বঙ্গ সুন্দরীর সাথে গান্ধীর রোমান্স
সরলা দেবী ও গান্ধী - সংগৃহীত
গান্ধীর বিশাল পরিবার, তার স্ত্রী, চার পুত্র, তাদের স্ত্রী ও সন্তান, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, আশ্রমের অন্যান্য অধিবাসী এবং স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকারী এবং এমনকি তার জীবনীকারকরা পর্যন্ত তার পুস্তকের মতো উন্মুক্ত জীবনের যে কয়েকটি গোপন বিষয় চেপে রেখেছেন তার একটি হলো সরলাদেবী নামক পরমা সুন্দরী এক বাঙালি রমণীর সাথে মহাত্মার আবেগময় প্রেম।
তিনি ছিলেন পরম কাম্য এক মহিলা। বাঙালি অভিজাত বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিভূ (ইংরেজি, সংস্কৃত, ফারসি ও ফরাসি ভাষার সুপণ্ডিত, সমাজসংস্কারক, জাতীয়তাবাদী নেত্রী ও আধুনিক ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি, একজন লেখিকা এবং একজন সঙ্গীতজ্ঞ, যিনি তার সময়ে বাঙালির ‘জোয়ান অব আর্ক’ এবং মাটিতে নেমে আসা দুর্গাদেবী হিসেবে অভিহিত হতেন। যার আশপাশে ছিল বিমুগ্ধ তরুণের দল যারা তার কথায় লড়তে এবং মরতে সদাপ্রস্তুত ছিল। তার প্রখর মেধা ও সৌন্দর্যে গান্ধী যে বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন, তা নিয়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে, বিশেষ করে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, তার পুত্ররা ও সচিব মহাদেব দেশাইয়ের মধ্যে কোনো সন্দেহই ছিল না। তারা তার ও তাদের স্বার্থে এই সম্পর্কচ্ছেদের জন্য পেরেশান হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি তার স্ত্রী কস্তুরবা, ইতিহাসের অন্যতম নির্বিকার মহিলা, যিনি তার স্বামীর গণমুখী জীবনে অসংখ্য প্রেমান্ধ মহিলার আগমন ও নির্গমনে খুব একটা বিচলিত হননি, তিনিও উদ্দীপ্ত সরলাদেবীর প্রতি গান্ধীর আসক্তিতে ভীত হয়ে উঠেছিলেন।
বিস্ময়কর যে, গান্ধীর জীবনের ঘটনাবলির এই একটি বিষয় যা সবাই এড়িয়ে গেছে এবং তিনি তার খোলামেলা আত্মজীবনীতে পরিকল্পিতভাবে এ বিষয়টি বাদ রেখেছেন। ৫১ বছর বয়স্ক ব্রহ্মচর্যে সনিষ্ঠ গান্ধীর ৪৭ বছর বয়স্কা এক পরস্ত্রীর প্রতি মুগ্ধতার কারণ কী ছিল? মানসিক সাহচর্য, অভাববোধ, নাকি দ্বিধার দোলাচলে ভরা এই মহিলার জটিল ব্যক্তিত্বের চোরাটান? তার নাতি রাজমোহন গান্ধী তার আত্মজীবনীতে দাদার এ প্রেমের বিষয়টি এবং তা থেকে গান্ধীর সরে আসার কথা বর্ণনা করেন। এখানে তা তুলে ধরা হলো। অনুবাদ করেছেন হাসান শরীফ
অক্টোবর ১৯১৯, লাহোর
এ সময় গান্ধীর জীবনে এমন কিছু ঘটে যার জন্য তিনি আন্দোলন করেননি। তিনি তখন তার লাহোরের মেজবান রামভজ দত্ত চৌধুরীর ৪৭ বছর বয়স্কা স্ত্রী সরলাদেবীর প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করলেন (জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে গান্ধী প্রথমবারের মতো পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি (তার মা স্বর্ণকুমারী ছিলেন বিশ্বকবির দু’বোনের অন্যতম এবং বয়সে বড়) সরলাদেবী ছিলেন তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার জার্নাল হিন্দুস্তান-এর সম্পাদক।
গান্ধী তাকে প্রথম দেখেছিলেন এর ১৮ বছর আগে ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে, যখন সরলাদেবী গান্ধীর উপস্থিতিতে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের উদ্বোধনী সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি গানটি কম্পোজ করেছিলেন এবং ৫৮ জন গায়ক তা উপস্থাপন করেছিল। এই সময়ে তার সম্পর্কে গান্ধী কোনো মন্তব্য করেছিলেন কি না তার কোনো রেকর্ড নেই, তবে সরলাদেবী ১৯৪০-এর দশকে যে আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন, তাতে মনে হয় তারা হয়তো ১৯০১ সালে অধিবেশনে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি সেই সময়ে তার সম্পাদিত পত্রিকা ভারতীতে ‘সম্ভাব্য দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক’ হিসেবে গান্ধীর কথা ভেবেছিলেন।
সরলাদেবীর বয়স তখন ২৯ বছর। সেই সময়ে তাদের মধ্যে কোনো কিছু ঘটার প্রমাণ পাওয়া যায় না, আমরা গান্ধীর আত্মজীবনী (১৯২৫ থেকে ১৯২৯ সালে লিখিত) থেকে জানতে পারি, তিনি সরলাদেবীর পিতা ও কংগ্রেসের অন্যতম সচিব জানকীনাথ ঘোষালের সাথে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটিয়েছিলেন।
১৯০১ সালে সরলাদেবীর সাথে গান্ধীর সাক্ষাৎ হয়তো দায়সারা গোছের হয়েছিল, তবে সম্ভবত তিনি তাকে মনে রেখেছিলেন। সরলাদেবীর গ্র্যাজুয়েশন গ্রহণের একটি ছবিতে তার আকর্ষণীয় আবয়ব লক্ষ করা যায়। অস্বাভাবিক প্রতিভাধর সঙ্গীতজ্ঞ ও লেখিকা সরলাদেবী বাঙালি তরুণদের জঙ্গি দেশাত্মবোধকের প্রশিক্ষণ দিতেন, তাই পুলিশের নজরেও পড়ে থাকবেন। এর আগে তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা এবং স্বামী তাকে ইউরোপ সফরে সাথে নিতে চেয়েছিলেন বলেও বলা হয়ে থাকে (তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সপ্তম মহিলা হিসেবে গ্র্যাজুয়েট হন; তবে পদ্মবতী স্বর্ণপদক তিনিই প্রথম পান)।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গজনিত উত্তেজনাকালে সরলাদেবী ইতঃপূর্বে দু’বার বিপত্নীক হওয়া ও আর্যসমাজবাদী পাঞ্জাবের রামভুজ দত্ত চৌধুরীকে (তিনি ছিলেন স্বামী দয়ানন্দের শিষ্য) বিয়ে করেন। তিনি তার পিতামাতার চাপে এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন, তারা মনে করেছিলেন, লাহোরে তাদের কন্যা কলকাতা পুলিশের নাগালের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর (সরলার মাও তাকে প্রথমে বিয়ে দিতে চাননি। মেয়েকে ‘দেশের কাজে কুমারী রাখার’ আগ্রহ ছিল তার। এমনকি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও একবার বলেছিলেন, সরলা যদি বিয়ে করতে না চায়, তবে তাকে তলোয়ারের সাথে বিয়ে দিয়ে দেই। তবে তাতেও সরলা রাজি হননি)। সে সময়ে কনের জন্য এটা অনেক বেশি বয়স হিসেবে বিবেচিত হতো এবং সম্ভবত তার স্বামী তাকে বলতেন ‘ভারতের মহাশক্তি’।
লাহোরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই, ১৯১৯ সালের ২৭ অক্টোবর, গান্ধী আহমদাবাদে অনাসূর্যবেনকে লিখেন, ‘সরলাদেবীর সঙ্গ খুবই চমৎকার। সে খুবই যত্নসহকারে আমার দেখাশোনা করে।’ ১৯২০ সালের জুনে পরিস্থিতির পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত পরবর্তী কয়েক মাস এই সম্পর্ক ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যাকে গান্ধী উল্লেখ করেছেন ‘অনিরূপণীয়’ (রহফবভরহধনষব) হিসেবে। এই সময়ে তিনি শুধু বিশেষ সম্পর্ক প্রশ্নে সাবধানতা থেকে সরে আসেননি, বরং এমনকি সরলাদেবীর সাথে ‘আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল) বিয়ে’র কথাও ভেবেছেন, যা দিয়ে তিনি যা-ই বুঝিয়ে থাকুন না কেন।
