চীন-ভারত হঠাৎ উত্তেজনার নেপথ্যে

নিজস্ব প্রতিবেদক | May 27, 2020 02:15 pm
চীন-ভারত হঠাৎ উত্তেজনার নেপথ্যে

চীন-ভারত হঠাৎ উত্তেজনার নেপথ্যে - সংগৃহীত

 

চীন ও ভারতের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। উভয় পক্ষই তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ব যখন টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে, তখন হঠাৎ করে কেন এই সামরিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তা জানতে আগ্রহী অনেকেই। এখানে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। এতে অন্তত ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই উত্তেজনার নেপথ্য কারণ বোঝা যাবে।

আকসাই চীন নিয়ে ভারত ও চীনের টানাপড়েন নতুন কোনো ঘটনা নয়। যেমন নতুন নয় অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে রয়েছে চীনা দাবি। বস্তুত চীন ও ভারতের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার লম্বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বার বারই খবরের শিরোনাম হয়েছে চীনা সেনা আচমকা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ায়। উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে দু’দেশের সম্পর্কে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারেই। ’৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধের পর ২০১৭-য় দোকলামই ছিল সবচেয়ে বড় উত্তেজনার ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই দোকলামের পর এ বারই বৃহত্তম উত্তেজনার ঘটনা ঘটল দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় চীনা সেনা ঢুকে পড়েছে ভারতীয় এলাকায়। আর অনেক বেশি এলাকা দিয়ে তারা ঢুকেছে। চীনা সেনাদের মনোভাবও অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। গালওয়ান উপত্যকার মতো তারা এমন সব এলাকায় ঢুকে পড়েছে, যে অঞ্চলগুলি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোনো দিনই কোনো বিরোধ ছিল না। এমনকী, তাদের টহল দিতে দেখা গিয়েছে ভারতীয় সেনা চৌকি ‘কেএম১২০’-র আশপাশেও।

কেন এ বারের এই উত্তেজনা?

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, মূলত দু’টি কারণে এ বার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব লাদাখে।

প্রথমত, ডোকলামের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় এলাকা থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় পৌঁছনোর সড়কপথ ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো বানিয়ে ফেলেছে। যার ফলে পূর্ব লাদাখের কাছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ভারতীয় সেনাদের কাছে আর ততটা দুর্গম হয়ে থাকেনি। ভৌগোলিক কারণেই চীনা ভূখণ্ড থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত সহজে পৌঁছনোর কাজটা চীনা সেনাদের পক্ষে করে ফেলাটা ততটা সম্ভব হয়নি। এটা বেইজিংয়ের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এ বার চীন বেশি উদ্বিগ্ন গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা নিয়ে। যা পড়ে চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে নির্মীয়মান অর্থনৈতিক করিডরে। আর পড়ে লাদাখে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে ভেঙে জম্মু, কাশ্মির ও লাদাখকে তিনটি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার পর থেকেই বিইজিংয়ের উদ্বেগ আরো বেড়ে গিয়েছে। কারণ, এর ফলে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে ভারতীয় লাদাখের ‘বাগড়া’টা বেইজিংয়ের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কিরঘিজস্তানে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পি স্তোবদান বলেছেন, ‘‘চীন পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডর বানাচ্ছে ভারত মহাসাগরে নিজের সামরিক প্রভূত্ব সার্বিক ভাবে গড়ে তুলতে। তাই লাদাখকে নিজের হাতে রাখার দরকার বেইজিংয়ের। সে জন্যই এ বার যেকোনোভাবে লাদাখে ঢুকে পড়তে চাইছে চীন। লাদাখের উপর তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি কায়েম করতে চাইছে।’’

২০১৭ ও ২০১৮-য় চীনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা গৌতম বাম্বাওয়ালে জানাচ্ছেন, দোকলামের ঘটনা থেকে চীনও অনেক কিছু শিখেছে। ওরা জানত, সংবাদমাধ্যমে ঢাকঢোল না পিটিয়ে পূর্ব লাদাখে সেনা ঢোকালে ভারত চীনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। তাই এ বার সেনা ঢুকিয়েই বেইজিং বলতে শুরু করে, এলাকায় গত ৫ মে থেকে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণ, ভারতীয় সেনারাই। তারাই ঢুকে পড়েছিল চীনা এলাকায়। তাদের পিছু হঠাতেই পূর্ব লাদাখে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৫০ চীনা ও ভারতীয় সেনা। যা গড়ায় পরের দিন পর্যন্ত। দু’পক্ষের মধ্যে বৈঠকের পরে কিছুটা স্বস্তি ফেরে এলাকায়। কিন্তু তার তিন দিনের মাথায় গত ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শতাধিক ভারতীয় ও চীনা সেনা। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব সেই সময় চীনা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

বাম্বাওয়ালের কথায়, ‘‘এ বার আগের চেয়ে অনেক সংযত থাকতে পেরেছি। বার বারই বলে এসেছি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানো হোক। কিন্তু বেইজিং সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। অথচ, এই সমস্যার সমাধানের একমাত্র রাস্তাই হল দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা।’’

তবে ম্যাসাটুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক টেলর ফ্রাভেলের বক্তব্য, ‘‘এ বার বেইজিং কোনো হুমকি দেয়নি। কোনো কড়া কড়া কথা বলেনি। শুধু এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারত যে ভাবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত পৌঁছনোর কাজটা আগের চেয়ে অনেকটা সহজ করে ফেলেছে, চীন সেটা আদৌ মেনে নিতে পারেনি। তাই পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে নিয়ন্ত্রণরেখায় তাদেরও কর্তৃত্ব কায়েম করতে সচেষ্ট হয়েছে। আর সে জন্যই যে গালোয়ান উপত্যকা নিয়ে এত দিন কোনো বিরোধই ছিল না দু’দেশের মধ্যে, এ বার সেই গালোয়ানেই প্রচুর সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে বেইজিং। কারণ, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে এই গালোয়ান পর্যন্ত সড়কপথ বানিয়ে ফেলেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তৈরি করে ফেলেছে আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোও।’’

এ বারের অনুপ্রবেশ কি আগের চেয়ে আলাদা?

২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত চীনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা অশোক কে কণ্ঠ মনে করেন, এ বার চীনা সেনারা যে ভাবে ঢুকে পড়েছে পূর্ব লাদাখের বিভিন্ন এলাকায় আগে তেমনটা ঘটতে দেখা যায়নি।

কণ্ঠ জানাচ্ছেন, প্রথমত, এর আগে এত বেশি সংখ্যায় চীনা সেনা এত অল্প সময়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েনি।

দ্বিতীয়ত, এ বার চীনা সেনারা অনেক বেশি সংখ্যক ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়েছে, যা এর আগে কখনো হয়নি। তারা গালোয়ানের মতো একটি নতুন এলাকায় ঢুকেছে।

তৃতীয়ত, তারা ওই সব এলাকায় তাঁবু খাটাচ্ছে, বাঙ্কার বানাচ্ছে।

চতুর্থত, চীনা সেনাদের মনোভাবও এ বার অনেক বেশি আগ্রাসী।

চীনে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মনে করছেন, এ বার যে শুধুই কয়েকটা ভারতীয় এলাকায় ঢুকে চীনা সেনা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে, তা নয়; বরং তাদের এই প্রচেষ্টার ইঙ্গিত মিলেছে অনেক বৃহত্তর এলাকা জুড়ে। আর এটা করার জন্য চীনা সেনাদের কাছে বেইজিংয়ের কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই, এটা মনে করাটা বিচক্ষণতার কাজ হবে না।

ফ্র্যাভেলের ধারণাটা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তার কথায়, ‘‘চীনের উহানে কোভিড-১৯-এর উৎপত্তি ও তার জেরে চীনা অর্থনীতির পিছু হটায় কিছুটা দমে যাওয়া বেইজিংয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কোনো সীমান্তে তার শক্তিপ্রদর্শনের। এ বার পূর্ব লাদাখের ঘটনা ঘটেছে হয়তো তারই প্রেক্ষিতে।’’

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us