আরো ভয়াবহ শঙ্কা নিয়ে আসছে করোনা
-
মোহম্মদ শরিফ সালাম। নিবাস টরন্টো শহরের পূর্বপ্রান্তের বাংলাদেশী হলেও সব প্রবাসী বাঙালিরই খুব কাছের মানুষ। আদ্যন্ত মুক্তমনা মানুষটি পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ছিলেন লিখতে হলো কারণ, সম্প্রতি তাকে আমরা হারিয়েছি করোনার গ্রাসে। মনে পড়ে, মাসখানেক আগেও টেলিফোনে রাজনীতি নিয়ে কত আলোচনা করলেন। এত জনপ্রিয় মানুষটির জানাজাতে বা সমাধিক্ষেত্রে হাতেগোনা ক’জন গেলেন। গোরস্থানে বলবত সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আইন। ভাঙলে ৭৫০ ডলার জরিমানা। অতএব, শোকেও লকডাউন মানা ছাড়া আর উপায় কী!
আমরা যে অন্টারিও প্রদেশের বাসিন্দা, সেটা করোনার নিরিখে কানাডার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সোমবার পর্যন্ত কানাডায় প্রায় ৪৭,০০০ মানুষ সংক্রমিত আর মৃত্যু হয়েছে ২,৫৬০ জনের। শুধু অন্টারিও দেখেছে প্রায় হাজার মৃত্যু। এই অদ্ভুত ভাইরাস যে সত্যিই সাম্যবাদী, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রীর করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। মার্চ মাসে সেজন্য কোয়ারেন্টিনে চলে গেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তবু একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল এই ভাইরাস সম্পর্কে। কারণ, সংক্রমণের উৎস বোঝা যাচ্ছিল।
প্রায় সব ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তির সাম্প্রতিককালে এমন দেশে ভ্রমণের ইতিহাস ছিল, যেখানে করোনা ছড়িয়েছে। যেমন, জানুয়ারির শেষে অন্টারিওতে প্রথম যে লোকটির সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়, সে চীনের উহান থেকে এসেছিল। কিন্তু মার্চ থেকে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কোনওরকম ট্রাভেল হিস্টরি ছাড়া দলে দলে লোক সংক্রমিত হতে শুরু করল। তখনই বোঝা গেল, গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে লংটার্ম কেয়ার অ্যান্ড রিটায়ারমেন্ট হোমগুলোতে মৃত্যুর হার বেশি। প্রবীণদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে হোমের নিয়মকানুন বিষয়ে নতুন করে নজর দিয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তর। সরকারি সূত্র বলছে, অনুমান করা হচ্ছে, মহামারী শেষে ১১,০০০ থেকে ২২,০০০ মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী হতে পারে করোনা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় দফায় ভয়ঙ্কর আঘাত হানবে এই মারণ ভাইরাস।
কানাডা ধনী দেশ। সরকার বিপুল টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে করোনা মোকাবিলায়। সব অধিবাসীকে মহামারী চলাকালীন ২০০০ ডলার করে মাসোহারা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে তো বটেই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বাঁচাতে এবং গরিব মানুষকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করছে না সরকার। শিশু ও বৃদ্ধদের ভাতা বাড়ানো হয়েছে, এমনকী অসুস্থ মানুষকে দেখভাল করতে গিয়ে যাদের রোজগারে টান পড়ছে, তাদের কথাও ভাবছে সরকার। তবু ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থনীতির পতন। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৭ সালের পর এত বেকারত্ব দেখা যায়নি। শুধু মার্চ মাসেই কানাডায় কর্মহীন হয়েছেন ১০ লাখ মানুষ। সেইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, কতদিন চলতে পারে বিপুল জনসংখ্যার জন্য এই সরকারি অনুদান? অর্থনৈতিক মহলের আশঙ্কা, অন্টারিও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৪০ শতাংশ আগস্টের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের বাকি অংশের হালও প্রায় একইরকম। তখন আরো কত লক্ষ কর্মহীন হবে, সহজেই অনুমান করা যায়।
কানাডা আর আমেরিকা সীমান্ত মানুষ এবং পণ্য চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্চ থেকেই সেখানে নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে। আপাতত ঠিক আছে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরকম চলবে। আসলে আমেরিকার করোনার এপিসেন্টার নিউ ইয়র্ক কিন্তু বলতে গেলে টরন্টোর ঘরের কাছে, মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার। আজকের দিনে এই দূরত্বটা যে কিছুই নয়, তা সবাই জানেন। আমেরিকা থেকে যাঁরা নায়াগ্রা ফল্স বেড়াতে আসেন, একটা সেতুর ওপারে দাঁড়িয়ে কানাডা দেখার অভিজ্ঞতা হয় তাঁদের। তাই কানাডা সরকারকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে, যাতে কোনওভাবেই নিউ ইয়র্কের দশা না হয় টরন্টোর। আমেরিকার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হয়েও এখনও পর্যন্ত কানাডা করোনা যুদ্ধে অনেকটাই সফল বলা যায়।
স্কুল–কলেজ–অফিস সব বন্ধ। মানুষ ঘরবন্দি। একাকিত্বের যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে। এভাবে কতদিন, এই প্রশ্ন এখন ফিরছে মুখে মুখে। বোঝাই যাচ্ছে, যত দিন না করোনার টিকা আবিষ্কার হচ্ছে, তত দিন মেনে চলতে হবে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বিধি। আজ থেকে ১ বছর পরও কি সম্ভব হবে আগের মতো অবাধ মেলামেশা?
সূত্র : আজকাল