গল্পটা এক নারী আর এক পুরুষের
গল্পটা এক নারী আর এক পুরুষের - সংগৃহীত
গল্পটা এক নারী আর এক পুরুষের। যাদের দুজন দুই ধর্মের, দুই জাতিগোষ্ঠির। যে দুটি জাতির মধ্যে আছে দীর্ঘ বিরোধ, রক্তপাত আর গণহত্যার ইতিহাস; কিন্তু এই বিরোধের ইতিহাস তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সম্পর্কটা প্রেমঘটিত নয়, একান্তই মানবিকতা আর সহমর্মিতার। এক নিঃসঙ্গ অসহায় বৃদ্ধার প্রতি সম্পূর্ণ অচেনা এক লোকের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার গল্প। যেখানে বাধা হতে পারেনি দুজনের ধর্ম, জাতিগত বিরোধ কিংবা পথের দূরত্ব। এ সব কিছুকে হার মানিয়ে জয় হয়েছে মানবিকতার।
গল্পটা বলকান অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কসভোর। গল্পের নায়ক ফাদিল রামা নামের এক কসভোর নাগরিক। যিনি জাতিগত আলবেনীয়। তিনি স্থাপন করেছেন এমন অনন্য নজির যা জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়। নিজের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে প্রত্যন্ত এক গ্রামে একাকী বসবাস করা এক সার্ব বৃদ্ধার দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে একটু স্বস্তি দেয়াটাই যার উদ্দেশ্য।
কসোভোর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের নাম ভাগনেস। গ্রামটির একমাত্র বাসিন্দা ৯২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। নাম তার ভ্লাদিকা দিচিচ। যার সন্তানেরা কেউ তার কাছে থাকে না। নিজ নিজ স্বার্থে তারা চলে গেছে দূরে। দেখাশোনা কিংবা সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই তাই বৃদ্ধার। শুধু যে নিজের ঘরে একা থাকেন ভ্লাদিকা দিচিচ তাই নয়, পুরো গ্রামেই তিনি একা। গত প্রায় ২০ বছর ধরে ভাগনেস গ্রামের একমাত্র বাসিন্দা হয়ে আছেন তিনি।
ছবির মত সুন্দর একটি গ্রাম; কিন্তু সেটি খালি পড়ে আছে। গ্রামের রাস্তাঘাটে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, কারণ সেখানে মানুষের পা পড়ে না। গ্রামটিতে আছে সুন্দর একটি গির্জা- যেটিতে এই শতাব্দির শুরু থেকে আর কেউ যায়নি প্রার্থনার জন্য। যাবে কি করে পুরো? গ্রামটিতেই তো বাসিন্দা বলতে ওই একজন। বছর বিশেক আগে গ্রামটিতে কয়েকটি পরিবার মিলে বিশ জনের মতো লোক ছিলো; কিন্তু নগরায়নের সুবিধা ভোগ করতে তারা গ্রাম ছেড়ে সবাই পাড়ি জমিয়েছেন বিভিন্ন শহরে। একজন অবশ্য গ্রামের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। পারেননি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বেড়ে ওঠা জীবন ছেড়ে হঠাৎ শহুরে হয়ে যেতে। তিনি ভ্লাদিকা দিচিচ।
কিন্তু দীর্ঘদিন একাকীত্বের সঙ্গে লড়াই করে টিতে থাকলেও এক সময় বয়সের কাছে কাবু হয়ে গেছেন দিচিচ। এখন আর নিজের প্রয়োজনীয় কাজটুকুও করতে পারেননা তিনি। ৯২ বছর বয়সে এসে তাই তার বেঁচে থাকাই হয়ে উঠেছে কষ্টকর। কোনো একদিন কিভাবে যেন সেটিই চোখে পড়ে ফাদিল রামার। বিবেকের তাড়নাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। এগিয়ে আসেন দ্রুত। নিজের সব কাজ সামলেও তিনি সময় বেড় করে নেন বৃদ্ধা দিচিচকে সহযোগিতার। দুই কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম স্ট্রেজোভচে থেকে নিজের গাড়ি নিয়ে সপ্তাহে দুই বার তিনি যান ভাগনেস গ্রামে। বৃদ্ধা দিচিচকে সহযোগিতার জন্যই তার সেখানে যাওয়া। সাথে থাকে খাবার আর সংসারের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি। কখনো কোন পোশাক।
ঘটনাটি বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনায় আসার কারণ দিচিচ ও ফাদিলের জাতিগত পরিচয়। একজন আলবেনীয় অন্যজন সার্ব জাতিগোষ্ঠির। যে দুটি জাতির মধ্যে রয়েছে বিরোধ, সঙ্ঘাত আর লড়াইয়ে রক্তাক্ত ইতিহাস। সে সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে।