৪৭ বছর বয়সে তার অবয়ব প্রলোভন করার মতো ছিল না, গান্ধীকে (তখন তার বয়স ৫০) তিনি নান্দনিক ও রাজনৈতিক আপিল জানালেও তার মধ্যে হয়তো যৌনকামনা ওঁৎ পেতে ছিল। ভারতীয় ও পশ্চিমা উভয় সংস্কৃতি আত্মস্থকারী সরলাদেবী চমৎকার লিখতে ও বলতে পারতেন এবং গান্ধীর মতে, তার কণ্ঠস্বর ছিল ‘সুরেলা’। এই সম্পর্কের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সরলাদেবী শুধু ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্বন্ধযুক্ত মর্যাদাই নয়, সেই সাথে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির উদ্দীপনা এবং অধিকন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহিংসতার গতিশীল ধারায় অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিলেন। সরলাদেবীর সাথে তার মিলন মানে ভারতের সব অংশে সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি। গান্ধী সচেতনভাবে এসব বিবেচনা করেছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু এগুলো তাকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে।
১৯৩৩ সালে তিনি (ফাদার উইলিয়াম ল্যাশ ও ই স্ট্যানলি জোন্সকে) বলেছিলেন কস্তুরবার উদ্বিগ্নতা ও তার পুত্র দেবদাস, মহাদেব দেসাই এবং অপর অল্পবয়স্ক আত্মীয় মথুরাদাস ত্রিকামজির, তার সৎবোন মুলিবেনের নাতি, হস্তক্ষেপে তিনি ‘নরকাগ্নিতে ছুটে’ যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
১৯৩৫ সালে তিনি কস্তুরবার নিরক্ষরতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মার্গারেট স্যাঙ্গারকে বলেছিলেন ‘এক উদার ও পরিমার্জিত শিক্ষিতা মহিলার’ সাথে সাক্ষাতের পর তার ‘প্রায় পদস্খলন’ ঘটেছিল কিন্তু সৌভাগ্যবশত ‘মোহমত্ততা’ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি ১৯১৯-২০ সালের আকর্ষণের কথা বলছিলেন। আত্মজীবনীর শেষ পৃষ্ঠায় তার অভিজ্ঞতা (ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর) বর্ণনাকালে ‘আমার মধ্যে সুপ্ত বিকারগুলোর প্রভাব’ প্রসঙ্গে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটাও সম্ভবত ১৯১৯-২০ সালের সময়কার স্মৃতিচারণ।
আরেকটি উপাদানও হয়তো কাজ করছিল : সম্ভবত এই ‘চমৎকার’ মহিলা এবং সৌন্দর্যবেত্তা ‘খুবই যত্নসহকারে’ তার ‘দেখাশোনা করে’ গান্ধীকে একটি আবেগময় চাহিদা উসকে দিয়েছিল, যিনি শুধু দিয়েই যান এবং সবসময়ে প্রয়োজন থাকলেও পান সামান্যই, তিনি বা তার অনুসারী ও সহযোগীরা এই চাহিদার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেনি। সত্যাগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা ও সেনাপতি এই সর্বোচ্চ আত্মবিশ্বস্ত ব্যক্তিটি তার বুকে এত বেদনা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন, যা তিনি বা তার আশপাশের লোকরা সামান্যই উপলব্ধি করতে পেরেছিল এবং একজন মানুষ হিসেবে তিনি সবচেয়ে বেশি যা দমন করেছেন, তা হলো নিজেকে। (সম্ভবত সরলাদেবীর সংস্পর্শে এসেই গান্ধী কস্তুরবার অসম্পূর্ণতা আরো প্রকটভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। পিয়ানো বাজানোর মতো শৈল্পিক দক্ষতা, লেখাপড়া শেখা, খদ্দর পরা, জাতপাতের বেড়াজাল এড়ানো এমনকি তার আন্দোলনের মর্মকথা উপলব্ধি করতে কস্তুরবার ব্যর্থতা তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়)।
