দিনার মহানুভবতা
নারী কাউন্সিলর দিনার মহানুভবতায় মুগ্ধ সবাই - ছবি : নয়া দিগন্ত
এক সময় লোকটার প্রচুর টাকা পয়সা ছিল। ব্যবসা ধ্সসহ নানা কারণে তার আর্থিক দুরবস্থা দেখা দেয়। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন। ফতুল্লা স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী ওই ব্যক্তিটির স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কীভাবে অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। লজ্জায় কারো কাছে সাহায্যও চাইতে পারছিলেন না। স্ত্রীর সন্তান জন্ম দেয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল, দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছিল। অবেশেষে গত ১৪ মে তার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা শুরু হলে, পাগল মত অবস্থা হয় তার। দিক শূন্য হয়ে ফোন করেন নারায়ণগঞ্জের এক নারী সাংবাদিককে। তাকে খুলে বলেন সব সমস্যার কথা। তার কখা শুনে সাথে সাথে ঘটনাটি জানান নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর আয়শা আক্তার দিনাকে। পরে কাউন্সিলর নিজ উদ্যোগে সিদ্ধিরগঞ্জে একটি হাসপাতালে এনে গর্ভবতী নারীর ডেলিভারী করান। জন্ম হয় ফুটফুটে এক ছেলে সন্তানের।
এভাবে আরো দু'জন গভবর্তী নারীর সন্তান জন্ম দেয়া এবং পরবর্তীতে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে পাশে দাড়িয়ে নারায়ণগঞ্জে ব্যপাকভাবে আলোচিত হয়েছেন নারী কাউন্সিলর দিনা।
করোনার হট স্পট নারায়ণগঞ্জে একের পর এক অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন এই নারী কাউন্সিলর। তার আরো একটি পরিচয় রয়েছে, তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর মহিলা দলের সিনিয়র যুগ্মআহবায়ক।
নয়াদিগন্তের সাথে আলাপকালে তিনি জানান করোনা দুর্যোগের শুরু থেকে চলমান সময় পর্যন্ত তার মানবসেবার কথা। তিনি বলেন, মানুষের বাহবা আর প্রশংসা পেতে নয়, শুধু মাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য তিনি জনসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে তিনি অর্জন করতে চান আল্লার সন্তুষ্টি।
আয়শা আক্তার দিনা জানান, করোনা দুর্যোগ শুরু হলে প্রথমে আমি আমার নির্বাচিত এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের মসজিদগুলোতে কোরআন খতমের আয়োজন করি। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ রহমত ছাড়া এ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এর পর আমি অনুরোধ জানাই দেশের প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কোরআন তেলাওয়াতের যেন ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি জানান, এর পর আমি নেমে পড়ি অসহায় মানুষের সহায়তা করতে। সাধ্যমতো চেষ্টা করি মানুষের কাছে খাবার পৌছে দিতে। সংরক্ষিত আসন হওয়ায় আমার জন্য বরাদ্দ কম। কারণ যে বরাদ্দ তা আমার ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডে দিতে হয়। জনসংখ্যার তুলনা এ বরাদ্দ খুবই কম। তবু আমি থেমে থাকিনি। আমার স্বামীর একান্ত চেষ্টা আর সহযোগিতায় আমি অসহায় মানুষের পাশে দাড়াচ্ছি। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ১৯ শ' পরিবার এবং আমার নিজ উদ্যোগে ১২ শ' পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেয়ার পর অনেকে আমাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যাতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।
কাউন্সিলর দিনা জানান, ত্রাণ দিতে গিয়ে আমি অনেক মানুষের অসহায়ত্ব দেখেছি। অনেকে লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ঘরে খাবার নাই। আমার স্বামীকে সাথে নিয়ে রাতের আধারে আমি খাবার পৌছে দিয়েছি সেসব ঘরে।
নারায়ণগঞ্জের করোনা প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, মানুষ সচেতন না। শুরুতেই যদি কারফিউ জারি করা হতো তা হলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো।
মহিলা দলের নেত্রী হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে কাউন্সিলর দিনা জানান, সিটি করর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় আমাকে যথেষ্ঠ সহাযোগিতা করে যাচ্ছেন। তিনি উদার ও মহৎ। তার সহযোগিতা আমি অনেক পাচ্ছি। তবে এলাকার কিছু লোক আছে সমালোচনা করে। হিংসা করে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলি, রাজপথের আন্দোলনে আমি মহিলা দলের নেত্রী। আর আমার ওয়ার্ডগুলোতে আমি জনপ্রতিনিধি। এখানে কোনো দল নেই, সবাই আমার কাছে সমান। আমি সবাইকে আমার সাধ্যমতো সহায়তা করতে চাই।
সিদ্ধিরগঞ্জে দু'জন গর্ভবতী নারীর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের নয়াপাড়া আশেক আলীর ভাড়াটিয়ার বাচ্চা গর্ভে আসার ৩/৪ মাসের মাথায় স্বামী তার স্ত্রীকে একা ফেলে চলে যায়। পাশেই এক গার্মেন্টসে ওই নারী ও তার স্বামী চাকরী করত। কিছুদিন আগে গভীর রাতে তার প্রসব ব্যথা শুরু হলে পাশের মহিলারা স্থানীয় এক দাইকে ডেকে এনে, নারীটির ডেলিভারি সম্পন্ন করে এবং একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম হয়। কিন্তু বর্তমানে নবজাতক ওই শিশুটি মায়ের বুকের দুধ তেমন পায় না আর ঘরেও নারীটির কোনো খাবার নেই। এই সংবাদ পেয়ে ১৭ মে আমি সাথে সাথে মায়ের জন্য খাবার ও শিশুটির জন্য দুধ নিয়ে যাই। সেই সাথে লকডাউন চলাকালীন মহিলাটির স্বজন না আসা পর্যন্ত তাদের প্রয়োজনীয় খাবার-ওষুধ যা যা লাগে সব পৌঁছে দিবো বলে জানাই।
আর একটা ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে স্বামীর কোনো আয়-রোজগার নেই। যে সামান্য অর্থ জমা ছিলো তা দিয়ে এ কয়েকদিন কোনোমতো চলে। এ অবস্থায় সন্তান জন্ম দেয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসে সিদ্ধিরগঞ্জের প্রসূতি এক মায়ের। অথনৈতিক এ দৈন্য দশায় কুল-কিনারা না পেয়ে আমাকে ফোন করেন। অসহায় ওই নারীর ফোন পেয়ে দ্রুত গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করি । পরে ওই নারী হাসপাতালে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি বহন করি।