১৮৫ কিমি! আমফানে 'মহাপ্রলয়' দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ!

নিজস্ব প্রতিবেদক | May 21, 2020 01:38 pm
১৮৫ কিমি! আমফানে 'মহাপ্রলয়' দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ!

১৮৫ কিমি! আমফানে 'মহাপ্রলয়' দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ! - সংগৃহীত

 

ব্যাপ্তি প্রায় ৪ ঘণ্টার। সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। বুধবার 'মহাপ্রলয়' দেখল ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। যার পদে পদে জড়িয়ে রইল ভয়াবহ শঙ্কা, আতঙ্ক এবং উদ্বেগ। তথ্যাভিজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক অতীতে এমন মহাশক্তিধর এবং ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়নি। হাওয়ার তীব্র দাপটের সঙ্গেই ভয়–ধরানো গর্জন, মুষলধারে বৃষ্টি মিলে যে আতঙ্কের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ কলকাতা–সহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাকে ঠেলে দিয়েছিল ৪ ঘণ্টার জন্য, তা–ও কার্যত নজিরবিহীন। কলকাতায় রেকর্ড বৃষ্টি, ২৪৪.‌২ মিলিমিটার। আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১২৭ বছরের মধ্যে কলকাতায় এত বৃষ্টি হয়নি।

বিপুল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই রাজধানী কলকাতা এবং দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকা–সহ বিস্তীর্ণ অংশ ডুবে গিয়েছিল অন্ধকারে। গাছ পড়ে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে বেশ কয়েকঘণ্টার জন্য বঙ্গবাসীর বড় অংশের জীবন নিষ্প্রদীপ করে দিয়েছিল ওই ঘূর্ণিঝড়।
এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আয়লা’র গতিবেগ ছিল উপকূল অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার এবং কলকাতায় ১০০ কিলোমিটার। সেদিক দিয়েও ‘আমফান’ পিছনে ফেলে দিয়েছে ‘আয়লা’কে। পাশাপাশিই তৈরি করছে আতঙ্ক এবং ধ্বংসের তীব্র অভিঘাত। সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ, কাকদ্বীপ, নামখানায় একাধিক বাঁধ ভেঙেছে। দিঘা–সহ বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছে। কাঁচাবাড়ি ভেঙেছে প্রায় ৬ হাজার। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ওই ঘূর্ণিঝড়ের আরও একটি ঝাপটা বাংলার ওপর দিয়ে গিয়েছে মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে। তবে তার তীব্রতা ছিল তুলনায় কম। কিন্তু বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সময়ে যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গিয়েছে ‘আমফান’, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কারণ, এর পিছুপিছুই আসবে খাবার পানির সমস্যা, পেটের রোগের মতো অসুখ। এদিন রাত থেকেই ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়েছে প্রশাসন। নবান্নে রাত জেগে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। কলকাতা পুরসভার কন্ট্রোলরুমে ছিলেন মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম।

‌প্রবল বেগে বুধবার বিকেলে ‘‌আমফান’‌ আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে। তছনছ করে দেয় উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চল। তারপর কলকাতার গা ঘেঁষে এগিয়ে যায় বাংলাদেশের দিকে। ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার বেগে উপকূলের সুন্দরবন ও সংলগ্ন অঞ্চল দিয়ে ঢুকতে শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘‌আমফান’–এর চোখ (‌পরিভাষায় ‘আই’)‌। যা কখনও কখনও বেড়ে ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছে যায়। উপকূলে আছড়ে পড়তে থাকে প্রায় দোতলা উচ্চতার ঢেউ। তাতে প্লাবিত হয়ে পড়ে উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকা। দিঘায় ঢেউয়ের ঝাপটায় রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ে বোল্ডার। কোটালের আগে জলস্ফীতি সমস্যায় ফেলে সুন্দরবন–সহ উপকূলের বাসিন্দাদের। কলকাতাতেও ঝড়ের তাণ্ডব ক্রমে বাড়তে থাকে। প্রবল ঝড়ে কলকাতা, হাওড়া, মিনাখাঁ, ইটাবেড়িয়া ও বসিরহাটে মৃত্যু হয় ৬ জনের। তবে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বেশ কিছু জায়গায় ভেঙে–পড়া বাড়িতে ও উপড়ে–যাওয়া গাছের নিচে অনেকের আটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দুর্যোগের পরিস্থিতি ছিল সকাল থেকেই। ঘূর্ণিঝড় যত উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে ততই ঝড়ের গতি বাড়তে শুরু করে। শুরু হয় বৃষ্টি। বড় বড় জাহাজ আগেভাগেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন নদী, খালের পাশে বেঁধে রাখা নৌকা, লঞ্চ দুলতে শুরু করে। বেশ কিছু উল্টেও যায়। বিভিন্ন জায়গায় উপড়ে পড়তে থাকে বিদ্যুতের খুঁটি। উপড়ে যায় কাঁচাবাড়ির চাল। বেশ কিছু জায়গায় বাড়ি ভেঙে পড়ে। বিকেলে যখন ঝড়ের টান বাড়তে শুরু করেছে, তখন বাবুঘাটে গঙ্গায় যেন সাগরের স্রোত। হঠাৎ দেখলে মনে হবে দিঘা কিংবা মন্দারমণির সাগরতট।
দুপুরে দমকা হাওয়ায় দমদমে ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়। যা সন্ধেয় কলকাতায় ১১৪ এবং দমদমে ১৩৩ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়। ততক্ষণে তার আগে উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঝড়ের গতি ক্ষণে ক্ষণে বেড়েছে।

