ড. আনিসুজ্জামান আমাদের কাজ কিছুটা সহজ করে দিয়েছেন
ড. আনিসুজ্জামান - সংগৃহীত
পাকিস্তান নামে ১৯৪৭ সালে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার সময় থেকেই আমরা পাকিস্তান পছন্দ করি অথবা না করি কঠিন সত্যটা হলো, পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা প্রত্যেকেই পাকিস্তান জন্মের বেনিফিসিয়ারি বা সুবিধাভোগী কোনো-না-কোনোভাবে। সেটি অন্তত এই মহাসত্যের কারণে যে, সাতচল্লিশের আগে তারা ছিলেন জমিদারের প্রজা অথচ পাকিস্তান হবার পরে তাদের এক প্রকার মুক্তি ঘটেছিল। প্রজা পরিচয় থেকে মুক্তি বলতে শুধু জমিদারি উচ্ছেদই নয়, স্বাধীন পাকিস্তানে ওই চাষাবাদের জমির ভোগদখলের দলিল পেয়েছিলেন ‘চাষা’রা নিজের নামে, অন্তত ১৯৫১ সালের পরে। ধর্ম বা দল নির্বিশেষে মূলত সবাই প্রত্যেকে এতে লাভবান। এমনকি যারা পাকিস্তান আন্দোলন করেননি বা পাকিস্তান কায়েম হওয়া পছন্দ করেননি তারাও হয়েছেন লাভবান।
আজব ঘটনাটা হলো, স্বাধীন পাকিস্তান কায়েম হবার পরবর্তী কালের পাকিস্তানে ‘সাতচল্লিশের দেশভাগ’ যে সঠিক হয়েছিল এমন কোনো বয়ান ছিল না। পাকিস্তান কায়েম ‘সঠিক’ বলে ইতিহাসে তা লিখতে দ্বিধা ছিল। টেক্সটবুকে পাকিস্তান কায়েমের পক্ষে সাফাই বক্তব্যের দেখা মেলে না। এখনো এমনই আছে। যেন পাকিস্তানের জন্ম ‘অবৈধ’, যার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না । অথচ বাসিন্দারা আসলে এর সুবিধাভোগী। জমিদারি আইন উচ্ছেদের সুবিধা উত্তরসূরিরা প্রত্যেকে ভোগ করে গেছেন, এখনো করছে। তবুও ১৯৪৭-১৯৭১ এ সময়টা আমাদের ইতিহাসে যেন একটা ভ্যাকুয়াম। তখন কি কিছুই হয়নি? অথবা কী হয়েছিল সেটি কেউ বলতে চান না। তাহলে ‘এরা’ জমির মালিকানা পেলেন কী করে? কেউ বলতে চান না। তারা সম্ভবত বলতে চান, পাকিস্তান কায়েম হওয়াটাই ভুল ছিল। পাকিস্তান জন্মানোর পরে আমাদের অন্যান্য চাহিদা বা অভিমুখ তৈরি হতেই পারে। পাকিস্তানই ভাঙতেও চাইতে পারি। কিন্তু সে জন্য তো পাকিস্তান কায়েম হবার ঘটনাটা মিথ্যা নয়।
ইতিহাস জিনিসটা এমন যে, নানা দেশ-রাষ্ট্র অনুসারে এসবের বিষয়ে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য হবেই। এমনকি একই দেশের ভেতরেও অন্তত তিনটি ভিন্ন ভাষ্য দেখা যেতে পারে। সব দেশেই এমন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে মোটামুটি মৌলিক গল্পকাঠামো ভাষ্যটা একই, আর বাদবাকি অংশ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। তবে দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পুরা বয়ানই ভিন্ন হয়ে যাবে। যেমন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভাষ্য-বয়ান ভিন্ন হবেই। ১৯৭১ সাল নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ভাষ্যও হবে ভিন্ন। পাকিস্তান কায়েমের পরে পূর্ব-পাকিস্তানের নিজের লিখিত ভাষ্য-বয়ান না থাকায়, পূর্ব পাকিস্তানিরা আপন করে নেয় এমন বয়ানভাষ্য না থাকায় কী হয়েছে? এমন লিখিত ইতিহাস ভাষ্য না থাকলে যেটা হবার কথা, কলকাতায় প্রচলিত টেক্সটবুকের ভাষ্যবয়ান কিছু দিন পরে এখানে চালু হয়ে যেতে পারে। কারণ, বয়ান খালি থাকে না। একসময় বাংলাদেশেরই কেউ হয়তো কলকাতার সেসব বই পড়ে তা থেকে নিজেই কলকাতার বয়ানে বাংলাদেশের ইতিহাস লিখে বসবেন। আর তা চালু হয়ে যাবে। আমরা কলকাতার বয়ানে ইতিহাস পড়লে অসুবিধা কী? অসুবিধা হলো ওটা আসলে কলকাতার জমিদারির আধিপত্যের স্বপক্ষে এক সাফাই-ভাষ্য।
ড. আনিসুজ্জামান আমাদের কাজ কিছুটা সহজ করে দিয়েছেন প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে ২০১৪ সালে, আর সেটিই গতকাল নতুন শিরোনামে পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। পুরানা শিরোনাম ছিল, ‘বাংলা সাহিত্যে যা আছে, সবই আমার’। ওখানে তিনি বলছেন, বাবা-মাসহ তার পরিবার কলকাতায় থাকার সময় পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, স্লোগান দিয়েছেন। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পরে পরে ওপার বাংলার ২৪ পরগনার বসিরহাটের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও নতুন পাকিস্তানে এসে পড়েছিলেন। নানা সুযোগ- সুবিধার জন্য খুলনায় পুরা পরিবার মোহাজের হয়ে বসবাস শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে আসার পর এবার মুসলিম লীগের সমর্থন ছেড়ে দিলেন। কেন? তিনি বলছেন, ‘১৯৪৬ সালে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গার সময়’ থেকে ‘আমার মনে জিজ্ঞাসা জাগল’। তিনি বলছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, মানুষের মৃত্যু, এসব আমার মন-মানসিকতা বদলে দেয়’।
এর পরের প্যারায় আরেকটু পরিষ্কার করে বলছেন, ‘একদিকে সাম্প্র্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি; আবার পাকিস্তান টিকে থাক, সেটাও চাচ্ছি।’ তার মানে পাকিস্তান টিকে থাকাটাকে তিনি কথিত সাম্প্র্রদায়িকতা বলছেন। আর শেষে বলছেন, ‘তখন সাম্প্র্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েই পাকিস্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করে।’ অর্থাৎ এবার আমরা জানতে পারছি তার চিন্তা ও মনের হিসাবে ‘শত্রু’ বলে তিনি যাকে চিনেছেন তা হলো ‘সাম্প্র্রদায়িকতা’। কিন্তু সাম্প্র্রদায়িকতা বলে তিনি কি আসলে সেটিকে চিনেছেন? মনে হয় না। তিনি বরং সাম্প্র্রদায়িকতা বলে আবছা আড়ালে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। কেন?