ইরানকে ভয় পাচ্ছেন ট্রাম্প!
ট্রাম্প - সংগৃহীত
গত ২২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি টুইটে বলা হয় : সাগরে আমাদের জাহাজে হয়রানি করা হলে যেকোনো বা সব ইরানি গানবোট ধ্বংস করার জন্য ইউএস নেভিকে আমি নির্দেশ দিয়েছি।‘ ট্রাম্প মনে হয় যুদ্ধের ভাষাতেই কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ সঙ্কট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মনোযোগ ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প।
ওই টুইটের ব্যাপারে টাইম জানায়, হোয়াইট হাউস তাক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। ইউএস নেভির বাহরাইনভিত্তিক ৫ম ফ্লিট টুইটটি নিয়ে পেন্টাগনের কাছে প্রশ্ন তুলেছে আর পেন্টাগন তা হোয়াইট হাউজের দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
আর এদিকে তেহরান একে পাত্তাই দেয়নি। ইরানি সশস্ত্র বাহিনীল মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল শেকারচি অবজ্ঞাপূর্ণভাবে বলেন, অন্যদের গালাগাল না করে আমেরিকার উচিত হবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তাদের বাহিনীকে রক্ষা করা।
ট্রাম্প দৃশ্যত ১৫ এপ্রিল ইউএস নেভির একটি অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলেন। অভিযোগে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক পানিসীমায় মোতায়েন বেশ কয়েকটি ইউএস নেভাল শিপের প্রতি বিপজ্জনক ও হয়রানিমূলক আচরণ করছে ১১টি ইরানি নৌযান। ইরানি বিপ্লবী বাহিনীর নৌশাখার স্পিডবোটগুলো ইরানি পানিসীমার কাছাকাছি মোতায়েন মার্কিন রণতরীগুলোর খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল বলেই মনে হয়েছে।
মার্কিন রণতরীগুলোরমধ্যে রয়েছে মার্কিন হামলায় প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত লুইজ বি পুলার, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রোয়ার পল হ্যামিল্টন, দুটি উপকূলীয় টহল নৌকা ও দুটি কোস্ট গার্ড শিপ।
ইউএস নেভির বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানি বাহিনীর বিপজ্জনক ও উস্কানিমূলক কার্যক্রমের ফলে বিভ্রান্তিমূলক কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইরানিরা আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করছে না বলেও অভিযোগ করা হয়।
কিন্তু ১৯ এপ্রিল ইরানিরা যে ভিডিও প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ইরানি আন্তর্জাতিক পানিসীমায় প্রবেশ করতে চাওয়া মার্কিন রণতরীগুলোকে সতর্ক করে দিচ্ছে ইরানি বাহিনী। ইরানি সতর্কবার্তার পর মার্কিন জাহাজগুলো সরে যায়।
এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয় এবং উভয় পক্ষই জানে কিভাবে উত্তেজনা প্রশমন করতে হয়। এতে নাক গলানোর কোনোই দরকার ছিল না ট্রাম্পের। মার্কিন উপসাগরীয় মিত্ররা যখন কোভিড-১৯ নিয়ে ব্যস্ত তখন এ ধরনের বিষয়গুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার ছিল ট্রাম্পের।
আবার ইউএস নেভিতেও ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটছে। মার্কিন বিমানবাহী রণতরী থিওডোর রুজভেল্ট গুয়ামের প্যাসিফিক আইল্যান্ডে রাখা হয়েছে। এর কয়েক শ’ ক্রুর করোনাভাইরাস পজেটিভ হওয়ায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
নাবিকদের করোনা টেস্ট পজেটিভ হওয়ায় রণতরী নিমিটজ, রোনাল্ড রিগ্যান ও কার্ল ভিনসনকেও নোঙর করিয়ে রাখা হয়েছে। আবার বন্দরে ভিড়লে ট্রুম্যানের ক্রুরাও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, এই শঙ্কায় বিমানবাহী রণতরীটিকে সাগরেই রাখা হয়েছে।
সাবেক নৌমন্ত্রী রে মাবাস (২০০৯-২০১৭ সময়কালে দায়িত্ব পালনকারী) বলেন, আমার মনে হয়, তাদের উচিত হবে বেশির ভাগ ক্রুকে নামিয়ে আনা। তারপর পুরো জাহাজ স্যানিটাইজ করতে হবে, লোকজনকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে দুই সপ্তাহ।
