সিরিয়া : আসাদবিহীন নতুন ব্যবস্থার ভাবনা

মাসুম খলিলী | May 21, 2020 09:21 pm
আসাদ

আসাদ - সংগৃহীত

 

সিরিয়ায় একটি পরিবর্তন সম্ভাবনার ইঙ্গিত লেখার শুরুতেই রয়েছে। এক দশক ধরে অব্যাহত গৃহযুদ্ধে একধরনের মৃতপুরীর রূপ নিয়েছে দেশটি। দেশটির একেকটি অঞ্চলে একেক শক্তির প্রভাব বিস্তৃত ছিল। আইএস একসময় দেশটির বড় একটি অঞ্চলে কর্তৃত্ব বিস্তার করে। সেই কর্তৃত্বের অবসানে বাশার আসাদ সরকারের প্রভাবই বেশি বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের প্রভাব রুশ সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ান অভিযানের পর বেশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল।

সিরিয়ার অভ্যন্তরে শরণার্থীদের জন্য নিরাপত্তা জোন করার উদ্যোগ এবং সর্বশেষ ইদলিবে তুর্কি সেনাদের ওপর বাশার সরকারের হামলায় ৩৪ সেনা নিহত হওয়ার পাল্টা অভিযানে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ব্যাপক সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর এর মধ্য দিয়ে সিরীয় পরিস্থিতিতে একধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস এবং করোনা সংক্রমণের ফলে বাশার সরকারের দুই প্রধান সমর্থক রাশিয়া ও ইরান বেশ চাপের মধ্যে পড়ে যায়। এর ফলে দীর্ঘ দিন ধরে সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে অচলায়তন জিইয়ে রাখা তারা লাভজনক কোনো দৃশ্যপট বলে মনে করছে না। সামরিক শক্তির জোরে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার যে ভাবনা বাশার আসাদ এত দিন করে আসছিলেন, তুরস্কের সামরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া এবং পাল্টা আঘাত হানার ফলে সেটি বাস্তবসম্মত মনে করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে রাশিয়া ইরান-তুরস্কের মধ্যে যে আস্তানা উদ্যোগ, সেটি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠছে।

আর সিরিয়ার রাজনৈতিক সমাধান মানে হলো এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি একটি সমাধানের প্রক্রিয়া বের করা যাবে। বাশার আসাদ যে নোসাইরি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের সমর্থন দেশটিতে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ, কিন্তু তারাই প্রভাবশালী এলিট। বিপুল সংখ্যাগুরু সুন্নি জনগোষ্ঠী বাশার আসাদ ও তার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে না। ফলে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমাধানের কোনো ফর্মুলা রাশিয়া বা ইরান কেউই মানবে না। এ অবস্থায় এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বের করতে হবে যেটিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রহণ করবে এবং শরণার্থী হওয়া সিরিয়ানরা আবার যার যার মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারবে।
তুরস্ক বরাবরই মনে করে আসছিল এ ধরনের অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা বাশার আসাদকে মূল কেন্দ্রে রেখে সফল হবে না। নতুন পরিস্থিতিতে রাশিয়াও সম্ভবত উপলব্ধি করছে যে বাশার আসাদকে শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে হবে। তবে ক্ষমতার কাঠামোতে এখনকার রুলিং এলিটদের রেখেই এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়ার কথাই রাশিয়া ভেবে থাকতে পারে।

সিরিয়ায় রাশিয়ার স্বার্থ এবং ইরানের স্বার্থ বেশ খানিকটা ভিন্ন মাত্রার। ইরানের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো একদিকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং অন্য দিকে ইয়েমেন হয়ে তার প্রভাব ইসরাইল ও সৌদি আরব পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এ কারণে সিরিয়ার জন্য ইরান তার সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছে। নিজের মিলিশিয়া ছাড়াও ছায়া শক্তি হিজবুল্লাহকে সর্বোচ্চপর্যায়ে কাজে লাগিয়েছে। একসময় বাশার আসাদের সামরিক শক্তি বলে পুরো সিরিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ফর্মুলায় তেহরানের সমর্থন ছিল। এখন তেহরানও মনে করছে পূর্ণ সামরিক জয় সিরিয়ায় সম্ভব নয়। দেশটির বিপুল জনগোষ্ঠীকে শরণার্থী হিসেবে দেশের বাইরে রেখে সিরিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি আনা যাবে না। এ জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে সার্বিকভাবে।

রাশিয়া সিরিয়ায় তার সামরিক ঘাঁটি অক্ষুণ্ন রাখা এবং এ অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখার জন্য একধরনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাশার আসাদ ক্ষমতায় না থাকলেও সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব। ইরানের বিষয়টিকে সেভাবে ভাবা কঠিন। এ কারণে আস্তানা শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপার অগ্রসর হতে তেহরান এক পা আগায় তো দু’পা পেছায়।

অন্য দিকে তুরস্কের জন্য সিরিয়ার ইস্যুটি সরাসরি সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার সাথে যুক্ত। তুরস্কের পাশে কুর্দিদের একটি স্বাধীন বা আধাস্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে সেটি তুরস্কের কুর্দিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী চলমান আন্দোলনকে চাঙ্গা করবে। আর তুরস্কের প্রায় ৪০ লাখের মতো সিরীয় শরণার্থী রয়েছে যাদের স্থায়ীভাবে সেখানে রাখা সম্ভব নয়। এক দিকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, অন্য দিকে সিরিয়ানরা নিজ দেশে ফিরতে না পারলে সেটি সেখানকার জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে দেবে। এ কারণে তুরস্ক শান্তি প্রক্রিয়ার সাফল্যের ব্যাপারে অনেক বেশি সক্রিয়। সার্বিক বিবেচনায় রাশিয়ার পাশাপাশি তেহরানের নীতি প্রণেতাদের মধ্যেও বাশার আসাদ ছাড়া বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিষয়টি যে মাত্রাতেই হোক না কেন বিবেচিত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় আস্তানা শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তব রূপ নিলে সিরিয়ায় শান্তি ফিরে আসার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এতে প্রাথমিকভাবে সিরিয়ার অখণ্ডতা থাকবে এবং সিরীয় নাগরিক যারা দেশের বাইরে বা ভেতরে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে তারা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে পারবে।

বাশার আসাদের ভবিষ্যৎ মূলত একটি প্রক্রিয়া, যা মূলত ইদলিবের ওপর নির্ভর করে। আঙ্কারার দৃষ্টিভঙ্গি এখানে বিশ্বশক্তিগুলোর আলোচনার মুখ্য বিষয়। তুরস্কের এমন একটা ভূমিকা মস্কোও একসময় প্রত্যাশা করেনি। আজ যদি আসাদের প্রস্থান নিয়ে আলোচনা করা হয়, তবে সেখানে সম্ভাব্য তুর্কি পদক্ষেপ এবং তার স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us