যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোটের উত্থান-পতন

সাদ রাসুল | May 12, 2020 09:48 am
মোদি ও ট্রাম্প

মোদি ও ট্রাম্প - সংগৃহীত

 

আধুনিক ইতিহাস, এর মিত্রজোট, এর ফ্ল্যাশপয়েন্ট, বিস্তৃতি মাত্র এক শ’ বছর আগের। বিশ শতক শুরুর সময় বিশ্ব ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থান। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য ছিল প্রধানত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, উসমানিয়া খিলাফত, ফরাসি ক্ষমতার পকেটের মধ্যে বিভক্ত। রাশিয়া, চীন এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ছিল অতি সামান্য, যদিও ভঙ্গুর সাময়িক মিত্রতার গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তা বদলে দিয়ে পুরনো বিশ্বব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

কিন্তু যুদ্ধের পরও ‘অ্যাজেন্ডা’ অসম্পূর্ণই থেকে যায়। জার্মানি তার সামরিক শক্তির অংশবিশেষ ধরে রাখে, জাপানের আকার কমেনি, পশ্চিম গোলার্ধে আমেরিকার প্রাধান্য তখনো বিকাশমান পর্যায়ে ছিল।
এই অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডা বিশ্বকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করে। এটি ছিল অনেক বেশি সিদ্ধান্তসূচক। এবার জার্মানি ও জাপানের পরাজয় ছিল শর্তহীন। যুদ্ধ-লুণ্ঠনের পরিণামে আধুনিক কালের মধ্যপ্রাচ্যের সৃষ্টি হয়। এটি পাশ্চাত্যে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করে। এর রেশ ধরে জাতিসঙ্ঘের মতো প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়।

অবশ্য, পাশ্চাত্য যখন জয় উদযাপন করছিল, তার ইচ্ছামতো আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ করছিল, তখনই ইউরোপের অর্ধেক অংশজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যানারে কঠোর শাসনের সূত্রপাত ঘটে। তবে বোর সব প্রধান সামরিক শক্তির ভাণ্ডানে পরমাণু অস্ত্র থাকায় সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রতি কারো আগ্রহ ছিল না। এর বদলে স্নায়ুযুদ্ধ চলে অর্থনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আর কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানে হয় প্রক্সি ওয়ার।
১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয়, ১৯৯১ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীরের পতনে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে, একমেরুর যুগে প্রবেশ করে বিশ্ব। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই প্রথম পুরো বিশ্ব একটি একক দেশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠি হয়। দেশটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯০-এর দশকে এই নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রকে নিরবচ্ছিন্ন সমৃদ্ধির দিকে চালিত করে। তাদের সামরিক শক্তি ছিল চ্যালেঞ্জহীন। তাদের অর্থনৈতিক ছুটে চলা ছিল বাধাহীন। তাদের রাজনৈতিক পুঁজি মনে হতে থাকে অফুরন্ত।

আগে সোভিয়েত ব্লকে থাকা অনেক দেশ তাদের আনুগত্য বদলাতে থাকে। এসব দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত।
১৯৯০-এর দশকে ভারত তার আন্তর্জাতিক অবস্থান পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেয়। আর ৯/১১-এর প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র তার একমেরুর পেশীশক্তি আফগানিস্তানে প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারত তার সঙ্গী হয় দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরে আমেরিকার কৌশলগত অংশীদার হয়ে। আমেরিকার মদতপুষ্ট হয়ে এই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য হিসেবে নিজেকে বিবেচনা করে ভারত। এই প্রক্রিয়ায় সে পাকিস্তানকে নিঃসঙ্গ করার উদ্যোগ নেয়, একে এক নম্বর বৈশ্বিক শত্রু হিসেবে চিত্রিত করে। বস্তুত, কয়েক বছর আগে এই কৌশল নতুন করে অবয়ব নিয়েছিল আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘আফ-পাক’কে একটি অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত অংশীদার ভারতকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিল চীনকে মোকাবেলার জন্য।

