সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের রাজ অভিষেক না বিদায়
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স - সংগৃহীত
সৌদি আরবের বহুল আলোচিত ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজ অভিষেক আসন্ন বলে অনেকে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। বিশেষত তার ৮৪ বছর বয়সী পিতা বাদশাহ সালমানের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়লে তার জীবিত অবস্থাতেই বিন সালমান বাদশাহ হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং রাষ্ট্রের সর্বশেষ অর্থনৈতিক অবস্থা ও আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব নিকাশ অনেক কিছুই পাল্টে দিচ্ছে।
করোনার কারণে একের পর এক খারাপ খবরের মধ্যে সর্বশেষ সংবাদটি হলো: সৌদিদের ওপর কর বাড়ছে এবং সরকারি কর্মচারীদের যে আবাসন ভাতা দেয়া হতো, তা কেটে নেয়া হবে। এক বছর আগের চেয়ে তেলের দাম অর্ধেকের নিচে নেমে যাওয়া আর করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু অচল হয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়েছে।
ডি ফ্যাক্টো সৌদি শাসক, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্যও এটি খারাপ সংবাদ। তার বাবা, ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান সিংহাসনে থাকলেও ক্রাউন প্রিন্সই রাজ্যের বিদেশ ও অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ৩৪ বছর বয়সী এই ক্রাউনপ্রিন্স নানা কারণে আলোচিত সমালোচিত। এর মধ্যে রয়েছে ব্যয়বহুল বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা, দুঃসাহসী সামাজিক সংস্কার এবং রাজপরিবারের প্রভাবশালী বিরুদ্ধবাদীদের ওপর অভিযান।
তার বিদেশ নীতির সমালোচনার মধ্যে রয়েছে, ইতিবাচক ফল ছাড়াই ইয়েমেনের ব্যয়বহুল যুদ্ধ চালিয়ে রাখা, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া, সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড এবং রাশিয়ার সাথে তেলের দাম নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধে পিছু হটা আর ওপেকে একাধিপত্য হারানো। তার ঘরোয়া নীতির ক্ষেত্রে সৌদি রক্ষণশীল সমাজকে তিনি উদার করতে চাইছেন। শিক্ষাব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামোর মধ্যে তিনি পরিবর্তন আনছেন।
রাজপরিবারের তরুণদের নিয়ে তিনি সৌদি প্রশাসন ও বিকল্প ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তৈরি করেছেন। এ জন্য রক্ষণশীল ইসলামী ভাবধারার লোকজনকে বিদায় করে সেকুলার ঘরানার কর্মকর্তাদের প্রশাসনে বসানোর কাজ করছেন। ২০১৭ সালে তার বাবা তাকে ক্রাউন প্রিন্স করেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিদের আটক করেন। গত মার্চে তিনি চাচাতো ভাই এবং সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং বাদশাহর ভাই প্রিন্স আহমদ বিন আবদুল আজিজকে অন্তরীণ করেছেন। রাজপরিবারের উপরে তার কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় করার জন্য ক্রাউন প্রিন্স এখন সম্ভবত আরো পদক্ষেপ নিতে পারেন।
তবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে সমর্থন করছে না। সৌদি অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আল জাদান সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন যে, তার সরকার এই বছর ৫৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেবে। এ ঘোষণাটি দেশের ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা বৃদ্ধির ইঙ্গিত।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে সৌদি আরবের মোট বিদেশী ঋণ ছিল ১৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালের শেষের দিকে ছিল ১৫১ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণ গত পাঁচ বছরে আকাশচুম্বী হয়েছে।
ইয়েমেন যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে ২০১৪ সালের শেষে, বিদেশী ঋণ ১২ বিলিয়ন ডলারের নিচে ছিল। পাঁচ বছরে এটি ১৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। একই সময়ে রাষ্ট্রের নগদ সম্পদ মজুদও কমে গেছে। ২০১৪ সালের শেষে দেশটির মোট রিজার্ভ সম্পদ ছিল ৭৩২ বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের শেষের দিকে তা ৪৯৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এখন এটি ৩০০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এই পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, সৌদি আরব অর্থনৈতিকভাবে ক্রমাগতভাবে দুর্বল অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। এই দুর্বলতা দেশটির আঞ্চলিক প্রভাব যেমন কমিয়ে দেবে, তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ এক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। আর নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনে বিন সালমানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ট্রাম্প হেরে গেলে উচ্চাভিলাষী ক্রাউন প্রিন্সের সামনে এগোনোর সুযোগ সম্ভবত আর থাকবে না। এমন কথাও বলা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বিন সালমানের সৌদি বাদশাহ হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আর এর আগেই যদি তিনি এই পদে বসে যান তা হলে তিনিই হতে পারেন সৌদি রাজতন্ত্রের শেষ বাদশাহ।
অন্য দিকে ইরানের সাথে আমেরিকান গভীর বলয়ের যে গোপন সমঝোতার ইঙ্গিত লেখার শুরুতে রয়েছে সেটি বাস্তবে রূপ নিতে পারে। আর এতে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থাও পাল্টে যেতে পারে আমূল।
mrkmmb@gmail.com