ভারতীয় টিভির 'করোনা বোমায়' বিধ্বস্ত নেপালি মুসলিমরা!
ভারতীয় টিভির 'করোনা বোমায়' বিধ্বস্ত নেপালি মুসলিমরা! - সংগৃহীত
আশরাফ শাহ চলতি সপ্তাহে কাঠমান্ডুর কেন্দ্রে অবস্থিত জনশূন্য কাশ্মিরি মসজিদে নামাজ পড়ার সময় নিজেকে নিঃস্ব মনে হলো। পবিত্র রজমান মাসে মসজিদটি জনাকীর্ণ ও কলাহলময় থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন দিনে ৫ বার আজানের সময় তা ফাঁকা মসজিদেই প্রতিধ্বনিত হয়।
নেপালে ২৪ মার্চ থেকে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন চলছে, তা ৭ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৭৫ জন শনাক্ত হয়েছে। এদের অনেকে মুসলিম হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নেপালগঞ্জ, বিরগঞ্জ, রাউতাহাট ও উদয়পুরে লোকজন তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলছে।
আশরাফ কথাই বলতে পারছেন না। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা এখন কোন দুনিয়ায় বাস করছি।
রজমান সবসময় বন্ধু-পরিবার নিয়ে উদযাপনের মাস, বিশেষ করে ইফতার হয় জাঁকজমকপূর্ণভাবেই। চলতি বছর ভাইরাসটির জন্য মুসলিমদেরকেই দায়ী করা হবে এমন আশঙ্কায় নেপালের এই সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ আর শঙ্কা ঢুকে পড়েছে। নেপালিরা হিন্দি টিভি চ্যানেল দেখায় ভারতীয় মিডিয়ায় ভাইরাসটি ছড়ানোর জন্য মুসলিমদের বলির পাঁঠা বানানোর বিষয়গুলো তাদের নজরে আসছে।
নেপাল জামে মসজিদের প্রধান আবদুল শামিম বলেন, নেপালে মুসলিমরা সংখ্যালগু। তারা কয়েক শ’ বছর ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আছে। কিন্তু এখন ভবিষ্যত মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর, বিদেশীভীতি ও অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়েছে।
এপ্রিলের প্রথম দিকে উদয়পুরের একটি মসজিদে অবস্থানরত তাবলিগি জামাতের ১৩ জনের করোনাভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ে। এদের ১১ জন ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। তারা ধর্মপ্রচারের জন্য নেপালে এসেছিলেন। এর পর থেকে জেলাটিকে কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব লোকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
উদয়পুরের রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট নাজবুল নিলাম উদ্বিগ্ন। যদিও যাদের পজেটিভ এসেছে, তাদের বেশির ভাগই ভারতীয় নাগরিক, কিন্তু স্থানীয়রা আঙুল তুলছে মুসলিমদের দিকেই।
তিনি বলেন, তারা আমাদের সাথে কথা বলা এড়িয়ে চলছে, আমাদের দেখলে তারা রাস্তার অন্য পাড়ে চলে যায়। অনেক সময় মুখের চেয়ে চোখই বেশি কথা বলে।
বিশ্বজুড়েই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ভারত ও নেপালে প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপরই দায় বর্তেছে। এর কারণ সামাজিক মাধ্যম ও টিভি নেটওয়ার্কগুলোতে তাদেরকেই বিস্তারকারী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ ধরনের সঙ্কটের সময় রজমান হতে পারত সংসহি প্রকাশ ও ঐক্যবদ্ধ করার মাস। কিন্তু লকডাউনের কারণে তাও হচ্ছে না।
শামিম বলেন, রজমানে যাতে ভালো কিছু খাবার খাওয়া যায়, সেজন্য আমরা গত ১১ মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ সঞ্চয় করেছিলাম। তিনি এই সমস্যার জন্য ভারতীয় টিভির ‘করোনা বোমা’ কভারেজকে দায়ী করেন। তিনি ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে দালিম মুখিয়া নামের এক নেপালি নাগরিকের ভারতে করোনা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য করোনায় আক্রান্ত লোকদেরকে দেশটিতে অনুপ্রবেশ ঘটনানোর একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ফাঁস হওয়ার একটি মেমোর প্রচারের কথা উল্লেখ করেন।
এ ধরনের প্রচার ভাইরাসটির চেয়েও দ্রুত গতিতে কাঠমান্ডু উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
উদয়পুর ও বিরগঞ্জে করোনা বিস্তারের পর পুলিশ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কাঠমান্ডুর কাশ্মিরি মসজিদের প্রাঙ্গনে অনুসন্ধান চালায়। তারা মসজিদের ৯ কর্মীর পরীক্ষা করে। তাদের সবাই নেগেটিভ হয়। কিন্তু তাতেও ভীতি কমেনি। বিশেষ করে নেপালগঞ্জ মসজিদে ৬০ জনের মধ্যে ৯ জনের পজেটিভ হওয়ায় ভীতির সঞ্চার হয়।
চলতি বছর ৬৪ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ ইসরাইলের জন্য রমজান একইভাবে আসেনি। তিনি ১৯৮২ সাল থেকে রমজান মাসে কাশ্মিরি মসজিদে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এই দলটি রমজান মাষে প্রতিদিন তিন শতাধিক লোকের জন্য খাবার প্রস্তুত করত।
কিন্তু এবার ইসরাইল তার পরিবারের সাথে থামেলে আটকে আছেন। তার সম্প্রদায়ের অন্যদের মতো তিনিও সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন অনুসরণ করছেন।
তিনি বলেন, লোকজনের জন্য খাবার রান্না করতে আমি পছন্দ করি। অসহায়দের খাওয়ানো একটি ভালো কাজ। তিনি জানান, তিনি রুমালি রুটি, চানা, কিমা সামোসা, আলু কিমা, পাকোরা, ফিরনি রান্না করেন ইফতারের জন্য।
তিনি বলেন, চার দশকের মধ্যে এই প্রথম ইসরাইল তার ছোট্ট রান্নাঘরে ছোট ছোট হাড়িপাতিলে রান্না করছেন। তিনি বলেন, আমি বড় বড় ডেকচিতে রান্না করতে অভ্যস্ত। এগুলো একেবারেই ছোট।
নেপালি টাইমস