প্রিয়াঙ্কা ও ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ
প্রিয়াঙ্কা - সংগৃহীত
রাহুল গান্ধী মানুষটাকে আমার ভালো লাগে। খুব জটিল চরিত্র নন। রাজনৈতিকভাবে দেশ চালানোর জন্য এখন যেসব গুণ লাগে, তা অর্জন করেছেন বলে আমার মনে হয় না। সবসময় ভাবি, স্কুলের ক্লাসরুমে এসে বাড়ি থেকে নিরাপত্তা কর্মীরা যদি খবর দেন, তোমার বাবাকে সন্ত্রাসবাদীরা জঘন্যভাবে হত্যা করেছে, এবং সে কথা শুনে এক নরম মনের বালক বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে তার মনস্তাত্ত্বিক পরিণতি কী হতে পারে? আর বোন প্রিয়াঙ্কা (যদিও আজও অনেকে ভাবেন দিদি), তাঁকে মনে হয়, বোধহয় আজকের রাজনীতির নত্ত্ব-সত্ত্ব জ্ঞানগম্মি তার বেশি।
১০ জনপথে প্রিয়াঙ্কার বিয়ে কভার করতে গেছিলাম। অমিতাভ বচ্চন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। আমাদের সাংবাদিকদের জন্য পাশেই একটা এনক্লোজার ছিল। সেদিন থেকে অধিকাংশ ভারতীয় পুরুষের মতো আমরাও খুব অপছন্দ রবার্ট ভাদরাকে। এহেন পেশিবহুল রুক্ষ পুরুষটি প্রিয়াঙ্কার জন্য অনুপযুক্ত মনে হয়েছিল। আর আজ তো প্রিয়াঙ্কার রাজনীতিতে আসা-না-আসাও অনেকটাই নির্ভর করছে এই রবার্ট ভাদরা ফ্যাক্টরের ওপর।
যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীত থাক। আলোচনা করতে চাইছি সাম্প্রতিক করোনা কাণ্ডে প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক পরিপক্কতা এবং ভিন্ন মানসিকতার। এই মানসিকতা নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক, কিন্তু এই ঘটনা থেকে আজ কংগ্রেস নামক শতাব্দীরও অধিক প্রাচীন সর্বভারতীয় দলটির অবস্থা টের পাওয়া যায়।
ঘটনাটি শুনুন প্রথমে। প্রিয়াঙ্কা প্রথমে ঘোষণা করলেন, কংগ্রেস ১,০০০টি বাস ভাড়া করে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজস্থান ও দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। এরপর বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। এবার টুইটের মাধ্যমে প্রিয়াঙ্কা অভিযোগ করলেন, উত্তরপ্রদেশের সরকার বাসগুলোতে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কংগ্রেসকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। যোগীজি, মানে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, করোনার সময় দয়া করে বাস নিয়ে রাজনীতি করবেন না। পরদিন মুখ্যমন্ত্রী যোগী টেলিভিশন চ্যানেলে বললেন, “প্রিয়াঙ্কাজি টুইটের মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন বটে, কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন পত্র পায়নি।”
করোনা কান্ডের সময় বাস-ট্রেনের মাধ্যমে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার অনেকগুলো পদ্ধতিগত বিষয় আছে। নিয়ম কানুন। একথা সত্য যে এতে বেশ আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের বাঁধন আছে। এ পদ্ধতি পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে সরল হওয়া আবশ্যক, সেকথা পরে বলছি। কিন্তু এটা মানতে হবে, একটা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে গেলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে গাড়ি বা বাসের রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিতে হয়। গাড়ির চালকের লাইসেন্স নম্বর দিতে হয়। তার সঙ্গে রাজ্যে তাকে ১৪ দিন কোয়ারান্টিনে রাখা এবং টেস্ট করানোর বিষয় যুক্ত থাকে।
যা হোক, যোগী যখন বললেন, তখন প্রিয়াঙ্কা কংগ্রেস নেতাদের ডেকে পাঠিয়ে ১,০০০ টি বাসের সবিস্তার তথ্য লিখিতভাবে চাইলেন। কংগ্রেস কর্মীদের কাণ্ডকারখানায় ততক্ষণে তিনি বেশ বিরক্ত। কারণ নিচুতলার কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রিয়াঙ্কা রাজনীতি করছেন, কথা বলছেন।
প্রিয়াঙ্কা সততার সঙ্গে এবার যোগীকে জানালেন যে তিনি সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই ১,০০০ টি বাস-এর যাবতীয় লিখিত তথ্য দিচ্ছেন। আর এক দিন পরে, অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে, চালকের নাম ও লাইসেন্স-এর বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছেন। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে সত্যি সত্যি যোগী ১,০০০টি বাসের তালিকা পেলেন। তিনি তা পাঠালেন পরিবহন দপ্তরে ছাড়পত্রের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে রিপোর্ট এল, এই ১,০০০টি রেজিস্ট্রেশন নম্বরের মধ্যে ২০০টি বাস, বাকিগুলো টু-হুইলার এবং বহু ভাড়া করা বেসরকারি আম্বুল্যান্স।
যোগী তখন ফের প্রিয়াঙ্কাকে জানালেন, এই তালিকায় গোলমাল আছে। প্রিয়াঙ্কা আরো চটে গেলেন। ডেকে পাঠালেন কিছু কংগ্রেস নেতাকে। এবার কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করলেন, বেসরকারি বাস ইউনিয়নগুলোকে যোগী নিয়ন্ত্রণ করছেন। কংগ্রেসকে কেউ বাসই দিচ্ছে না। এ তথ্য হাইকমান্ডের কাছে নিচুতলার কর্মীরা ভয়ে গোপন করে।
অগত্যা পরদিন ঠিক হয়, পাল্টা রণকৌশল হলো, আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ সীমান্তে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা ধর্না ও বিক্ষোভে সামিল হলেন। চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, যোগী সরকার রাজনীতি করছে। কংগ্রেসকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসে করে নিয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না। প্রিয়াঙ্কা আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হলেন। অবশেষে ২১ মে বাতিল হলো গোটা পরিকল্পনাই।
হে পাঠক, ঘটনাটি শোনার পর আপনার কী মনে হচ্ছে? আমি এটিকে বর্তমান কংগ্রেসের ‘অ্যানাটমি’ বোঝার জন্য একটা নমুনা, ‘কেস স্টাডি’ হিসেবেই দেখছি। একেই বলা হয়, বিন্দুতে সিন্ধু। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, এই ঘটনা থেকে প্রিয়াঙ্কা নিশ্চয়ই বুঝতে পারলেন, আজ তার দলের অবস্থাটা কেমন। যোগীর শাসক শক্তির জন্য যদি বাস মালিকদের উপর দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তার জন্য শাসকদলের চিরকালীন দৌরাত্ম্য যেমন দায়ী, তেমন তাকে জনপ্রিয়তা ও সংগঠন দিয়ে ভাঙ্গাও তো কংগ্রেসের কাজ। সমাজবাদী পার্টিও আজ ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তাদের যাদব-মুসলমান ভোটব্যাংকে ক্ষয় হলেও আছে অনেকটাই। তাই জেলায় জেলায় আজও সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে বিজেপির সংঘর্ষ-মারামারি হচ্ছে।
করোনা দুর্যোগে বারবার সবাই বলছেন, ‘নো পলিটিক্স প্লিজ’। দোহাই, রাজনীতি নয়। কিন্তু এখন তো সকলেই বুঝছেন, গোটা ভারতজুড়ে মিডিয়ার কল্যাণে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যাটা এক দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সব দলই রাজনীতিতে নেমে পড়েছে। কে কতদূর মজদুর প্রেমী তার প্রমাণ দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সাগিনা মাহাতো হত্যা চাইছেন সবাই, আকস্মিক। আর টিভিতে, সংবাদপত্রে আমরা কি দেখছি, কী পড়ছি?
