ট্রেন যাত্রা : একটি বিষাদমাখা ঘটনা
ট্রেন যাত্রা : একটি বিষাদমাখা ঘটনা - সংগৃহীত
আমার প্রথম জীবনের একটি অপ্রত্যাশিত বিষাদমাখা ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে আজকের এই গল্পের সূত্রপাত। সে দিনকার কথা প্রায়ই মনে পড়ে - আবার ভুলেও যাই, তথাপি এটা বুঝতে পারি - এ ‘অপমান’ আমার স্মৃতি থেকে একেবারে মুছে যাবার নয়! এ পর্যন্ত আমি অনেক সুখ-দুঃখের কাহিনি, কৌতূহলমাখা বোকা বোকা প্রশ্ন, অভিনব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা নানান রঙে-রসে রচনা করেছি এবং অকাতরে আপনাদের সঙ্গে শেয়ারও করেছি। ওই সব লেখার সময় এই ঘন-কালো পুরনো স্মৃতির টুকরো মনের কোণে বার বার এসে উঁকিঝুঁকি মেরেছে, তথাপি আজ অবধি আমার অন্য কোনও বিবরণে সামান্য এতটুকু জায়গাও করে নিতে পারেনি। যখনই লিখতে চেয়েছি, ছোট ছোট কয়েকটি শব্দ আমাকে প্রবলভাবে বাধা দিয়েছে। ‘ভয়, ‘লজ্জা’, ‘অভাব’, ‘অপমান’, ‘ক্ষমা’, ‘প্রতিশোধ’, ইত্যাদির গলিত মিশ্রিত প্রভাবে সেই ব্যথাটাকে উগলে ফেলার শক্তি, তাকে প্রকাশ করার ভাষা আমি যেন মুহূর্তে হারিয়ে ফেলি! আজ আচমকা কার ইশারায়, কোন সাহসের বলে সেই আজব মনস্তত্ত্বকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন এক বোধোদয় থেকে এ লেখা লিখতে বসেছি, তা জানি না।
সময়টা উনিশ শ’ সত্তর দশকের মাঝামাঝি! আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। একবার গরমের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা ফিরছি। জানি, গাদাগাদি করে গাড়িতে উঠতে হবে, হোক না সেকেন্ড ক্লাস কিংবা থার্ড ক্লাস - সেই তো বসার জায়গা মিলবে না, তাই ঠিক করলাম, থার্ড ক্লাসেই ফিরব - অন্তত দু’টো পয়সা তো বাঁচবে। কুলাউড়া জংশনে সহযাত্রীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে গাড়িতে ওটা অসম্ভব বিধায় উল্টো দিকে চলে গেলাম সিলেট শহরে - যেখান থেকে ট্রেনের যাত্রা শুরু। গিয়ে খুব একটা লাভ হলো না, জেলাসদরের হালহকিকতেও ভালো কিছু দেখলাম না।
সন্ধ্যা সাতটা কী আটটায় তৎকালীন ‘সুরমা মেল’ পুরো প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে ছেড়ে দিলো। ইতিমধ্যে আমি তৃতীয় শ্রেণীর জীর্ণ-শীর্ণ একটি কামরায় উঠতে পারলাম বটে, তবে আমার বসার জায়গা হলো ময়লা মেঝেতে দরজা থেকে ৪-৫ ফুট অন্তর। ট্রেন চলছে, ঘাটে ঘাটে থামছে, মানুষও ওঠা-নামা করছে, কিন্তু এই যোগ-বিয়োগের ফলাফলটা একেবারেই আমার অনূকুলে আসছে না - আমার জন্য বসার জায়গাটা আস্তে আস্তে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তো হচ্ছেই, করার কিচ্ছু নেই, খানিকক্ষণ আলো জ¦ালানোর পর সবেধন নীলমণি মাথার ওপরের বাতিটাও নিভে গেলো, সে বাতি আর ফিরে এলো না। ভোরের সূর্য যখন কপালে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিলো তখন জানলাম, বিজলি বাতির আজ আর প্রয়োজন পড়বে না।
এ ভাবে মাটিতে বসে জীবনে আর কোনও দিন কোনও যন্ত্রযানে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সৌভাগ্য বলছি এ জন্য যে, সে দিনকার সেই অভিজ্ঞতা আমি শতচেষ্টা করে পয়সা দিয়েও কোনও দিন আর কিনতে পারব না। কষ্টকর সেই রাতের ছবি আঁকার মতন পারঙ্গম শিল্পী আমি নই, শুধু এটুকু বলে রাখি, একদিকে গরমে কাতর, তার ওপর মশার গুনগুনানী, অন্য দিকে গাদাগাদি করে বসা মানুষের শরীরের ভোঁটকা গন্ধের বিস্বাদ টেনে নিতে নিতে এক সময় মনে হলো, আমার ঘ্রাণশক্তি বুঝি নিঃশেষ হয়ে আসছে! দেয়ালপানে মুখ লুকিয়ে কেউ থুথু ফেলছে, কেউবা পানের পিক আর বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ার জ্বালা তো আছেই। বাথরুমে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, আর গেলেই বা কী, দুর্গন্ধে বসা যাবে না, পানি পাব না, পেলেও ময়লা পানি হাতে নেওয়া যাবে না। এ ভাবে রাত গেল, ভোর হলো, দুয়ারও খুললো, কিন্তু দুয়ারের বাইরে আমার জন্য যে আরও কঠিন এক পরীক্ষা অপেক্ষা করছিল - তা কি আমি জানতান! সেই না জানা পরীক্ষার কথা বলেই শেষ করব আজকের এই খুদে গল্পগাথা।
দিনের ফকফকা আলো, তখন সকাল আটটা কি ন’টা বাজে। ট্রেন, ভৈরব বাজারেরর পর কোনও এক স্টেশন থেকে মাত্র ছেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো দরজায় ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ, তারপর লাথির পর পর লাথি - ‘দরজা খোল, দরজা খোল’। আমি দরজা থেকে বেশ দূরে। কাঁঠাল বোঝাই কামরা, নিচে বসে কেউ ঝিমোচ্ছে, কেউ ফিসফাস কথা বলছে। চলন্ত গাড়ি, ডাকাতের ভয়ে সবাই প্রায় অসাড় অবস্থায় যার যার জায়গায় গুটিশুটি মেরে আছে। কেউ হাত-পা নাড়ায়নি, দরজা খুলেনি। আর আমরা কয়েক জনের জন্য বিপদ হলো ওইখানেই। পরের স্টেশনে গাড়ি থামতে না থামতেই দেখি, দরজা খুলে কাঁধে রাইফেল নিয়ে রুদ্রমূর্তি ধরে এক আর্মি জোয়ান কামরায় উঠেছেন। উঠেই তিনি আমাদের কয়েকজনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে নামালেন। তারপর অকথ্য ভাষায় কতক্ষণ গালাগাল করলেন - ভুল বোঝবেন না, উর্দূতে নয়, খাঁটি বাংলায় - তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তার পর ধমক মেরে প্রশ্ন করলেন, ‘দরজা খুললি না কেন? লাইন ধর, আজকে তোদের মেরে ফেলব’। আমি একদম স্তব্ধ, ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছি! মুখে কোনও কথা নেই, কোনও আজুহাত দেইনি, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! আমি যেন নিস্তেজ, অনুভূতিহীন এক পাথরের মূর্তি - ঘুমের ঘোরে যেন স্বপ্ন দেখছি!
যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন দেখি, বন্দুকধারীর হাতে একখানা বেতও, বাতাসে সপাং সপাং করে তলোওয়ারের মতো তিনি বেত চালাচ্ছেন। বললেন, ‘হাত বের কর’, স্কুলপালানো সুবোধ বালকের মতো পেতে দিলাম - তিনি আচ্ছাসে কয়েক ঘা আমার নরম হাতের তালুতে বসিয়ে দিলেন। সে দিন আমার মতো আর ক’জন তাঁর শাস্তির ‘স্বাদ’ নিয়েছিল, মনে নেই। মেল ট্রেন ওই স্টেশনে বেশিক্ষণ থামেও না। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে ‘বিচারপতি’ তাঁর ভ্রাম্যমান আদলত গুটিয়ে নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। ঘটনার ঘনঘটা এখানেই শেষ, কিন্তু তার রেশ আমার জীবনে শেষ হলো না। না, ভুল বললাম - আজ হয়ে গেছে! না বলা যে ব্যথা যুগ যুগ ধরে আমার বুকে লুকিয়ে ছিল, আমাকে যখন তখন দংশন করছিল, আজ এই মুহূর্ত হতে আমি সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত! মনের সব দুঃখ-বেদনা ভুলে গিয়ে আমার সে দিনকার অজানা অচেনা একাধারে অনুযোগকারী, সাক্ষী, বিচারক এবং শাস্তিদাতাকে আমি খুশি মনে ক্ষমা করে দিলাম! সেই সঙ্গে অনির্বচনীয় এক আরাম ও স্বস্তিদায়ক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করছে ক্ষমা অপরাধীকে পাপমুক্ত করে, আর ক্ষমাকারীকে ইহকালে বেদনা পুষে রাখার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেয় এবং পরকালে তার ‘ক্ষমা’ পাওয়ার সম্ভাবনার দুয়ারকে উন্মুক্ত করে দেয়! আহাম্মকের মতো অবাক হয়ে ভাবি, এত দিন কেন এই সহজ সুযোগটি নিলাম না!
মে ১৭, ২০২০
ন্যাশভিল, টেনেসি
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
Email: awahid2569@gmail.com