পুলসিরাত সম্পর্কে রাসূলুলাহ সা: যা বলেছেন
পুলসিরাত সম্পর্কে রাসূলুলাহ সা: যা বলেছেন - প্রতীকী ছবি
পবিত্র রমজান আত্মশুদ্ধি তথা আত্মগঠন ও আত্ম-সংশোধনের শ্রেষ্ঠ মাস। কারণ রমজানে রোজাদার অনেক বৈধ তৃপ্তি বা হালাল বিষয় ভোগ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে নাফস্ বা নিজের সাথে জিহাদে মশগুল থাকেন। আমাদের অন্তরকে পবিত্র করার জন্য কেবল শরীরকে পবিত্র করাই যথেষ্ট নয়। শরীরকে সুস্থ, সবল ও সুন্দর রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করার যেমন দরকার হয় তেমনি আত্মাকে সুন্দর, সবল ও সুস্থ রাখার জন্যও আত্মার কিছু ব্যায়াম বা অনুশীলন জরুরি। নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি হচ্ছে এমনই কিছু অনুশীলন।
পবিত্র রমজানের ফজিলত তুলে ধরতে গিয়ে মহানবী সা: সাহাবিদের সামনে এক ভাষণে বলেছেন, ‘হে মানুষেরা! এই মাসে সৎ বা সুন্দর আচরণকারীরা কিয়ামতের দিন পুলসিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। আর যারা অসৎ তাদের পাগুলো সেদিন পিছলে যেতে চাইবে। যে কেউ এই মাসে তার অধীনস্থ কর্মীদের কাজের বোঝা কমিয়ে দেবে আল্লাহ পরকালে তার হিসাব-নিকাশ সহজ করবেন এবং যে কেউ এই মাসে অন্যকে বিরক্ত করবে না মহান আলাহ তাকে বিচার-দিবসে নিজের ক্রোধ হতে নিরাপদ রাখবেন। যে কেউ রমজান মাসে কোনো এক ইয়াতিমকে সম্মান করবে ও তার সঙ্গে দয়ার্দ্র আচরণ করবে মহান আল্লাহও বিচার-দিবসে তার প্রতি দয়ার দৃষ্টি দেবেন। যে এই মাসে নিজের আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো আচরণ করবে, মহান আলাহও বিচার-দিবসে তার প্রতি দয়া করবেন, আর যে এই মাসে আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ আচরণ করবে আলাহও তাকে নিজ রহমত থেকে দূরে রাখবেন।’ (আত-তাবারানি, কিতাবুল আওসাত ৪/৪৫) পুলসিরাত শব্দ নিয়ে সরাসরি না বললেও মহান আলাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন : তোমাদের প্রত্যেকেই তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; ওটা তোমার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। (সূরা : মারিয়াম,আয়াত-৭১) আলোচ্য আয়াতে পুলসিরাত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
পুলসিরাত অতিক্রম করা সম্পর্কে রাসূলুলাহ সা: বলেছেন, ‘সেদিন কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ ঘোড়ার গতিতে, কেউ আরোহীর গতিতে, কেউ দৌড়িয়ে, আবার কেউ হাঁটার গতিতে (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে।’ (তিরমিজি, দারেমি) উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুলাহ সা: বলেছেন, ‘জাহান্নামের ওপর একটি পুল আছে, যা চুলের চেয়েও বেশি চিকন আর তরবারির চেয়েও বেশি ধারালো। এর ওপর লোহার শিকল ও কাঁটা থাকবে। মানুষ এর ওপর দিয়েই গমন করবে। কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বায়ুবেগে আর কেউ উত্তম ঘোড়া ও উটের গতিতে পুলসিরাত পার হবে। আর ফেরেশতারা বলতে থাকবে, হে প্রভু! সহিসালামতে অতিক্রম করাও, হে প্রভু! নিরাপদে পার করাও। কেউ নাজাত পাবে, কেউ আহত হবে, কেউ উপুড় হয়ে পড়ে যাবে আর কেউ অধঃমুখী হয়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে।’ (মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২৪৮৪৭)
অপর হাদিসে নাজর ইবনে আনাস মালিকের বাবা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুলাহ সা:কে কেয়ামতের দিন আমার জন্য শাফায়াত করার প্রার্থনা জানিয়েছিলাম। তিনি বললেন, আমি তা করব। আমি বললাম, ইয়া রাসূলালাহ! আমি আপনাকে কোথায় তালাশ করব? তিনি বললেন, তুমি প্রথম তালাশ করবে সিরাতের পাশে। বললাম, যদি সিরাতে আপনার সাক্ষাৎ না পাই? তিনি বললেন, হাউজে কাউসারের পাশে তালাশ করবে। আমি বললাম, যদি সেখানেও না পাই? তিনি বললেন, তাহলে মিজানের পাশে তালাশ করবে। এ তিনটি স্থানে আমি হারাব না।’ (তিরমিজি )
এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা: থেকে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (সংক্ষিপ্ত রূপ) তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন তারা বলবেÑ হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রভু। তখন তারা আলাহ তায়ালার অনুসরণ করবে। এরপর জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। রাসূলুলাহ সা: বলেন, সর্বপ্রথম আমি সেই পুলসিরাত অতিক্রম করব। আর সেই দিন সব রাসূলের দোয়া হবে ‘আলাহুম্মা সালিম, আলাহুম্মা সালিম’- অর্থাৎ হে আলাহ!
রক্ষা করো, রক্ষা করো। সেই পুলের মাঝে সাদান (এক ধরনের তিক্ত কাঁটাদার গাছ) গাছের কাঁটার মতো কাঁটা থাকবে...। (বুখারি, হাদিস : ৬২০৪।
কিয়ামতের দিন মিজানের পর মানুষের মঞ্জিল হলো পুলসিরাত পার হতে হবে। এটি এমন পুল, যা চুলের চেয়েও অধিক সূক্ষ্ম এবং তলোয়ারের চেয়েও অধিক তীক্ষè। এর ওপর দিয়ে সব মানুষকে অতিক্রম করতে হবে। এটি হবে তিমিরাচ্ছন্ন এক ভয়ানক সেতু, যা অতিক্রমকালে মুমিনদের সম্মুখে ঈমানের আলোকরশ্মি উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। অবিশ্বাসীদের কাছে আলো থাকবে না। ফলে তারা মুমিনদের কাছে আলো প্রার্থনা করবে। কিন্তু তাদের তা দেয়া হবে না। মুমিন ও কাফিরদের মাঝে একটি দেয়াল তোলা হবে। কিয়ামতের দিন পুলসিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনে রমজানে সদাচরণের মাধ্যমে আলাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে । রমজানে এ গুণ অর্জন করে সারা বছর চলার পাথেয় গ্রহণ করতে হবে। তাহলে সহজে পুলসিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারব।
অতএব রোজাদারের উচিত আলাহকে হাজির-নাজির জেনে সব পাপ থেকে দূরে থাকা। মানুষকে ফিরে আসতে হবে প্রকৃত মনুষ্যত্বের দিকে, যে পবিত্র প্রকৃতিগুলো দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেসব পবিত্র স্বভাবগুলোর দিকে। বছরের অন্য মাসগুলো থেকে রমজান মাসে বেপরোয়া ভাব ও আচরণ পরিত্যাগ করা সহজ বিধায় মুমিনদের সুন্দর ও উত্তম আচরণ গ্রহণ করে উন্নত মানুষ হতে হবে। রাসূলের সা: নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করে পুলসিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবÑ এটাই হোক মাহে রমজানের প্রত্যয় ।
প্রকৃত রোজাদার তার পঞ্চইন্দ্রিয় ও প্রবৃত্তিগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যে কোনো ধরনের পাপ এড়াতে তা সদা-সতর্ক থাকে। এভাবে অন্তরকে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও পবিত্র করাই হচ্ছে আসল রোজা। আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের সময় খুবই সীমিত। আজ নয় কাল, এ বছর থাক আগামী বছর, ইবাদত ও সংশোধনের অনেক সময় বাকি আছেÑ এমন ভাবা ঠিক নয়। দশকের পর দশক, যুগের পর যুগ শেষ হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর সময় যখন এসে পড়বে তখন মনে হবে কত দ্রুত শেষ হলো আয়ু! মহান আলাহ আমাদের রক্ষা করুন প্রস্তুতিবিহীন মৃত্যু এবং জীবনের দিনগুলোর অপচয় হতে।
লেখক : লেখক ও গবেষক