কখনো গতি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার তো কিছুক্ষণ পর কিছুটা বেড়ে ঘণ্টায় ১৭৫ থেকে ১৮৫ কিলোমিটারের আশপাশে।
প্রবল ঝড়ে ঢেউয়ের টানে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানার নারায়ণপুর জেটি ভেঙে পড়ে। জেটি ভাঙে বুড়িগঙ্গার ওপর কচুবেড়িয়ায়ও। ক্ষতি হয় একাধিক বাঁধের। কলকাতায় প্রচুর গাছ উপড়ে গিয়ে বহু পথ বন্ধ হয়ে যায়। দুর্যোগের আভাস পেয়ে অবশ্য আগেভাগেই কলকাতার সব উড়ালপুল বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তাতে বহু গাছ ভেঙে পড়লেও বড়সড় বিপদ এড়ানো গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের তরফে উপকূল সংলগ্ন এবং কলকাতার বহু অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যাঘাত ঘটে মোবাইল, ইন্টারনেট সংযোগেও। কেব্‌ল টিভির সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়ের ‘‌আই’‌–এর অর্ধেকটা স্থলভাগে ঢুকে পড়ে। তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় এক সময় ঝড়ের গতি বেড়ে হয় ১৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। এর জেরে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিশেষ বিমান পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সকাল থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি। সবথেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সাগরে। সেখানে সন্ধেবেলাতেই বৃষ্টির পরিমাণ ৮৫ মিলিমিটার ছা‌‌‌ড়ায়। সুন্দরবনের মাতলা, বিদ্যাধরী, গোমর, বুড়িগঙ্গা, হাতানিয়া–দোয়ানিয়া প্রভৃতি নদীতে পানি বেড়ে যায়। ফ্রেজারগঞ্জে একাধিক বাড়ির চাল উড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে প্রচুর গাছপালা।

কার্যত লন্ডভন্ড অবস্থা দিঘা, তাজপুর, জলধা, মন্দারমণি, কাঁথি, হলদিয়া, খেজুরি, নন্দীগ্রামের উপকূল এলাকাগুলি। একাধিক জায়গায় ঘরবাড়ি ভেঙে উড়ে যায় বাড়ির চাল। ভেঙে পড়ে গাছপালা। দিঘায় বুধবার সকাল থেকেই সমুদ্র উত্তাল। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি। সকালের জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্যামপুর, জলদা, তাজপুরের দুর্বল সমুদ্রবাঁধ। এগরা, মহিষাদলে কাঁচাবাড়ি ভেঙে পড়ে। দিঘা, রামনগর, কাঁথি এবং মহিষাদলের বিভিন্ন জায়গায় উপড়ে পড়ে বহু গাছ। ঝড়ের দাপটে উড়ে যায় দিঘা রেল স্টেশনের করোগেটেড শিট।

উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় ঝড়ে গাছ পড়ে মৃত্যু হয় নুরজাহান বেওয়া (৫৬) নামে এক মহিলার। মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, হাড়োয়া–সহ আশপাশের এলাকায় ৫ হাজারের ওপর মাটির বাড়ি ভেঙেছে। প্রচুর গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙেছে।‌

সূত্র : আজকাল


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us