মিয়ানমারে নির্বাচন : সু চি কি জিতবেন?
সু চি - সংগৃহীত
চলতি বছরের শেষ দিকে ছয় দশকের মধ্যে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে মিয়ানমারে। বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের কারণে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনৈা অস্পষ্ট রয়ে গেলেও আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলটি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে এবং এতে করে দেশটির সংস্কার ও স্বাধীনতার ভবিষ্যত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।
মিয়ানমার প্রায় অর্ধ শত বছর তাতমাদাও নামে পরিচিত সামরিক বাহিনীর শাসনে ছিল। ২০১০-এর দশকে দেশটিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের জের ধরে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আশাবাদের সূচনা হয়। এর ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্রের আইকন আং সান সু চির নেতৃত্বে ২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুলভাবে জয়ী হয়।
প্রায় ৫ বছর ধরে সু চি ও এনএলডি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারে হাত দেয়। তারা দায়িত্ব গ্রহণের সময় যে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল, এখন আর তা নেই। রাজনৈতিকভাবে সু চির সাথে জাতিগত গ্রুপগুলোর সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে, জাতীয় ঐকমত্য ও বিকেন্দ্রীকরণের আশা ম্লান হয়ে পড়েছে, সামরিক বাহিনীর (তারা এখনো বিপুল স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী) সাথে তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বিদেশে তাদের অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। এর পরিণতিতে চীনের ওপর তাদের নির্ভরতা আরো বেড়েছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তাগতভাবে চলমান জাতিগত সঙ্ঘাত অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই সঙ্ঘাত চলছে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে। ফলে এই জাতিগত সঙ্ঘাত বিশ্বের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯-এর মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলেও তা টেকেনি। জাতিগত গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া নতুন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং অন্যান্য গ্রুপগুলোর প্রভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, ২০২০ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবে না।
অর্থনৈতিকভাবে এনএলডি ব্যবসাকে উৎসাহিত করতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সুযোগটি তেমনভাবে গ্রহণ করা যায়নি। চাকরি, অবকাঠামো, বিদেশী বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থবির হয়ে রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়াসে অগ্রগতি না হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারে কোভিড-১৯-এর বিস্তার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতো না হলেও এটি নিকট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় সমস্যা সৃষ্টি করবে। আর এনএলডি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২০ সালের নির্বাচনে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক- সব মিলিয়েই ২০১৫ সালের নির্বাচনে যে আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল এনএলডি, ২০২০ সালের নির্বাচনে তেমনটি আর বিরাজ করছে না। এবার অনেক জাতিগত এলাকা ও দেশের নগর এলাকায় তাদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। আরো ব্যাপক অর্থে বলা যায়, নির্বাচনটি দেশের ভঙ্গুর নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সংহত করতে সহায়তা করলেও এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে করে সময়মতো তা হতে পারে কিনা তা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া বিশেষ করে সঙ্ঘাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হবে কিনা তাও একটি প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন এনএলডির জন্য বিপর্যয়কর হবে এমনটি বলা যায় না। ক্ষমতায় থাকার সময় তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও সু চি এখনো বেশ প্রভাব রাখেন এবং তিনি এখনো দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। ফলে তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। আবার কোভিড-১৯ ক্ষতির মধ্যেও লাভ সৃষ্টি করতে পারে। এটি এনএলডি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে, আবার এর ফলে দলের অন্তঃদ্বন্দ্ব ছিল, তাও চাপা পড়ে যেতে পারে। ফলে দলের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি হয়ে তাদের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে।
তবে তারা ক্ষমতায় ফিরে এলেও তা ২০১৫ সালের ভূমিধস জয়ের মতো হবে না। তাছাড়া তারা ক্ষমতায় এসেও আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
কিন্তু তাই বলে এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা বলা হচ্ছে না। বরং এই নির্বাচন ভঙ্গুর নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে পারে।
দি ডিপ্লোম্যাট