লাইলাতুল কদর প্রাসঙ্গিক কথা
লাইলাতুল কদর প্রাসঙ্গিক কথা - সংগৃহীত
লাইলাতুল কদর আমাদের দেশে শবে কদর হিসেবেই সমধিক পরিচিত। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে এ রাতের অনুষ্ঠানাদি। আমাদের দেশ তথা উপমহাদেশে আলেম ওলামাদের কিছু কিছু বক্তব্য বা লেখনীতে রমজানের শেষ দশক বা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করার কথা উল্লেখ থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেটা ২৭ তারিখই বিবেচ্য। এ ধারণাও তারা আলেমদের কাছ থেকেই পেয়েছেন। এ কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবেও চাঁদের ওই রাতকেই ঠিক করে দেয়া হয় লাইলাতুল কদরের জন্য।
আমাদের দেশে ওই রাতের আমল বলতে তারাবির সালাতের পর কিছু সময় কয়েক রাকাত নফল নামাজ, ওয়াজ-নসিহত, দোয়া-দুরুদ, মিষ্টান্ন বিতরণ এবং বাড়িতে গোশত-রুটিসহ উন্নতমানের খাবারের আয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রকৃত অর্থে এটাই কী লাইলাতুল কদর? আর এটাই কি ওই রাতের আমল?
রাসূল সা: নিজেই বলেছেন যে, আমাকে ওই রাতের নির্দিষ্ট তারিখটি ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এ জন্য বিশুদ্ধ হাদিসের বর্ণনা মতে তিনি ওই রাতকে অন্বেষণের জন্য কখনো শেষ দশক, কখনো শেষ দশকের বেজোড় রাত আবার কখনো শেষ সাত দিনে সচেতন থাকার জন্য উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসূল সা:-এর ব্যক্তিগত আমল ছিল, শেষ দশক আসলে দুনিয়ার সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে কোমর বেঁধে পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি ওই রাত জেগে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
মধপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার মসজিদে শেষ দশকে তারাবির পরে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে জামাতের সাথে কিয়ামুল্লাাইলের আয়োজন করা হয়, যাতে লাইলাতুল কদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। আমাদের দেশেও ধর্ম মন্ত্রণালয় বা মসজিদ কমিটি স্বউদ্যোগে এ কাজটি করা যেতে পারে। তা হলে অনেক মানুষ যারা ঘুমিয়ে বা অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করে রাত কাটান তারা সহজেই কিয়ামুল্লাইলের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে পারেন।
হাফিজ ইবনে কাছির রহ: সূরাতুল কদরের তাফসির করতে গিয়ে লাইলাতুল কদরের তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত সব বর্ণনা উল্লেখ করেছেন এবং মতভেদপূর্ণ বর্ণনাগুলোর সমন্বয় করতে গিয়ে এটাও বলেছেন যে, ২৭ তারিখকে অনেকেই প্রাধান্য দিলেও যেকোনো রাতই লাইলাতুল কদর হতে পারে। আবার প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন রাতও লাইলাতুল কদর হতে পারে। সে অর্থে নিরাপদ হলো শেষ দশকের প্রতিটি রাত অথবা কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলোতে নফল ইবাদতে মগ্ন থাকা।
এবার আসা যাক এ রাতে কোন ধরনের গুনাহ মাফ হবে সে প্রসঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ৩১ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যদি তোমরা, নিষেধ করা হয়েছে এমন কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকো তা হলে আমি তোমাদের ছোটখাটো গুনাহগুলো মিটিয়ে দেবো।’ সূরা ফুরকানের ৭০ নম্বর আয়াতে আরেকটু আগ বাড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘যারা তাওবা করবে (কবিরা গুনাহ থেকে) এবং ভালো কাজ করবে তাদের ছোট গুনাহগুলো সংক্রিয়ভাবে আল্লাহ তায়ালা নেকিতে পরিণত করে দেবেন।’
তাহলে আসুন প্রথমে তাওবার মাধ্যমে কবিরা গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত করি এবং লাইলাতুল কদরে বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালাই। তবে সুদ, ঘুষ, মিথ্যা, শঠতা, যেনা-ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতন ও অপরের অধিকার নষ্ট করার মতো অন্যান্য কবিরা গুনাহর মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে নফল ইবাদতের মাধ্যমে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ পরের হকের সাথে জড়িত যেকোনো গুনাহ ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গে কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা পাওয়া ছাড়া আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমা পাওয়া যাবে না। তাই পরের হক নষ্ট করে বা অন্যের অধিকার হরণ করে, জুলুম নির্যাতন করে নিজেকে নফল ইবাদতের মাধ্যমে সফল করার চেষ্টা না চালাই। আগে পরের হক নষ্ট থেকে নিজেকে বিরত রাখি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের মহিমায় মহিমান্বিত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : প্রফেসর, দাওয়াহ্ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।