এই কৌশল ভারতের জন্য দারুণভাবে কাজ করে প্রায় দুই দশক ধরে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভারত অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভাবিত হতে আগ্রহী মধ্যপ্রাচ্যের রাজন্যেদের (তারা তাদের টিকে থাকার জন্য আমেরিকার সামরিক ও আর্থিক উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল) মধ্যে আনুকূল্য অর্জন করে। মনে হতে থাকে যে অবশেষে পাকিস্তান নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। অবশ্য নওয়াজ শরিফ, আসিফ জারদারি ও পারভেজ মোশাররফের কয়েক দশকের অপশাসন এতে সহায়ক হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বে যাওয়া গর্ব, মুসলিম বিশ্বের দায়িত্বহীন নেতৃত্বে (পাকিস্তানের নিঃসঙ্গ থাকাসহ) সাহসী হয়ে ভারত এখন পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদে মদত দিতে থাকে, আফগানিস্তানের এনডিএসে অনুপ্রবেশ করে, কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দেয়ার মতো পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে থাকে।

অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন কিছু ঘটছে। একমেরুর বিশ্ববিষয়ক মার্কিন মিথ গুঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছে ছায়া থেকে চীনের বের হয়ে আসা এবং ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার শক্তি সঞ্চয়ের ফলে। এই কিছু দিন আগে একমেরুর বিশ্বে বসবাসকারী বন্ধু ও শত্রুরা এখন অন্য আন্তর্জাতিক বিকল্প খুঁজছে। এ কারণেই সিরিয়া, লেবানন বা উপসাগরীয় সাম্রাজ্যের অংশবিশেষে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চায়, ঠিক সেভাবে সরকার পরিবর্তন হচ্ছে না। এমনকি আফগানিস্তান পর্যন্ত আমেরিকা ও তার মিত্রদের (পড়ুন : ভারত) হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের একমেরুর রাজনৈতিক শক্তি হ্রাস পেতে থাকলেও এর সামরিক শক্তির মিথ এখনো চ্যালেঞ্জহীন রয়ে গেছে। ‘বৃহত্তম ও এখন পর্যন্ত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ’ সামরিক সাম্রাজ্য- এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে ইরানকে সামরিক যুদ্ধে প্রলুব্ধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিভাবে? প্রথমে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে। বিশেষ করে আরামকোতে হামলার পর। কিন্তু তা কাজে না লাগায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের ওপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এটি করা হয় জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে বিনা উস্কানিতে হত্যা করার মাধ্যমে।
কিন্তু পেন্টাগনের ডিপ স্টেট এস্টাবলিশমেন্টের নীতিনির্ধারকেরা পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না এরপর কী ঘটবে। ইরান নতজানু হয়নি। এই অঞ্চলে আমেরিকার শক্তি সুসংহত হওয়ার বগদলে বরং দুর্বল হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে চীন ও রাশিয়ার মতো বিকল্প জোটের দিকে তাকাতে বাধ্য করছে।

কোভিড-১৯-এ প্রবেশ করুন। গত বছরের শেষ দিকে বিশ্ব যখন ক্ষমতার ভারসাম্যে দোলা খাচ্ছিল, তখন করোনাভাইরাস দ্রুতগতিতে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা আশা করেছিল যে এটি চীন ও এর আশপাশের এলাকায় সীমিত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। যে চীনে ভাররাসটির সূচনা ঘটেছিল, তারা এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সাফল্য পায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা মুক্ত বিশ্ব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশ্চাত্যই সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছে। অথচ চীন তার ব্যবসা আবার শুরু করে দিয়েছে।
বাস্তবতা কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, তা না জেনে আমেরিকান দম্ভ চীনকে দোষারোপ করতে থাকে। আর এর উদ্দেশ্য হলো নতুন একটি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করা। আর এটি আগের অর্থনৈতিক ও সামরিক না হয়ে তা হবে প্যাসিফিকে। কিংবা আমরা বলতে পারি ইন্দো-প্যাসিফিকে।
অন্যদিকে চীন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের মাধ্যমে তার আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তারের দিকে নজর দিয়েছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সিপিইসি।

প্রায় রাতারাতি দক্ষিণ এশিয়া বদলে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে ভারত পরবর্তী বিশাল বিষয় থেকে পেচনে হটে গেছে। সেই ‘হাউডি মোদি’ অবস্থান আর নেই। মোদি এখন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে অবস্থান বদলাতে চাচ্ছেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর তা অতি সামান্য।

সূত্র : গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us