যেভাবে খলিফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রা.)

হামিদ মীর | May 04, 2020 09:28 pm
যেভাবে খলিফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রা.)

যেভাবে খলিফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রা.) - সংগৃহীত

 

এক শক্তিধর শাসক তার সময়ের একজন বিখ্যাত আলেমে দ্বীনকে তার সরকারের চিফ জাস্টিস বানাতে চাইলেন; কিন্তু ওই আলেম তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই আলেমে দ্বীন হচ্ছেন ইমাম আবু হানিফা রহ:। আর তাকে কারাগারে পাঠানো শাসকের নাম আল-মানসুর, যিনি আব্বাসী যুগের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা রহ: শাসকের দরবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছিলেন। আল-মানসুর যখন তাকে চিফ জাস্টিসের পদ প্রস্তাব করলেন, তখন আবু হানিফা রহ: বললেন, নিজেকে এ পদের যোগ্য মনে করি না।

এ কথা শুনে খলিফা রেগে যান। কারণ ওই সময় চিফ জাস্টিসের পদমর্যাদা ছিল খলিফার নায়েব পর্যায়ের। খলিফা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ। এটা শুনে ইমাম আবু হানিফা রহ: খলিফাকে বললেন, যদি মিথ্যাবাদী হই, তাহলে তো বাস্তবিকই আমি এ পদের যোগ্য নই। এরপর ইমাম আবু হানিফা রহ:কে কারাগারে পাঠানো হয় এবং তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ রহ:কে চিফ জাস্টিস বানানো হয়। কারাগারে ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর ওপর নির্যাতন করা হতো, যাতে তিনি খলিফার নির্দেশ মেনে নেন; কিন্তু তিনি তৎকালীন শাসকের ইচ্ছার সামনে মাথানত করতে অস্বীকার করেন। একদিন কারাগার থেকেই তার লাশ বের হয়। বাগদাদে তার নামাজে জানাজায় বহুসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। আল-মানসুর ইমাম জাফর সাদেক রহ:কেও জোরজবরদস্তিমূলক তার আনুগত্য করতে বাধ্য করেছিলেন। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। কিছু বর্ণনা মোতাবেক, আল-মানসুরের নির্দেশক্রমে ইমাম জাফর সাদেক রহ:কে বিষ দেয়া হয়েছিল। ওই যুগে আরো একজন আলেমে দ্বীন ইমাম মালেক বিন আনাস রহ: ও আল-মানসুরের বাধ্যকরণকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। মদিনার গভর্নর যখন নির্দেশ দিলেন, খলিফার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা সবার ওপর ওয়াজিব, তখন ইমাম মালেক রহ: ফতওয়া দিলেন, খলিফার আনুগত্যে জোরপূর্বক বাধ্য করা জায়েজ নয়। এ ফতওয়া ইমাম মালেক রহ:-এর ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হলো। সুতরাং ঁতাকে গ্রেফতার করে মদিনায় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হয়।

যে যুগে ইমাম আবু হানিফা রহ:, ইমাম জাফর সাদেক রহ: ও ইমাম মালেক রহ: অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলেছেন, ওই সময়ই এমন কিছু আলেমও ছিলেন, যারা তোষামোদের কারণে খলিফার পছন্দের ব্যক্তি হয়ে যান। সমকালীন শাসকের তোষামোদকারী দরবারি আলেমদের আজ কেউ চেনে না। যদি কারো নাম অমর হয়ে থাকে, তাহলে অত্যাচারী শাসকের সামনে তার কথা অমান্য করার কারণে কারাবন্দী ও বেত্রাঘাত খাওয়া আলেমদের নাম অমর হয়ে আছে। ওই উলামায়ে হকের ধারাকে যারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:ও শামিল ছিলেন। তিনি আব্বাসী খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে কিছু দরবারি আলেমের উপস্থাপিত দর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে একটি দর্শন এটাও ছিল যে, কুরআন পরবর্তীকালে সৃষ্ট হওয়া বস্তুগুলোর অন্তর্ভুক্ত। কিছু আলেম নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য দাবি করেছিলেন, আল্লাহর জ্ঞান মাখলুক বা সৃষ্ট, যা পরবর্তীতে জন্ম লাভ করেছে। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর অভিমত ছিল, কুরআন আল্লাহর জ্ঞান। আর যে মনে করবে যে, এটা পরবর্তীতে জন্ম লাভ করেছে, সে কুফরি করবে।

আল-মামুন এ দর্শনকে অস্বীকার করাকে তার অবমাননা ভাবলেন এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:কে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। কিছু দিন পর আল-মামুন আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:কে আবার দরবারে তলব করেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: ও তার সঙ্গী মুহাম্মদ বিন নুহ রহ:কে যখন বেড়ি পরিয়ে খলিফার কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন খলিফার এক কর্মচারী কান্নারত অবস্থায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:কে বললেন, আজ যদি আপনি কুরআন সৃষ্ট দর্শনকে মেনে না নেন, তাহলে খলিফা নিজ হাতে আপনাদের দু’জনের গর্দান উড়িয়ে দেবেন। এ কথা শুনে আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: দোয়া করলেন, ওগো মোর পরওয়ারদেগার, যদি তোমার কুরআন অমাখলুক ও অনাদি কালাম হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দু’জনকে মামুনের সাথে একত্র হওয়া থেকে রক্ষা করো।

আমরাও যেন তাকে না দেখি, তিনিও যেন আমাদের দু’জনকে না দেখেন। ওই রাতেই আল-মামুনের মৃত্যু হয়। এরপর তার ভাই মুতাসিম বিল্লাহ খলিফা হন। তার শাসনামলে মুহাম্মদ বিন নুহ রহ: ইন্তেকাল করলেন। মুতাসিম ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:কে তার দরবারে তলব করে দরবারি আলেমদের সাথে তার বাহাস করালেন। এ দরবারি আলেমরা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ:-এর যুক্তি ও দলিলের সামনে কুপোকাত হয়ে গেলে তারা খলিফাকে বললেন, এ বেয়াদব শুধু আমাদের নয়, আপনাকেও কাফের সাব্যস্ত করছে। খলিফা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর কাপড় খুলে ফেলার নির্দেশ দেন এবং তার সামনে তাকে বেত্রাঘাত করা হলো। উপর্যুপরি বেত্রাঘাতে ইবনে হাম্বল রহ:-এর দৃঢ়তা ও স্থিরতা মুতাসিম বিল্লাহকে অস্থির করে দিয়েছিল। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: লাগাতার বেত্রাঘাতে একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান। আশঙ্কা ছিল, তার জীবন চলে যায় কি না। এ জন্য তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হলো। ঘটনাটি ছিল রমজান মাসের। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: রোজা ছিলেন। তাকে অর্ধমৃত অবস্থায় ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের ঘরে নেয়া হয়। জ্ঞান ফিরে আসার পর তাকে বলা হলো, আপনার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। রোজা ভেঙে ফেলুন। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: জোহরের নামাজ আদায় করলেন এবং বললেন, হজরত উমর ফারুক রা:ও আহত অবস্থায় নামাজ আদায় করেছেন। আহমদ ইবনে হাম্বল রহ: সন্ধ্যায় ইফতার করলেন। অতঃপর ওই জল্লøাদদের ক্ষমা করে দিলেন, যারা বেত্রাঘাত করেছিল। তবে ওই সব পথহারা আলেমকে ক্ষমা করলেন না, যারা ইসলামের নামে বিভ্রান্তি ছড়ায়। তার নামাজে জানাজায় কয়েক লাখ মানুষ শরিক হন এবং তার জানাজা দেখে কয়েক হাজার খ্রিষ্টান মুসলমান হয়ে যায়। এ জানাজা হয়েছিল ১২ রবিউল আওয়াল।

ইমাম শাফেয়ি রহ: থেকে ইমাম মুসা কাজেম রহ: এবং আবদুর রহিম মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ: ও মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ:সহ বহু আলেমে হক ও মুজতাহিদ নিজ নিজ সময়ের শাসকদের অন্যায়কে প্রত্যাখ্যান এবং কষ্ট ভোগ করেছেন। এ কারণেই আমরা হজরত আলী হাজভেরি ওরফে দাতা গঞ্জে বাখশ রহ:-এর ‘কাশফুল মাহজুব’ গ্রন্থে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর নামের উল্লেখ পাই; কিন্তু তার বিরুদ্ধে ফতওয়া দেয়া দরবারি আলেমদের নাম কোথাও দেখতে পাই না। একবার খলিফা হারুনুর রশীদ ইমাম মালেক রহ:-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য বার্তা পাঠিয়ে বললেন, আপনি যে গ্রন্থ লিখেছেন, তা আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। ইমাম মালেক রহ: জবাব পাঠালেন, ‘জ্ঞানার্জনের জন্য নিজেকেই যেতে হয়, জ্ঞান কারো কাছে যায় না।’ শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ: তার ‘আনফাসুল আরেফিন’ গ্রন্থে লিখেছেন, মোগল বাদশাহ আলমগীর আবদুর রহিম মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ:-এর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি বাদশাহকে পত্র লিখে জানালেন, ‘আল্লাহওয়ালারা এ কথার ওপর একমত যে, ওই ফকির সর্বোত্তম, যে কোনো আমির-ধনীর ডেরায় গমন করে না।’ ইতিহাস বলে যে, ওই সব আলেমই অনুসরণযোগ্য, যারা আমির, ক্ষমতাধর ও ধনীদের দরবারে গমন করেন না, বরং আমির-ক্ষমতাধর ও ধনী ব্যক্তিরা নিজেরাই তাদের কাছে যান।


দৈনিক জং ২৭ এপ্রিল
২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

* লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us