দেখলাম, এক দম্পতি দুটি ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে নয়াদিল্লি স্টেশনের সামনে বাক্স-পেটরা নিয়ে দাঁড়িয়ে। একদম সর্বহারা নয়। গাজিয়াবাদে কারখানায় কাজ করতেন। বেতন পান নি দু’মাস। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। তাই বাড়ি ছেড়ে এলাহাবাদের জন্মভিটেতে ফিরতে চান। গুজব শুনেছিলেন, এলাহাবাদের ট্রেন পাওয়া যাবে। তাই হেঁটে হেঁটে স্টেশনে চলে এসেছেন। এসে দেখছেন, কোনও ট্রেন নেই। এদিকে এখন ফিরবেন কোথায়? তাই ঠিক করেছেন, হেঁটে হেঁটে এলাহাবাদ যাবেন। টিভির পর্দায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের এই দম্পতিকে দেখে চোখের জল আটকানো কঠিন।
আর একটা জায়গায় পড়লাম, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত এক শ্রমিক পরিবার হাতজোড় করে পুলিশের কাছ থেকে একজোড়া চটি চাইছে। পায়ে ফোস্কা পড়ে গর্ত হয়ে গেছে। নিজের জন্য নয়, মা চটি চাইছেন তার কিশোর-কোমল ছেলেটির জন্য।
এসব ঘটনা এখন আমরা সবাই নিয়মিত পড়ছি আর টিভিতে দেখছি। আমরা কী করতে পারি? সরকার বাহাদুর বলতে পারেন, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের বেতন কেটে তার একটা অংশ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করবেন। এ প্রস্তাবে আমরা মধ্যবিত্ত সমাজ কতটা রাজি হব, জানি না। উল্টে রাজশক্তির সমালোচনাতেই মুখর হব। প্রশ্ন তুলব, সরকার এ টাকা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গরীব শ্রমিকদের যে দেবে, তার গ্যারান্টি কোথায়?
আমরা এক বিপন্ন সময়ে বসবাস করছি। আহমেদাবাদ, মুম্বই, ভোপাল, আর ইন্দোরে করোনার প্রবল প্রকোপের জন্য অগ্রিম মাটি খুঁড়ে কবর তৈরি করে রাখা হচ্ছে। প্রতিটি কবরস্থানে এই দৃশ্য। ইমামরা বলছেন, এত মৃত্যু যে জায়গার অভাব হচ্ছে। করোনায় মৃত ব্যক্তিকে প্লাস্টিকে মুড়ে কবরস্থানে পাঠানো হচ্ছে। লাশ বেশিক্ষণ রাখা যায় না।
এসব যখন শুনছি, দেখছি, তখন কংগ্রেসের ১,০০০টি বাসের কাহিনী দেখে দুঃখ হচ্ছে। সোনিয়া গান্ধী বলেছিলেন, রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস টাকা দিয়ে ট্রেনে নানা রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠাবে। এখন তো সরকারই ট্রেন-বাস দিচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে তাদের জনসেবার নমুনা দেখলাম কই? পশ্চিমবঙ্গে মমতা বাধা দিচ্ছেন, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সততার সঙ্গেই রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘটনায় তিনিও নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে, তাঁর দল বাস্তবের মাটিতে কোথায় দাঁড়িয়ে!
এ ঘটনা যে নিছক ঘটনা নয়, তা আশা করি এতদিনে ভারতীয় রাজনীতিকরা বুঝতে পারছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের দৃশ্যগুলো তো নেহাত ঘটনা নয়, ওগুলো তাদের জীবন যুদ্ধ। ঠাণ্ডা ঘরে টিভির পর্দায় হয়ত সেই যুদ্ধের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। আর একটা কথা, শুকনো রুটিতে লেগে থাকা রক্তের দাম হয়তো যেকোনো দৈনিক সংবাদপত্রের চেয়ে অনেক কম, কিন্তু তাদের আরো একটু সম্মান প্রাপ্য কাগজের পাতায় বা টিভির পর্দায়। এমনিতে তারা আমাদের চেয়ে বেশি আত্মনির্ভরশীল। আমার কোনো আত্মীয়ের কিছু হলে আমি এখানে বসেই চোখের পানি ফেলব। ওদের মতো ১,০০০/১,৫০০ কিমি হেঁটে পাড়ি দেয়ার সাহস বা সাধ্য আমার নেই। তাই বলছিলাম, তাদের আর একটু বেশি সম্মান প্রাপ্য।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস