চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ : ট্রাম্পের গোপন স্বার্থ
চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ : ট্রাম্পের গোপন স্বার্থ - সংগৃহীত
বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের ওপর এর বিপর্যয়কর প্রভাব সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে হচ্ছে এই অতিমারির সৃষ্ট প্রেক্ষাপটকে আগামী নির্বাচনে জয়ের জন্য ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।
প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করার কৌশলের একটি বড় অংশজুড়ে আছে চীনের সাথে মার্কিন সম্পর্ককে পরিকল্পিতভাবে অবনতিশীল করা। আর তা করা হচ্ছে ভাইরাসটির জন্য চীনকে দায়ী করে নিজেকে সব ধরনের দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখা।
চীনকে দায়ী করা ও চলমান বাণিজ্যযুদ্ধকে স্নায়ুযুদ্ধে (স্নায়ুযুদ্ধ ২.০) পরিণত করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বকে চীনপন্থী ও চীনবিরোধী এই দুই ব্লকে ভাগ করার চেষ্টাও করছে। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, এটি কেবল দ্রুত বর্ধমান চীনা (এবং রুশ) পুনরুত্থানের মোকাবেলায় দ্রুত পতনের দিকে যেতে থাকা মার্কিন প্রভাবই রুখে দেবে না, সেইসাথে চীনা নেতৃত্বের ভাষায় অভিন্ন গন্তব্যের বৈশ্বিক সম্প্রদায় নির্মাণের প্রয়াসও (এটি মার্কিন একতরফাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত) ভণ্ডুল করে দেবে।
অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধ ২.০ হলো বিশ্বের অর্থনৈতিক ও আর্থিক দৃশ্যপট বদলে দিতে থাকা চীনের কানেকটিভিটি কর্মসূচিকে হারিয়ে দেয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রও একই ধরনের একটি দৃশ্যপট তৈরী করে বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এই দৃশ্যপটে মার্কিন ডলার ছিল আর্থিক ব্যবস্থার মূল অবস্থানে।
ফলে চীনকে দোষারোপ করাটা কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হাসিল করে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেই ২০২০ সালের জানুয়ারিতেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর বিপর্যয়কর প্রভাবের কথাও জানিয়েছিলেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ভাইরাসটির ব্যাপারে সিরিয়াস হননি।
ফলে ট্রাম্প যখন ভাইরাসটির বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ী করার জন্য একে ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে অভিহিত করেন, তখন চিকিৎসাগতভাবে এর কোনো অর্থ হয় না। তবে এর একটি রাজনৈতিক মূল্য আছে। আর এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট তার ভোটারদেরকে কোনো একটি দিকে আঙুল তোলার সুযোগ দিয়ে দিচ্ছেন।
বস্তুত, ট্রাম্প এমনকি রাজনৈতিক বিরোধী তথা ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনকে কলঙ্কিত করার কাজেও চীন ফ্যাক্টর ব্যবহার করছেন। তিনি টুইটে বলেন, চীন বিপুল ভুল তথ্য দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। কারণ তারা চায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঘুমন্ত জো বাইডেন জয়ী হোক, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অব্যাহতভাবে প্রতারণা করে যেতে পারে, যেভাবে আমি আসার আগে পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে করে গিয়েছিল। এর মাধ্যমে বাইডেনের সাথে চীনের কঠিন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। আর মার্কিন রাজনীতিতে এর মাধ্যমে একসময়ের রুশোফোবিয়ার স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছেন চীনোফোবিয়াকে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান চীনকে নেতিবাচকভবে দেখে। চীনাদের ব্যাপারে নেতিবাচক এই দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের চীনের সমালোচনা থেকে উদ্ভূত না হলেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ট্রাম্প এটি নিয়ে খেলছেন এবং একে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্যে পরিণত করছেন, পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে একে উস্কে দিচ্ছেন, মার্কিন অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করা ও মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মারাত্মক ব্যর্থতার ওপর ধোঁয়াশে পর্দা টেনে দিচ্ছেন।
ফলে নির্বাচনে এ ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে : মার্কিন অর্থনীতি যদি খারাপ হয়েও থাকে, তবে তার জন্য প্রেসিডেন্ট দায়ী নন, বরং এজন্য দায়ী চীন এবং প্রেসিডেন্ট চীনের প্রতি খুবই কঠোর।
ট্রাম্প কেন চীনের সাথে সব বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান এবং দেশটির সাথে আরো তীব্র বাণিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে চান, তার ব্যাখ্যা এটিই। গত ২২ মে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে সংখ্যালঘু উইঘুর লোকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তিতে বেইজিংকে সহায়তা করা, কিংবা ব্যাপক বিধ্বংস অস্ত্র সম্পর্কিত হওয়ায় বা চীনা সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য তারা তাদের কালোতালিকায় ৩৩টি চীনা প্রতিষ্ঠানকে যোগ করছে।
এখানেই শেষ নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চীনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মিত্রদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জাপানের মতো কিছু মার্কিন মিত্র ইতিবাচকভাবে সাড়াও দিয়েছেন। আর এর অংশ হিসেবে জাপান সরকার চীন থেকে জাপানি কোম্পানিগুলোকে সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রণোদনা হিসেবে ২২০ বিলিয়ন ইয়েন (২ বিলিয়ন ডলার) প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। চীন থেকে ভাইরাস ছড়ানোর গুঞ্জনের মধ্যে এই ঘোষণা দেয়া হলো।
ফলে নির্বাচনের দিকে এক চোখ রেখে এবং বিশ্ব রাজনীতিকে আরো মেরুকরণ করার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনকে সহজ শিকার হিসেবে পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এই শিকারকে সহজেই টার্গেট করা যায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কাজে লাগানো যায়।
অবশ্য, এই পরিকল্পিত আঘাত ও মেরুকরণ ট্রাম্পের জন্য সাময়িকভাবে কাজ করবে এবং এমনকি তাকে নির্বাচনে জয়ী হতেও সহায়তা করবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্র সত্যি কি বিশ্বে তার প্রাধান্য বজায় রাখতে পারবে এবং সফলভাবে বহু মেরুতে পরিবর্তনকে রুখে দিতে পারবে?
অনেক কারণেই এমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো এই বাস্তবতা যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের পতনের কারণে নয় বরং অন্যদের উত্থানের জন্যই বৈশ্বিক ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে বদলে যাচ্ছে।
সূত্র : এসএএম