৫০০ বছর ওসমানীয় খিলাফাতের অধীনে থাকা কসভো এক সময় যায় সার্বিয়ার অধীনে। সার্বিয়া এক সময় যোগ দেয় যুগোস্লাভিয়ার সাথে। তবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওযার পর সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো এক সাথে মিলে রাষ্ট্র গঠন করলেও কসভো পৃথক হতে চায়। এরপরই ১৯৯৮ সালে শুরু হয় সার্বদের সাথে আলবেনীয়দের সঙ্ঘাতের রক্তাক্ত অধ্যায়। সার্বিয় সেনাবাহিনী ব্যাপক হত্যাকা- চালায় আলবেনীয়দের ওপর। বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যা করা হয় বেসামরিক নাগরিকদের। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ন্যটো জোট সামরিক হস্তক্ষেপ করে কসভোয়। ন্যাটোর বিমান হামলা আর স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের স্থল হামলায় পিছু হটতে বাধ্য হয় সার্ব বাহিনী। শেষ হয় রক্তাক্ত এক অধ্যায়ের। এরপর ২০০৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে কসভো। এক শ'টিরও বেশি দেশ দ্রুত সমর্থন দেয় ইউরোপর নতুন মুসলিম দেশটিকে। যদিও সার্বিয়া এখনো দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। কসভোকে তারা নিজেদের অবাধ্য প্রদেশ হিসেবেই দাবি করে। কিন্তু সেই দাবি ধোপে টিকছে না। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদও ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে কসভো। কসভোর সার্বরা অবশ্য স্বাধীন দেশের চেয়ে সার্বিয়ার সাথে থাকতেই আগ্রহী; কিন্তু এই সব কিছুই ফাদিলকে আটকাতে পারেনি অসহায় এক বৃদ্ধার পাশে দাঁড়াতে। জাতিগত তিক্ততা আর গণহত্যার ইতিহাস এক পাশে রেখে তিনি স্থাপন করেছে মানবিকতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত।
ফাদিল রামা নিভৃত সেই গ্রামের দিকে যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে আলজাজিরাকে বলেন, আমি এক বৃদ্ধা সার্ব নারীর কাছে যাচ্ছি। ভ্লাদিকা দিচিচ নামের ওই নারী অসহায় আর একাকিত্বের জীবন যাপন করছেন। আমি যাচ্ছি তাকে খাবার দিতে। কিছু সহযোগিতা করতে। বৃদ্ধা বড়ই একা। ফাদিল আরো বলেন, প্রতিবার যখন আমি দিচিচের বাড়িতে যাই। অজানা আশঙ্কায় থাকি। জানিনা অসহায় বৃদ্ধাকে গিয়ে কিভাবে দেখতে পাবো। মনে মনে আল্লাহর কাছে বলতে থাকি, তাকে যেন সুস্থই দেখতে পাই।
বৃদ্ধার জন্য সাধারণত রুটি, স্যুপ, কলাসহ কয়েক প্রকারের নরম খাবার নিয়ে যান ফাদিল। প্রতিবার গিয়ে দিচিচের টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়ার পর তিনি সুন্দর হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানান ফাদিলকে। দুজনের মাঝে কথা হয়, গল্প হয় বিভিন্ন বিষয়ে। ফাদিলের কাছে তার পরিবারের কথা, দেশের কথা জানতে চান দিচিচ।
ফাদিলের এই মহানুভবতা সম্পর্কে বৃদ্ধা দিচিচ বলেন, আমার প্রতি এই দয়ার কারণে স্রষ্টা তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। তাকে আমি সন্তানের মতোই দেখি। আমার আগে দুটি সন্তান ছিলো জোকা ও স্লোবোদান। কিন্তু এখন আমার তিনটি সন্তান। আর বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া এই তৃতীয় সন্তানটিই এখন আমার জন্য সবকিছু করছে। আমাকে বেঁচে থাকতে অক্সিজেন যোগাচ্ছে। আমার প্রয়োজনীয় সব কিছু এনে দিচ্ছে। সেই আমার এখন একমাত্র অবলম্বন।
দিচিচ জানান, তার এক ছেলে স্লোবোদান থাকেন ১০ কিলোমিটার দূরের শহর কামেনিকায়। স্লোবোদান কামেনিকা নগর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গৃহহীনদের জন্য তৈরি একটি ঘর বরাদ্দ পেয়ে সেখানে বাস করেন। তিনি তার মাকে নিতে চেয়েছিলেন সেখানে; কিন্তু সাড়া জীবন কাটিয়েছেন যে গ্রামে সেই ভাগনেস গ্রামের মায়া ত্যাগ করে যেতে চাননি বৃদ্ধা দিচিচ। তাই তাকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হচ্ছে সেখানে। আরেক ছেলে জোকা চলে গেছে সার্বিয়ায়। তিনি মায়ের কোন খোঁজই রাখেন না।
দিচিচ জানান, তার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট নিঃসঙ্গতা, একাকীত্বের জীবন। এই বৃদ্ধ বয়সে রান্নাসহ নিজের অন্যান্য কাজগুলো করার সামর্থ অনেকটাই কমে এসেছে। ফাদিলের কারণে তার নিঃসঙ্গতা যেমন দূর হয়েছে তেমনি, কাজগুলোও করে দেয়ার মতো একজনকে পাওয়া গেছে।
প্রতিবার সাক্ষাৎ শেষে, ফাদিলকে কান্নাভেজা চোখে বিদায় দেন দিচিচ। ফাদিল তাকে সান্ত¦না দেন। ভরসা দিয়ে বলেন, চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমি আবার আসবো। আপনি কাঁদবেন না, ভয় পাবেন না। আমি অবশ্যই আবার আসবো। এই সান্ত¦নায় দিচিচের কষ্টগুলো যেন জালানি পেয়ে কান্না হয়ে ঝড়ে। কান্না ভেজা কণ্ঠে ফাদিলকে তিনি বলেন, হয়তো এসে দেখবে আমি আর বেচে নেই; কিন্তু সে কথা মানতে রাজি নন ফাদিল।
তিনি প্রতি তিন দিন পরপর যখন দিচিচের বাড়ি যান, মনে মনে আশা করতে থাকেন, দিচিচ ভালো আছে সেটাই দেখতে পাবেন। আর যতদিন বৃদ্ধা বেঁচে আছেন চেষ্টা করবেন তাকে সহযোগিতা করে ভালো রাখতে। যাতে অসহায়, নিঃসঙ্গ এক বৃদ্ধা- যার সন্তানরা তাকে ফেরে গেছে, তিনি জীবনের শেষ দিনগুলো অন্তত কিছুটা হলেও শান্তিতে থাকতে পারেন।
সূত্র : আলজাজিরা