তবে মনে হয় না ইরান যুদ্ধের চেষ্টা করছে। দেশটি মাত্র করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তবে করোনায় তাদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে, ছয় হাজারের বেশি মারা গেছে। তবে বাস্তবে মার্কিন সর্বোচ্চ চাপ দেয়ার নীতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও ইরান অটল থাকায় ওয়াশিংটনই ভড়কে গেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন এমনকি কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছে ৫ বিলিয়ন ঋণ গ্রহণের অনুরোধেও বাধা দেয়। অথচ এই দেশটি ছিল করোনার আঞ্চলিক ইপিসেন্টার।
করোনার দুর্যোগের মধ্যে অবরোধ শিথিল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন পর্যন্ত অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও বিদ্রুপ করে বলেছেন, ইরান আইএমএফ তহবিল করোনাভাইরাসের জন্য ব্যয় না করে ব্যাপক বিধ্বংস অস্ত্র নির্মাণে খরচ করবে।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন বেশ কষ্টের সাথেই দেখে যে ২২ এপ্রিল ইরান তিন স্তরের কাসেদ রকেট মারকাজি মরুভূমি থেকে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়। এটি ভুপৃষ্ঠের ৪২৫ কিলোমিটার ওপরে একটি সামরিক কিকনসাঁস উপগ্রহ পাঠায়। এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট ক্যারিয়ারে কম্বাইন্ড ফুয়েল ব্যবহারকারী সামরিক উপগ্রহ পাঠানোর পরাশক্তিগুলোর সামর্থ্যের অধিকারী হলো ইরান।
এরপরপরই ইরানি বিপ্লবী বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসাইন সালামি বলেন, ইরানি বিজ্ঞানীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সম্পন্ন করেছে। কোনো বাধাই ইরানি অগ্রগতিতে রোধ করতে পারবে না।
সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, ট্রাম্পের কাছে বিকল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে। পেছনে তাকালে দেখা যাবে, কুদক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে ভয়াবহ ধরনের ভুল করেছিলেন ট্রাম্প। ওই ঘটনার কয়েক মাস পর যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত ছিল কৌশলগত একটি ভুল।
সোলায়মানিকে হত্যার ফলে নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা বাড়েনি। আবার সিরিয়া ও ইরাকে প্রতিরোধ বলয় গড়ে তোলার ইরানি দৃঢ়সংকল্পও দুর্বল করেনি। বরং ইরাকে মার্কিন অবস্থান নাজুক করে দিয়েছে। আরো গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাপারে ইরানের মনোভাব আরো কঠিন হয়েছে। ২০ এপ্রিল ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ দামেস্ক সফর করেন। আর সোলায়মানির উত্তরসূরী ইসমাইল গানি বাগদাদ যান। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে বৈঠককালে জারিফ বলেন, প্রতিরোধের প্রতি ইরানি সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
এদিকে আফগানিস্তানের প্রতি সক্রিয় নীতি গ্রহণ করেছে ইরন। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্ততাকারী মোহাম্মদ ইব্রাহিম তেহেরিয়ান ২০ এপ্রিল কাবুল সফর করেন। এখন মনে হচ্ছে, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে যা ইচ্ছা তাই করতে দেবে না ইরান। এছাড়া জারিফ আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে কাবুল, আঙ্কারা, বেইজিং, নয়া দিল্লি, মস্কো ও দোহায় তার প্রতিপক্ষদের সাথে কথা বলেন।
ইরান এখন আফগান নিষ্পত্তির ব্যঅপারে ওয়াশিংটনের স্বনির্ধারিত ভূমিকা চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। তেহরানের আঞ্চলিক কৌশলের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন উপস্থিতির অবসান ঘটানো।
কাউন্টারপাঞ্চ.অর্গ