এখন কোন পথে যাবে আফগানিস্তান?
গনি ও আবদুল্লাহ - সংগৃহীত
আফগানিস্তানে ২০০১ সালের পর যে চারটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্য কেবল একটিই নির্বিঘ্নে হতে পেরেছিল। বাকি তিনটিই রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে কিংবা এরপর ক্ষমতা ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে এর অবসান ঘটাতে হয়েছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের ফলাফল হামিদ কারজাইয়ের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ গ্রহণ করেননি, তিনি নির্বাচনকে জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আশরাফ গনিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, আবদুল্লাহ আবার ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। এই অবস্থা অবস্থানের জন্য জাতীয় ঐক্য সরকার গঠিত হয়। এরপর গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে একই প্রতিদ্বন্দ্বি গনি ও আবদুল্লাহর মধ্যে আরেকটি জোট সরকার গঠিত হয়েছে। কয়েক মাসের আলোচনার পর আবদুল্লাহ শান্তিপ্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব এবং মন্ত্রিসভায় ৫০ ভাগ আসন পেয়েছেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনটি ঘিরে জাতিয়াতি আর প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও আফগানিস্তানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর নজিরবিহীন ঘটনা। আবার পাশ্চাত্যে শিক্ষিত কোনো টেকনোক্র্যাটের দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়াও নজিরবিহীন। আফগানরা আশা করেছিল যে উপজাতীয় নেতাদের সাথে সম্পর্ক না থাকার ফলে এই ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্য তার অভিজ্ঞতা বেশ ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা বেদনাদায়ক বিস্ময়ের মুখে পড়ে।
পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, জাতীয় ঐক্য সরকার গঠনের আগের বছরগুলোতেই আফগানিস্তান তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। তখন বিদ্রোহ থাকলেও তা অস্তিত্ব সঙ্কটের সৃষ্টি করেনি, অর্থনীতিও এর চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে বেশির ভাগ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করেছিল জাতীয় ঐক্য সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগ দিয়ে। এর ফলে জাতীয় ঐক্য সরকারের আমলে তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা সম্প্রসারণ করে। তারা তিনটি প্রাদেশিক কেন্দ্র দখল করতেও সক্ষম হয়।তারা আফগানিস্তানের অন্যান্য এলাকার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে। ২০০১ সালের পর এখনই তারা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। বেসামরিক নাগরিক ও আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক হারে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত বছর এক সাক্ষাতকারে প্রেসিডেন্ট গনি স্বীকার করেছিলেন যে ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধে ৪৫ হাজারের বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে।
ঐক্য সরকারের আমলে হাজার হাজার আফগান অন্যান্য দেশে চলে গেছে, অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছৈ ১,১৭৪,৩০৬ জন। জাতীয় ঐক্য সরকারের আমলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী আফগানের হার ৩৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫ ভাগ।
জাতীয় ঐক্য সরকার হতাশায় পরিণত হওয়ার কারণ ছিল, এতে আর যাই থাকুক, ঐক্য ছিল না। এটি অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত, দুর্নীতি, সহিংসতায় জর্জরিত ছিল। নির্বাচনী সংস্কার, লয়া জিরগা সংগঠিত করা, নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা, জেলা নির্বাচন করার মতো কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করা হয়নি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় ঐক্য সরকারের দেযা ১৮টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে প্রথম তিন বছরে মাত্র একটি বাস্তবায়িত হয়েছে। গণতন্ত্র, সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা এই সরকার শেষ করে দিয়েছে। সরকার ও জনগণের মধ্যকার ব্যবধান আরো বেড়েছে।
চুক্তি তদারকি ও বাস্তবায়ন
তবে এবারের ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তিটি ঐক্য সরকারের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে। এতে তদারকির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে একটি তদারকি ও মধ্যস্ততাকারী কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তারা যদি এটি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে আসতে পারে।
নির্বাচনী সংস্কার
২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৯২ ভাগ আফগান মনে করে, ওই বছরের নির্বাচনটি ছিল জালিয়াতিপূর্ণ। ফলে নির্বাচনী সংস্কারের দাবি ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শীর্ষ দুই নেতার কারোই নির্বাচনী সংস্কারে মনোযোগ ছিল না। এখন সরকার যদি আশা করে যে আগামী নির্বাচনে আরো বেশি আফগান তাতে অংশ নেবে, তবে নির্বাচনী সংস্কার করতেই হবে।
চুক্তি অনুযায়ী জেলা ও মেয়র নির্বাচন আয়োজন করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। লয়া জিরগার কোরাম পূর্ণ করার জন্য জেলা পরিষদের নির্বাচনগুলো করা দরকার।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
বর্তমান জোট সরকার আফগানিস্তানের জন্য তেমন সহায়ক হচ্ছে না। শীর্ষ নেতৃত্ব নিজ নিজ প্রভাব বিস্তারের কাজই কেবল করছেন। ফলে দুর্নীতি, সহিংসতা বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে এবং আফগানিস্তানের বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগত অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণই হতে পারে সমাধান। নতুন সরকার এই কাজটির মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করতে পারে।
পার্লামেন্টের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা
জাতীয় ঐক্য সরকার পার্লামেন্ট থেকে তেমন সমর্থন পায়নি। বরং পুরো আমলে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ বরং বেড়েছে। জাতীয় ঐক্য সরকারের অর্ধেক মন্ত্রী প্রথম দুই বছর পার্লামেন্টে আস্থা ভোট পাননি। এমনকি মন্ত্রীরা যখন আস্থাভোট পেয়েছেন, তখন অভিযোগ ওঠেছে যে তারা আইনপ্রণেতাদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিয়ে কাজটি করেছেন। নতুন সরকারের সামনে সুযোগ এসেছে আফগান জনগণের কল্যাণের জন্য পার্লামেন্টকে কাজ করার সুযোগ দেয়া।
এসব কাজ করা হলে গণতন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়বে, আফগানিস্তানকে আরেকটি রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
দি ডিপ্লোম্যাট