এই সম্পর্ক এবং সরলাদেবীর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছা মার্টিন গ্রিন গান্ধীর ‘তার সামনে খুলে যাওয়া দরজা বন্ধ করার’ বিষয়টি প্রকাশ করেন এবং বলেন, ‘তারা দু’জনে মিলে নিশ্চিতভাবেই একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক জুটি গড়ে তুলতে পারতেন।’
যদিও গ্রিন সম্পর্কটির অস্থিতিশীল প্রকৃতি এবং সরলাদেবীর ব্যক্তিত্বে, যার মধ্যে ‘অনাদৃত থাকার অনুভূতি’ এবং শক্তিমত্তা ও সিদ্ধান্তহীনতা, গতিশীলতা ও নিষ্ক্রিয়তা, নারীবাদ ও পুরুষ বশীকরণের মতো পারস্পরিক সাংঘর্ষিক উপাদান থাকার কথা জানিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সরলাদেবী ‘একরোখা নারীবাদী’ হলেও তিনি প্রথম স্ত্রী বন্ধ্যা থাকলে বহুবিবাহ সমর্থনও করতেন। গান্ধী দৃশ্যত এ ব্যাপারে তার বিপক্ষে ছিলেন; তিনি এ নিয়ে সরলাদেবীর সাথে ‘তর্ক’ করতেন বলে স্যাঙ্গারকে জানিয়েছেন।
১৯৯৯ সালের অক্টোবর থেকে ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়কালে গান্ধী কয়েক সপ্তাহ দিল্লিতে কাটালেও অধিকাংশ সময় পাঞ্জাবে অবস্থান করে তার (জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কারণ) অনুসন্ধান চালাতে (ও খাদির জনপ্রিয়তা বাড়ানো) ঘুরতেন এবং চৌধুরীদের লাহোরের বাড়িতে তার রিপোর্ট নিয়ে কাজ করতেন। সরলাদেবী প্রায়ই গান্ধীর সাথে পাঞ্জাবে ঘুরে বেড়াতেন, তার জনসভায় বক্তৃতা করতেন বা গান গাইতেন, খাদি পরতেন, এর প্রচারণায় নামতেন এবং পাঞ্জাবকে সত্যাগ্রহের মানে আত্মস্থ করার অনুরোধ করতেন। সরলাদেবী ও গান্ধী উভয়েই হতাশার সাথে বলতেন প্রদেশটির অনেকেই নির্যাতন মেনে নিয়েছে।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে রামভজ দত্ত চৌধুরী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন।
গান্ধী ২৩ জানুয়ারি নবজীবন পত্রিকায় এক রিপোর্টে লিখেন, ‘আমি আগে এক মহিলাকে, তার স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পুরোপুরি একাকী বসবাসকারী, নিঃসঙ্গতার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতাম, আজ দেখছি একটি সুখী দম্পতির মতো...। আমি শ্রীমতী সরলাদেবীর মুখে এক নতুন দীপ্তশিখা দেখেছি। দুর্ভাবনাপীড়িত মুখটি আজ আনন্দে উজ্জ্বল।’ (এরপর শুধু পাঞ্জাব নয়, দিল্লি, বোম্বাই যেখানেই গেছেন গান্ধী, সাথে ছিলেন সরলা। সভায় তার গান গাইতেন, বক্তৃতা দিতেন। মহার্ঘ সিল্কের শাড়ি ছেড়ে তার অঙ্গে ঝলসে ওঠা খদ্দরের শাড়ি, ব্লাউজ দেখতে উপচে পড়তে থাকে জনতা। গান্ধীর খাদি আন্দোলনের তিনি হয়ে উঠলেন ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’। খদ্দরকে তারা আর গরিবের পোশাক বলে তাচ্ছিল্য করছিল না। গান্ধীর নজরে বিষয়টি এড়ায়নি। অন্য দিকে রামভুজ চৌধুরী অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করেননি। এ নিয়ে দাম্পত্য জীবনেও কিছুটা মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল)।
তখন দম্পতির কিশোর পুত্র দীপককে (শান্তিনিকেতন থেকে ছাড়িয়ে এনে) সবরমতিতে (গান্ধীর আশ্রম) পাঠানো হয়, যেখানে দৃশ্যত গান্ধী বালকটির জন্য যেসব শিথিলতার প্রস্তাব করেছিলেন, তা নিয়ে আশ্রমের অধিবাসীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। আর ১৯২০ সালের মার্চে সরলাদেবী নিজে যখন আশ্রমে যান, তখন তার সাথে গান্ধীর আলাপচারিতা নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। (আশ্রমের নিয়ম ছিল সেখানে সবাইকে নিজ হাতে কাজ করতে হবে, এক সাথে খেতে হবে। সরলা সেসব নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না। এমনকি গান্ধী সরলাকে ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াইফ’ সম্বোধন করে নিজে তাকে নিয়ে আলাদাভাবে খাবার গ্রহণ করেন)।
