অনুযায়ী জর্দান উপত্যকা ও পশ্চিমতীর ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হবে। ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দেয়া হবে জর্দানে। জর্দানের বাদশাহ আবদ্ল্লুাহর পূর্ব পুরুষরা জাজিরাতুল আরব তথা মক্কা-মদিনা ও সন্নিহিত যে অঞ্চলের শাসক ছিলেন তাদেরকে সেটি আবারো দেয়া হবে। তারা উসমানীয় খেলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই অঞ্চলে একটি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌদ পরিবারের হাতে পবিত্র ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সম্পদহীন অনুর্বর একটি অঞ্চলে জর্দান রাষ্ট্র গঠন নিয়ে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বর্তমান সৌদি শাসকদের হাতে থাকবে রিয়াদের পুরনো অঞ্চলটি। বৃহত্তর সৌদি সামাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে মোহাম্মদ বিন সউদের প্রতিষ্ঠিত শাসন ছিল এই অঞ্চলে। সৌদি শাসকদের দিয়ে যে নতুন নিওম সিটি তৈরি করা হচ্ছে তার সিনাইসহ বড় অংশটি ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।
২০০৬ সালে আমেরিকান আর্মড ফোর্সেস জার্নালে ইসলামের পবিত্র ভূমি নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সময়ে সৌদি রাষ্ট্রের যে সংহতি ও শক্তি ছিল তা এখন আর অবশিষ্ট নেই। আগে সৌদি আরবের কোনো বিদেশী ঋণ ছিল না, হাজার বিলিয়ন ডলার সংরক্ষিত সম্পদ তহবিল ছিল। এখন দেশটির সম্পদ তহবিল নেমেছে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আর আগে যেখানে কোনো বিদেশী ঋণ ছিল না সেখানে এখন সৌদি আরবের বিদেশী ঋণ ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ইয়েমেনের যুদ্ধ আরো কিছুকাল চললে এবং জ্বালানি তেলের বর্তমান দাম অব্যাহত থাকলে সৌদি আরবের সম্পদ তহবিল শূন্যে নামবে আর এতে নাগরিক সুবিধা আরো ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করতে হবে। দেশটির বাজেট হবে আরো বেশি বিদেশী ঋণনির্ভর। তখন সম্পদ তহবিল তৈরির জন্য জাতীয় তেল কোম্পানি আরামকোর শেয়ার বিক্রির কোনো বিকল্প থাকবে না। বিন সালমান তেমন একটি পরিকল্পনার কথা আগেই জানিয়েছেন।
সৌদি আরবের রাজনৈতিক ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ ভিত্তি ছিল তিনটি, যার মধ্যে রয়েছে, বিপুলায়তন রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সংহতি, ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে সমন্বয় ও বোঝাপড়া এবং প্রভাবশালী গোত্রনেতা ও বিপুল জনগোষ্ঠীর সমর্থন। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপরিবারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযান, ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজকে সেকুলার করার জন্য নেয়া সংস্কার পদক্ষেপ এবং নাগরিক সুবিধা কাটছাঁট করা আর জনগণের উপার্জন হ্রাসের ফলে এই তিনটি ক্ষেত্রেই সৌদি শাসকদের ক্ষমতার ভিত দুর্বল হয়ে গেছে। এ ধরনের অবস্থায় সৌদি রাজক্ষমতা অনেকখাানি বিদেশী শক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ দুই শক্তি ও তাদের সহযোগীরা যদি সৌদি আরবের বিভক্তি কামনা করে তাহলে সেটা ঠেকানো এখন রিয়াদের শাসকদের জন্য কঠিন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০০৬ সালে আর্মড ফোর্সেস জার্নালে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করার পর প্রকাশ্যে কোনো কথা বলা না হলেও ভেতরে ভেতরে তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র এবং শাসক পরিবর্তনের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় আবার সে বিষয়টি পাদপ্রদীপে চলে এসেছে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ফাঁস হয়েছে। যে ভিডিওতে লিবিয়ার শাসক মোয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ওমানের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথোপকথন রয়েছে। ওমান মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটি রাষ্ট্র যেটি যেকোনো সঙ্ঘাতে নিরপেক্ষ থেকে সবার সাথে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সমঝোতায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মুসলিম দেশ সফর করেছেন তার মধ্যে এই দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন। সেই ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও গাদ্দাফির সাথে কথোপকথনের এই টেপে সৌদি আরব ভাঙার বিষয় নিয়ে আমেরিকান একটি প্রস্তাব নিয়ে কথা হয় দুই নেতার মধ্যে। এর আগে ২০০৩ সালে আরব লিগের সম্মেলনে এক উত্তেজনাকর মুহূর্তে গাদ্দাফি সৌদি বাদশাহ ফাহাদকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। ফাহাদ তখন কোনো জবাব দেননি। কিন্তু তদানীন্তন যুবরাজ ও পরবর্তী বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছিলেন, কার মৃত্যু কোথায় কিভাবে হয় সেটি পরের ইতিহাসে লেখা থাকে। ফাহাদ যুবরাজকে তখন বসিয়ে দেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পরবর্তী রাজনীতিতে এর একটি প্রভাব থেকে যায়। লিবিয়া আর সৌদি আরবের সম্পর্কের মধ্যে সব সময় একটি আস্থাহীনতা কাজ করে।
ধারণা করা হয়, সৌদি আরব ভাঙার যে আমেরিকান প্রস্তাব নিয়ে কাজ করার জন্য গাদ্দাফির সাথে ওমানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথোপকথন হয় সেটি ২০০৬ সালের পরের কোনো এক সময়ের। এই কথোপকথনে গাদ্দাফিকে বলতে শোনা যায় যে, তাদের প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে তারা যে আমাদেরও ছাড় দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র ইরানের রেজা শাহের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগটুকুও তিনি পাননি। পরে গাদ্দাফি সৌদি আরবের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া বা ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন কিনা জানা যায় না। তবে লিবিয়ার আরব বসন্ত এবং গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডের সাথে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ সময় আবদুল্লাহ ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ।
টেপটি প্রকাশের পর ওমানের ব্যাপারে অভিযোগ করা হচ্ছে, ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পাঁচ শক্তির যে পারমাণবিক চুক্তি হয় তার মধ্যস্থতার আয়োজন করে ওমান। আর এই চুক্তি বাতিলের পর ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের যে উত্তেজনা বিশেষত সোলাইমানি হত্যার পরবর্তী পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করার ব্যাপারে ওমান ভূমিকা পালন করেছে। আর সর্বশেষ ইরানের সাথে ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে যে বৃহত্তর সমঝোতা হতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে, তার সাথে ওমানের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। আর ওমানের মাধ্যমে এর নেপথ্যে ইসরাইলের সম্পৃক্ততাও রয়েছে।
mrkmmb@gmail.com