ইবাদত কবুল হয় যে গুণের মাধ্যমে
ইবাদত কবুল হয় যে গুণের মাধ্যমে - সংগৃহীত
মহান আল্লাহ মানবজাতিকে একমাত্র তার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করা ও নিষেধসমূহ বর্জন করাকে ইবাদত বলা হয়। মহান আল্লাহর কাছে বান্দাহর কাজ গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করা। আর এটি যে গুণের মাধ্যমে অর্জিত হয় তা হলো ইখলাস।
ইখলাসের অর্থ সন্দেহমুক্তভাবে আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্য করা, আল্লাহ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করা, রিয়া বা অহঙ্কার প্রদর্শন না করা। মহান আল্লাহ নিজেই ইখলাসের সাথে ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তাদেরকে এছাড়া আর কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে তারা খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই ধর্ম। (সূরা আল বাইয়্যেনাহ : ৫)
ইখলাস হলো ইবাদতের আত্মা বা রুহ এবং দ্বীনের অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষের শরীরে আত্মা না থাকলে যেমন এর কোনো মূল্য থাকে না, তেমনি ইখলাসবিহীন ভালো কাজ অর্থহীন। বলিষ্ঠ একনিষ্ঠতা বান্দাহর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে এবং দুর্বল ইখলাস আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমার দ্বীনকে একনিষ্ঠ করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান : ৬৮৫৯)
ইখলাস হলোÑ যেখানে কোনো প্রকার প্রদর্শনেচ্ছা বা লোক দেখানো উদ্দেশ্য হবে না, কোনো সন্দেহও যুক্ত হবে না, সব ভালো কাজের পুরস্কার একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করবে এবং কাজটি তার নির্দেশিত পন্থায় সম্পন্ন হবে।
মহান আল্লাহ বান্দাহর আকৃতির দিকে তাকান না। তিনি তার অন্তরের উদ্দেশ্য বিবেচনা করেন। ফলে বান্দাহর উচিত কোনো নেক কর্ম বৈষয়িক কোনো সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্যে না করে একমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা। সব নবী-রাসূল বৈষয়িক প্রতিদান লাভের প্রত্যাশা ছাড়াই দাওয়াতি কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে এর কোনো মজুরি চাই না; আমার মজুরি তারই কাছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন; তবু তোমরা কেন বুঝ না?’ (সূরা হুদ : ৯০)
দান সদকার ক্ষেত্রেও আমাদের আল্লাহ অনুগ্রহ লাভের আশা করতে হবে। লোক দেখানো মনোভাব রাখা যাবে না। পুণ্যবান লোকদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা মহব্বত থাকা সাপেক্ষে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম এবং বন্দীকে খাবার দান করে এবং বলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদের দান করি। আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়। (সূরা দাহর : ৮-৯)
শুধু দান সদকা নয়; বরং আল্লাহর রাস্তায় জীবন দান, ইলম অর্জনের মতো মহৎ কাজও ইখলাস ব্যতীত আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রথম শহীদের বিচার ফয়সালা করা হবে। তাকে নিয়ে আসা হবে এবং সব নিয়ামত সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হবে। ফলে তিনি তা চিনতে পারবেন। তারপর জিজ্ঞেস করা হবে তুমি কী করেছ? সে বলবে, আমি সেখানে যুদ্ধ করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তাকে বলা হবে তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি যুদ্ধ করেছ যেন লোকেরা তোমাকে বীর বলে। অতঃপর আদেশ করা হবে তাকে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য। এরূপে পর্যায়ক্রমে লোক দেখানো আলিম ও দানশীল ব্যক্তিদের উপস্থিত করা হবে এবং প্রশ্ন করা হবে। আর প্রত্যেকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (সহিহ মুসলিম : ৫০৩২)। মূলত নিষ্ঠা ও নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকায় তাদের এ পরিণাম।
ইখলাসের বিপরীত শব্দ হলো রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা, লৌকিকতা বা লোক দেখানো কর্ম। এটি বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পোশাক পরিচ্ছদ, কথা-বার্তা ও কর্মের ধরনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ফলে ভালো কাজের উদ্দেশ্য থাকে মানুষের প্রশংসা অর্জন। রিয়া মানুষের আমলগুলো ধ্বংস করে দেয়; আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রিয়ার উদ্দেশ্যে দানকারীর দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘ওই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো, যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল, তারপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিলো।’ (সহিহ বুখারি,খ/২ পৃ. ৫১০) অর্থাৎ সে আর সাওয়াবের অধিকারী হয় না। শুধু তাই নয়, রিয়া দাজ্জালের ফিতনার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর। (ইবনু মাজাহ,খ/২ পৃ. ৮০)
রমজানের সিয়াম সাধনা এমন একটি ইবাদত যাতে কোনো লৌকিকতা নেই। অন্যান্য ইবাদতে প্রদর্শনেচ্ছা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু রোজা তা থেকে মুক্ত। কেননা রোজাদার একমাত্র তার রবের সন্তুষ্টির জন্যই সিয়াম সাধনা করে। এ ক্ষেত্রে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ফলে রমজান মাস ইখলাস অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ। বাকি জীবন রমজানের এ প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে যাবতীয় ইবাদত নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করলে সব কর্মের উত্তম প্রতিদান লাভ সম্ভব।
লেখক : প্রফেসর, দাওয়াহ্ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া