১৯২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ মাস সময়কালে গান্ধী তার ব্যক্তিত্বে স্পষ্টতই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং ভারতকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাদের একত্র হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
গান্ধী সরলাদেবীকে লিখেছিলেন যে, তিনি প্রায়ই তাকে স্বপ্ন দেখেন এবং সে (সরলাদেবী) এক মহাশক্তি। সরলাদেবীর একটি গান ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় এবং নবজীবনে একটি কবিতা প্রকাশিত হয় এবং তাতে গান্ধীর মন্তব্য ছিল এটা ‘নিখুঁত’।
পরবর্তীকালে প্রকাশিত সরলাদেবীর আত্মজীবনীতে এই সম্পর্কের কোনোই উল্লেখ নেই। গান্ধীও তা করেননি, যদিও তার গুটিকয়েক চিঠি ও রেকর্ডকৃত সংলাপে এ নিয়ে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করছে। গান্ধী স্যাঙ্গারকে বলেছিলেন, ‘এটা এত বেশি ব্যক্তিগত যে, আমি তা আমার আত্মজীবনীতে প্রকাশ করেনি।’ রামভুজ দত্ত চৌধুরী মারা যান ১৯২৩ সালে, তবে গান্ধীর আত্মজীবনী প্রকাশের সময়ে সরলাদেবী ও তার পুত্র দীপক বেশ ভালোভাবে বেঁচেছিলেন এবং গান্ধী আবার তাদের আঘাত দেয়া ছাড়া বিষয়টি উল্লেখ করতে পারতেন না।
গান্ধী যখন সরলাদেবীকে অবগত করেন যে, তারা এ নিয়ে আগে ভাবলেও তাদের সম্পর্ক অব্যাহত থাকতে পারে না, তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন। এই পরিবর্তনটা ঘটেছিল ১৯২০ সালের জুনের মাঝামাঝিতে, কারণ গান্ধীর একটি চিঠি পেয়ে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি ১২ জুন তাকে লিখেছিলেন, ‘আপনার টেলিগ্রাম পেলাম। কথা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আশা করি আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।’ আমরা অনুমান করতে পারি গান্ধীর টেলিগ্রামটি (যার বক্তব্য জানা নেই) তার এক সময়ের উদ্বেগের অবসানের জন্য যথেষ্ট ছিল।
এই পরিবর্তনকে স্থায়ী করার জন্য গোপালাচারি ১৬ জুন গান্ধীকে আরেকটি কড়া পত্র লিখেন। ‘আমার প্রিয়তম প্রভু’ সম্বোধন করে তিনি লিখেন সরলাদেবী ও কস্তুরবার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ‘একটি কেরোসিন প্রদীপ’ আর ‘ভোরের সূর্য’র মতো। গান্ধীর ‘সবচেয়ে আতঙ্কিত মোহে’ ঘুরপাক খাওয়ার কথা দৃঢ়তার সাথে বলে গোপালাচারি বলেন, ‘মহাত্মার বর্মটি যদিও মাংসের...। আমি যিশুখ্রিষ্টকে নয় বরং খোলসকেই সতর্ক ও সমালোচনা করেছি। ফিরে এসে আমাদের জীবন দান করুন।... প্রার্থনা করি, এক্ষুনি পুরোপুরি আপনাকে বিচ্ছিন্ন করুন।’
অন্য দিকে বিধ্বস্ত সরলাদেবী জানালেন, তিনি ‘পৃথিবীর সকল আনন্দ ও সুখ একপাত্রে এবং অন্যটিতে বাপু ও তার নিয়মকানুন রেখেছিলেন, আর তিনি দ্বিতীয়টিকে বেছে নিয়ে বোকামি করেছিলেন।’
সরলাদেবী ব্যাখ্যা চাইলেন, যে কারণে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে গান্ধী শেষ পর্যন্ত কৈফিয়ত দিয়ে একটি চিঠি লিখতে বাধ্য হলেন :
