ঈদ ব্রিটিশ স্টাইল : জানালা দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়
ঈদ ব্রিটিশ স্টাইল : জানালা দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় - সংগৃহীত
এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে সারা বিশ্বের মতো ব্রিটেনের মুসলিমদের জীবনেও ঈদ উল ফিতর আনন্দ আর খুশি বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু করোনার কারনে ঈদের এই আনন্দ ছিলো অন্যান্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম। প্রতিবছরের মতো এবার ব্রিটেনের মুসলিমদের ছিলো না দল বেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া, ছিলো না নামাজ শেষে মুসলিম ঐতিহ্য অনুযায়ী একে অপরের সাথে কুলাকুলি আর এক মুসলিমের বাসায় অপর মুসলিমের খাওয়া দাওয়া। ঈদের নামাজ এবং খাবারের বিশেষ আয়োজন হলেও সবই ছিলো চার দেয়ালের ভেতর, পারিবারিক গন্ডিতেই।
প্রায় দুই হাজার মসজিদ অধ্যুষিত ব্রিটেনে প্রায় ৪৫ লাখ মুসলিমের বাস। রাজধানী লন্ডন ছাড়াও বার্মিংহাম, ওল্ডহ্যাম, ব্র্যাডফোর্ড, বল্টন, সোয়ানসিসহ কয়েকটি শহর মুসলিম অধ্যুষিত। আর সেসব শহরে তুলনামুলক বেশি মসজিদ থাকায় ঈদের নামাজ শেষে ওসব এলাকায় তৈরী হতো এক ভিন্ন পরিবেশের। ব্রিটেনের অধিকাংশ মসজিদে নারী পুরুষের নামাজের ব্যবস্থা আছে। তাই ঈদের দিন যখন ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাকে নারী-পুরুষ একসাথে ঈদ জামাতের উদ্দেশে মসজিদে যেতো এবং নামাজ শেষে বাসায় ফিরত তখন মনে হতো ওসব এলাকা মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ। অনেক শহরে খোলা মাঠে ও পার্কে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা থাকায় সেসব এলাকা মুসলিম মিলনমেলায় পরিণত হতো।
কিন্তু সারা বিশ্বের মতো ব্রিটেনেও করোনার করুন থাবায় প্রায় দুই মাস লকডাউনে আটকে আছে এখানকার মানুষ। একারনে এখানকার মুসলমানরা রমজানেও যেতে পারেনি মসজিদে। রমজানে তারাবিসহ বিশেষ ইবাদত বাসায় আদায় করতে হয়েছে ব্রিটেনের মুসলিমদের। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে তাদের জীবনে খুশির বার্তা ঈদ উল ফিতর এলেও তারা সেই আনন্দ সরাসরি ভাগাভাগি করতে পারেনি প্রতিবেশি বা অন্য মুসলিমদের সাথে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো এজন্য তাদের সহায়তা নিতে হয়েছে প্রযুক্তির।
ইয়ার ফোরে পড়ুয়া নটিংহামের ব্রিটিশ বাংলাদেশি সাদাকাত ইসলাম রাকিন প্রতিবছর বাবার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে একই এলাকায় বাস করা চাচার বাসায় বেড়াতে গিয়ে মিষ্টি মুখ করা আর কাজিনের সাথে খেলা করা নিয়মে পরিণত হয়েছে তার। ঈদের পর কোনো কোনো সময় লন্ডনে বাস করা আরেক কাজিনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া হতো তাদের। কিন্তু এবছর চিরাচরিত স্বাভাবিকতা ভেঙ্গে দিয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাস। ছোট বোন আর মায়ের সাথে বাবার ইমামতিতে বাসায় ঈদের নামাজ হয়েছে এবার। নামাজ শেষে মিষ্টিসহ মায়ের হাতের ঈদের বিশেষ খাবারও হয়েছে। কিন্তু স্বজনদের সাথে দেখা করতে যেতে পারেনি রাকিন। এমনকি প্রতিবেশী কোনো বন্ধুর সাথেও। লন্ডনে বাস করা কাজিনের সাথে ঈদ উপলক্ষে ছবি তোলা হয়েছে ঠিকই তবে তা ভার্চুয়াল। এমনকি নটিংহামের কাজিনের সাথেও আড্ডা হয়েছে একই প্রযুক্তিতে।
লন্ডনের ডেগেনহামে এক মুসলিম সলিসিটর বাস করেন স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে। প্রায় দুই মাস লকডাউনের সময় বাসা থেকে তেমন বের হননি তিনি। তবে আট বছর বয়সী বড় মেয়ে ও স্ত্রীর অনুরোধে ঈদে বাসা থেকে সপরিবারে বের হন সহকর্মীর বাসার উদ্দেশে। লেইটনস্টোনে বাস করা সহকর্মীর বাসায় বেড়াতে গেলেও, ওই বাসায় প্রবেশ করেননি। গাড়িতে আড়াই মাস বয়সী ছেলে ও দুই বছর বয়সী ছোট মেয়েকে নিয়ে বাসার পাশে অবস্থান করেন তারা।
সহকর্মীর মেয়ে উনার বড় মেয়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হলেও দু‘জনের সাক্ষাৎ হয়েছে শুধু জানালা দিয়ে একে অপরকে দেখে। ছিলো না একে অপরের সাথে পুতুল খেলা ও খেলার মাঝে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্বের অভিব্যক্তি। জানালা দিয়েই চলে দু’পরিবারের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। ছোটদের গল্প ও বড়দের কথোপকথনের মাঝে গাড়িতে চলে ঈদের গান। বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে খেলতে না পারার কষ্ট ওদের কাছে সহনীয় হয়ে গেছে দু’মাস লকডাউনে থেকে। মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরেই ঈদের উপহার বিনিময় হয় দু’পরিবারের। এভাবেই চলতে থাকা ঈদের আড্ডা শেষ হয় আগামীতে কোনো এ সময় দু‘পরিবারের সাক্ষাতের প্রত্যয় নিয়ে, যখন থাকবে না কোন করোনাতঙ্ক।
ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশনা মেনে দেশটির মুসলমানরা এ বছর ঘরেই ঈদের নামাজ পড়েছে। কয়েকটি মসজিদে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা ছিলো হোয়াটসঅ্যাপে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। দেশটিতে এই প্রথম ঈদের জামাত হচ্ছে না বলে জানান দেশটির ধর্মীয় নেতারা। রোববার ঈদের দিন বন্ধ ছিলো ব্রিটেনের সব মসজিদ ও ঈদ জামাতের স্থান। কোথাও ছিলো না সবার প্রিয় ‘ঈদ ইন দ্যা পার্ক ’ সেলিব্রেশন, এর পরিবর্তে কোনো কোনো বাড়িতে হয়েছে ‘ঈদ ইন দ্যা বেক গার্ডেন ’।
মুসলমানরা নিজ পরিবার নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন বাসায় বা বাড়ির গার্ডেনে। রং বেরংয়ের পোশাক পরে রাস্তায় ছিলো না ছোট্ট বাচ্চাদের চলাচল, ছিলো না সেই চিরপরিচিত ঈদ আলিঙ্গনের দৃশ্য। ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম ছিলো টেলিফোন কল, ওয়াটসআপ, জুম, ম্যাসেঞ্জার, হাউস পার্টিসহ সোস্যাল মিডিয়া।
পরিবারকেন্দ্রিক এই ঈদে স্বজনের সাথেও ছিলো না সাক্ষাত বা আড্ডার সুযোগ। সেমাই পায়েশ সামনে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে ছিলেন শুধুই পরিবার সদস্যরা, ছবি তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেই ছিলো ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের একমাত্র অবলম্বন। ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে কেউ এসে কলিংবেল টিপেনি কারো দরজায়। শান্তি, সমৃদ্ধির চেয়ে ঈদ মোনাজাতে শুধুই শোনা গেছে কোভিড-১৯ নামক ঘাতক শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ কাছে করুনা প্রার্থনা।
পারিবারিক আয়োজন ছাড়াও ঈদ উপলক্ষে ব্রিটেনের বিভিন্ন কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রোববার ঈদের দিন লন্ডনের মেসেজ কালচারাল ফোরাম নামে বাংলাদেশী একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন অনলাইনে ইসলামি নাশিদের আয়োজন করে। মুসল্লিরা বাসায় বসে পরিবার নিয়ে ওই অনুষ্ঠান উপভোগ করে। আবার বল্টনের ভারতীয় কমিউনিটির একটি ইসলামি সংগঠন অনলাইনে ইসলামি গান ও ইসলামি লেকচারের আয়োজন করে। একই ভাবে লন্ডনে ও বার্মিংহামে বিভিন্ন সংগঠন অনলাইনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
পূর্ব লন্ডনে ঈদ উপলক্ষে এক ইসলামি সঙ্গিত শিল্পী দুই বন্ধুসহ গিয়েছিলেন তারই পরিচিত এক সাংবাদিকের বাসায় দেখা করতে। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে তাদের মধ্যে তবে তা ছিল পুরোই ভিন্ন রকম। সাংবাদিকে বাসার জানালা দিয়ে তাদের চটপটি দেয়া হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে তারা চটপটি উপভোগ করেন কোনো রকম অভিযোগ ও অভিমান ছাড়াই। কারণ এখন ওই পরিবেশ নেই, করোনা মানুষকে অস্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিক মনে করতে বাধ্য করেছে। চটপটি শেষে তারা সেমাই ও দই খেয়েছে আরো মজা করেছে। মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে তাদের একটু অসুবিধা হলেও ছিল না কোনো অস্বস্তি। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল করোনাকালে যেনো এটাই স্বাভাবিক। অনেক পরিবার ঈদ উপলক্ষে পাশের কোনো পার্কে গিয়ে সময় কাটিয়েছেন পরিবার নিয়ে, সাথে ছিলো ঈদের খাবার। অনেকে একটু ঝুঁকি নিয়ে পরিচিত কারো বাসায় গিয়েছিলেন ঈদের দাওয়াতে। তাদের মনে ছিলো ব্রিটেনে করোনায় মৃতের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, আর জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ, এই ভরসা।
ঈদ খুশি ও আনন্দের হলেও অনেক ব্রিটিশ মুসলিমের জন্য এ দিন ছিলো দুঃখের ও শোকের। করোনার কারণে অনেকে প্রিয়জনের সাথে দেখা করতে না পেরে ভীষণ কষ্টে বাসায় সময় কাটিয়েছেন। অনেকের রক্তের সম্পর্কের স্বজনের সাথে নিজ দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে সব ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সে পরিকল্পনায় ভাটা পড়ে। আবার অনেকের প্রিয়জনের কবর ব্রিটেনে হলেও করোনার কারণে কবর জিয়ারতে যেতে পারেননি। খুশির পরিবর্তে তাদের মনের গহীন থেকে শুধুই বেরিয়ে এসেছে কান্না ও শোক। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- কবির এই গানের কলি যেন একটু পরিবর্তিত হয়ে অনেকের ভেতরেই গুঞ্জরিত হচ্ছিল ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো শোকের ঈদ ’। কারণ এই ঈদে অনেক পরিবারই ছিলো স্বজনহারা। কিছুদিন আগে যাদের কোনো না কোনো সদস্যকে কেড়ে নিয়েছে ঘাতক অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯।