কতটা ভয়াবহ করোনাভাইরাস?
করোনাভাইরাস - সংগৃহীত
বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস হলো অদৃশ্য ঘাতক। কেড়ে নিচ্ছে লাখ লাখ প্রাণ। ফলে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? এটি এমন প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র যা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু যখন এটি আক্রান্ত করে, এর চিকিৎসা করানোও প্রায় ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।
আর তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে ভয় পায়। এমনকি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতেও ভয়ের শেষ নেই।
মানুষ নিরাপদ থাকতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আগের মতো আমরা এখন আর নিরাপদ নই। নতুন একটি ভাইরাস আমাদের চারপাশে রয়েছে যা ভয়ংকর পরিণতির কারণ হতে পারে।
ঝুঁকি মোকাবেলায় ভারসাম্য
তাহলে আমরা আসলে কী করতে পারি? অনেকে যুক্তি দিয়ে বলছেন যে, সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকতে হবে। কিন্তু এসব যুক্তিতে যে বিষয়টি থাকে না তা হলো নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার মধ্যে এক ধরণের ঝুঁকি থাকে।
যুক্তরাজ্যের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অধ্যাপক ক্রিস উইটি প্রায়ই এই বিষয়টিকে মহামারির "পরোক্ষ মূল্য" বলে অভিহিত করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়া অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, আর্থিক টানাপোড়েন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতি।
আর তাই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলে জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা বিদ্যমান ঝুঁকির সাথে কিভাবে ভারসাম্য করে চলা যায়।
শতভাগ সুরক্ষার আশা কেন করা যায় না
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক দেবী শ্রীধর বলেন, যে প্রশ্নটি তোলা দরকার তা হলো আমরা কি আসলেই "যথেষ্ট সুরক্ষিত" কিনা।
"কোন ঝুঁকি থাকবে না- এমন কোন সময়ই আসলে আসবে না। এখন যখন সমাজে কোভিড-১৯ এর মতো রোগ রয়েছে সেখানে আমাদের ভাবতে হবে যে ঝুঁকি কিভাবে কমানো যায়। যেরকমটা আমরা অন্যান্য দৈনন্দিন বিপদের সাথে মোকাবিলা করে থাকি যেমন গাড়ি চালানো বা সাইকেল চালানো।"
তিনি আসলে স্কুল নিয়ে এসব কথা বলেছিলেন, কিন্তু এই ধারণা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
তিনি বলেন, এই পুরো বিষয়টির একাংশ নির্ভর করে সরকারের উপর যেমন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম নিশ্চিত করা, পরীক্ষা করানোর সুব্যবস্থা এবং মহামারি নিয়ন্ত্রণে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা করা। মহামারি মোকাবেলায় সরকারি পদক্ষেপের সমালোচক তিনি।
ব্যক্তিগত ঝুঁকি কতটা?
মানুষ যেহেতু আগের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছে, তাই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি এখন বেশি করে সামনে আসতে শুরু করেছে।
বিষয়টি এমন নয় যে, সঠিক উপায়টি খুঁজে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হবে, বরং সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ পথটি অবলম্বন করতে হবে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুঁকি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং পরিসংখ্যানবিদ অধ্যাপক স্যার ডেভিড স্পিজেলহল্টার যিনি একই সাথে সরকারেরও একজন উপদেষ্টা তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি আসলে "ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার" বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই যে পরিমাণ ঝুঁকি আমরা মোকাবিলা করি তার উপর একটি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
করোনাভাইরাসের ঝুঁকি দুই রকমের হতে পারে- একটি হচ্ছে আমাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার পর মারা যাওয়া বা মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি।
দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি চার শ' জনের মধ্যে একজন করোনাভাইরাস সংক্রমিত।
তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে ওই সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি খুবই কম। সাথে আশা করা যায় যে, সরকার যদি পরীক্ষা, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা মানুষের খোঁজ বা কন্টাক্ট ট্রেসিং কর্মসূচী সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয় - তাহলে এই ঝুঁকি আরো কমে যাবে।
আর আমরা যদি সংক্রমিত হইও - তাহলেও বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের হয়। প্রতি ২০ জনের মধ্যে মাত্র একজনের এমন ধরণের উপসর্গ দেখা দেয় যার কারণে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে হতে পারে।
ঝুঁকি পরিমাপের উপায় কী?
যাদের আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে তাদের ঝুঁকি বেশি। গবেষণা বলছে, ৬৫ বছরের নিচে যাদের মধ্যে কোন উপসর্গ থাকে না তাদের মৃত্যু "খুবই অস্বাভাবিক" অর্থাৎ হয়না বললেই চলে।
সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করা যে, আগামী এক বছরের মধ্যে মারা যাওয়া নিয়ে আপনি কতটা উদ্বিগ্ন।
পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণে ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে এক জন আগামী বছর তার জন্মদিন দেখতে পারবে না অর্থাৎ এই সময়ে তার মারা যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এটা হচ্ছে গড় ঝুঁকি- তবে বেশিরভাগ মানুষের এই ঝুঁকি আরো কম কারণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন যাদের আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে।
তাই করোনাভাইরাস সব ধরণের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে এবং তা আরো বেশি বাড়িয়ে তুলছে। বিষয়টা এমন যে, খুব সময়ের মধ্যেই অতিরিক্ত এক বছরের ঝুঁকি বেশি নিতে হচ্ছে।
আপনার ঝুঁকি যদি শুরু থেকেই কম থাকে, তাহলে তা বছর জুড়েই বলবৎ থাকবে।
যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তুলনায় ক্যান্সার বা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস মহামারিতে এ পর্যন্ত ১৫ বছরের কম বয়সী মাত্র ৩ জন মারা গেছে। এর তুলনায় প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৫০ জন।
কারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে?
যদি আমরা ঝুঁকির হারে ভারসাম্য আনতে চাই তাহলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা এবং আমি সেই দলে পড়ি কিনা বা আমার আশেপাশে সেরকম কেউ রয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করা।
বর্তমানে সরকার ২৫ লাখ মানুষকে সম্পূর্ণভাবে আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যান্সার কিংবা মারাত্মক বক্ষব্যাধির চিকিৎসা নিয়েছেন তারা।
এছাড়াও আরো এক কোটি মানুষ আছেন যারা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ৭০ বা তার উপরে বয়স্ক সবাই যাদের ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অধ্যাপক সারাহ হার্পার মনে করেন, ঢালাওভাবে শুধু বয়সের উপর নির্ভর করেই ঝুঁকির বিষয়টি নির্ধারণ করা উচিত নয় বরং এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। কারণ এই উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষগুলোরও ঝুঁকির মাত্রা এক নয়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এই ঝুঁকির হারের তারতম্য বোঝার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ সামনের দিনগুলোতে এধরণের তথ্য প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াবে।
সূত্র : বিবিসি