‘আমি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বিশ্লেষণ করেছি। আমি আধ্যাত্মিকের (বিবাহ) একটি সংজ্ঞা পেয়েছি। এটা হলো বিপরীত লিঙ্গের দু’জন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক যেখানে শারীরিক বিষয়টা থাকবে পুরোপুরি অনুপস্থিত। এটা তাই ভাই ও বোনের মধ্যে, পিতা ও কন্যার মধ্যে হওয়া সম্ভব। এটা শুধু দুই ব্রাহ্মচারীর চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্যে হওয়া সম্ভব।... ’
‘আমাদের কী সেই অসাধারণ; নির্মলতা, সেই নিখুঁত ঐক্যতান, সেই নিখুঁত একাত্মতা, সেই আদর্শের পরিচিতি, সেই আত্মবিস্মরণশীলতা, সেই লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত, সেই বিশ্বস্ততা আছে? আমার নিজের জন্য এর সাদামাটা উত্তর হলো এটা নিছক একটা আকাক্সক্ষা। তোমার সাথে সেই সঙ্গলাভের যোগ্য আমি নই।... আমার প্রতিশ্র“ত বড় পত্র এটা। আমার মধ্যে এখনো বিদ্যমান গভীরতম ভালোবাসার সাথে। তোমার এল জি।’
স্বাক্ষরে থাকা এল জি মানে দণ্ডদাতা , এই পদবিটির মাধ্যমে সরলাদেবী গান্ধীকে তিরস্কার করেছিলেন। সাহসী প্রয়াসযুক্ত এই চিঠিটি সরলাদেবীকে শান্ত করতে পারেনি। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি গান্ধীর সমালোচনা করেছেন, কখনো এই বলে যে গান্ধী ঘৃণাসহকারে অহিংসতা ছড়ানো অনুমোদন করেছেন, আবার অন্য সময়ে বলেছেন তিনি হিন্দু নন, বরং খ্রিষ্টীয়-বৌদ্ধিক মানসিকতাসম্পন্ন। (সরলাদেবীর ভাবনায় এ সময় সম্ভবত অনেক কিছুই আসত। সরলার লাঠিখেলা, বিপ্লবিয়ানা কখনোই তার মামা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পছন্দ করেননি। তিনি বরাবর ভেবেছেন, মেয়েরা হবে নরমসরম, ধীর পায়ে হাঁটবে, নিচু গলায় কথা বলবে। কিন্তু গান্ধী? তার কাছেও সরলা শুধু খদ্দরের ফ্যাশন-মডেল! চমৎকার! মেয়েদের দাবিয়ে রাখার ব্যাপারে এই দেশে মরমি কবি আর সন্ত-রাজনীতিকের তফাত নেই। গান্ধীজী তো পুরুষ, সর্বেসর্বা। তিনিই আইন প্রণয়ন করবেন, দণ্ড দেবেন। হে দণ্ডদাতা আমার!) এর পরও গান্ধীর সাথে সরলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। এমনকি রামভুজ মারা যাওয়ার পর বিধবা সরলা কলকাতায় চলে এলেও মাঝে মধ্যে সরবমতিতে যেতেন। তবে তখনো তিনি সেখানকার নিয়ম মানতে চাইতেন না এবং হঠাৎই সেখান থেকে চলে যেতেন।
১৯৪০-এর দশকে সরলাদেবীর আগ্রহে গান্ধী জওয়াহেরলাল নেহরুকে তার মেয়ের সাথে দীপকের বিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি (নেহরু কৌশলে প্রস্তাবটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন)। তবে সরলাদেবী ও গান্ধী উভয়ে মারা যাওয়ার পর দীপক মগনলাল গান্ধীর মেয়ে রাধাকে বিয়ে করেন। যদিও তারা উভয়েই এই রোমাঞ্চের খবর জানতেন। মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার জন্য কিছু সময় ব্যয় শেষে সরলাদেবী আধ্যাত্মিকতায় ঝুঁকে পড়েন এবং ১৯৩৫ সালে একজন গুরু (হাওড়ার আচার্য বিনয়কৃষ্ণ) গ্রহণ করেন। তিনি মারা যান ১৯৪৫ সালে (কস্তুরবাও মারা যান একই বছর আগা খান প্যালেসে বন্দী গান্ধীর কোলে মাথা রেখে)। (সরলাদেবীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় গান্ধী তার স্বদেশী ব্রোচের প্রশংসা করেছিলেন, তা জানিয়েছেন। উল্লেখিত কিছু লাইন ছাড়া গান্ধীর সম্পর্কে আর কিছুই নেই সেখানে)।
এই প্রেম নিয়ে কস্তুরবাকে গান্ধী কিছু বলেছিলেন কি না তা জানা যায় না। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, কস্তুরবা এ সম্পর্ক এবং তার গভীরতা লক্ষ করেছিলেন।