হাফতাবের নিজেকে শাসক ঘোষণার অন্তরালের খেলা

মাসুম খলিলী | May 01, 2020 09:54 am
গাদ্দাফি ও হাফতার

গাদ্দাফি ও হাফতার - সংগৃহীত

 

করোনা-উত্তর বিশ্বে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটনার জল্পনার মধ্যে একের পর এক তাৎপর্যপূর্ণ সব ঘটনা ঘটছে। এই কলাম লেখার সময় ইউরোপ- আমেরিকার শীর্ষ দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আর এই সময়ে জাতিসঙ্ঘের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার নিজেকে দেশটির একক শাসক ঘোষণা করেছেন। অন্য দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের দক্ষিণাংশকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার আয়োজন চলছে। আর এর মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রধান শত্রু হিসেবে চীনকে চিহ্নিত করার একটি আয়োজনের কথা জানা যাচ্ছে হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্বের নতুন ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে।

হাফতারের শাসক ঘোষণা
জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সমাধান প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার নিজেকে লিবিয়ার শাসক ঘোষণা করেছেন। এক টিভি বক্তব্যের মাধ্যমে খলিফা হাফতার ২০১৫ সালে মরক্কোর স্কিরাটে স্বাক্ষরিত জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় হওয়া লিবিয়ার রাজনৈতিক চুক্তিটিকে অবৈধ ঘোষণা করে নিজেকে শাসক ঘোষণা করেছেন।
হাফতারের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে লিবিয়ার পরিস্থিতি নতুন এক সঙ্কট পর্বে প্রবেশ করল। তার এই ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি রাশিয়া ফ্রান্স অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই সমর্থন করেনি। তবে দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায় মাত্রাগত বেশ পার্থক্য রয়েছে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে একতরফাভাবে নিজেকে লিবিয়ার শাসক হিসেবে ঘোষণায় খলিফা হাফতারের পদক্ষেপে আবারো প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি দেশটিতে সামরিক একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি করার লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছিলেন। তিনি চান না, লিবিয়ার সঙ্কটের সমাধান রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে হোক। লিবিয়ায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালিয়ে হাফতার মানবিক পরিস্থিতি আরো গভীর করেছিলেন। তিনি কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে তেল উৎপাদন, পানি সরবরাহ এমনকি লিবিয়ার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহে বাধা দিয়েছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে, তুরস্ক লিবিয়ার জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত জাতীয় চুক্তির সরকার (জিএনএ) এবং অন্য সব বৈধ লিবীয় প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল-সররাজ বলেন, হাফতারের একতরফাভাবে নিজেকে লিবিয়ার শাসক ঘোষণায় আবারো প্রকাশ পেয়েছে যে, যুদ্ধবাজের অভ্যুত্থান প্রকল্প অবশ্যই শেষ করতে হবে। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস স্পিকার হামাউদা সাইয়ালার অধীনে সংসদ অধিবেশনে বলা হয়, ‘আমরা আমাদের সব নাগরিককে আমাদের দেশকে আরো একবার স্বৈরশাসকের হাতে পড়া রোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং আমাদের ঐক্য রক্ষার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ সভার পর একটি লিখিত বিবৃতিতে জোর দেয়া হয়েছে যে, সংসদ দেশের ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যে সব শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগে সমর্থন দেবে।

এ মাসের গোড়ার দিকে জেএনএ বাহিনী ত্রিপোলির পশ্চিমে কৌশলগত শহরগুলো দখল করার পরেই মূলত হাফতারের এই ঘোষণা আসে। হাফতারের ঘোষণায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সমালোচনা আসে। হাফতারের একতরফা ঘোষণা অগ্রহণযোগ্য এবং এটি কখনোই দেশের পক্ষে টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা করবে না বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতির একজন মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন। লিবিয়ায় মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে যে, দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করার জন্য হাফতারের একতরফা প্রস্তাব ‘হতাশাজনক’ এবং দেশটির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ‘গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে’ বসতে হবে সবাইকে। মস্কো মঙ্গলবার ঘোষণা করেছে যে, ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের এলএনএ’র সাথে আর আলোচনায় না বসা এবং খলিফা হাফতারের নিজেকে একতরফাভাবে শাসক ঘোষণা- দুটোরই বিরোধিতা করে রাশিয়া। ফ্রান্স, হাফতারের নাম না নিয়েই বলেছে যে, লিবিয়ার দ্বন্দ্ব একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না কেবল হবে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সংলাপের মাধ্যমে।
লিবিয়ার নতুন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, দেশটির অবস্থাকে নতুন এক সিদ্ধান্তকারী দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাফতারের ত্রিপোলি দখল করে পুরো দেশের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রকল্প সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহকে কার্যত ব্যর্থ করেছে। ফলে হাফতার দেশটিকে বিভক্ত করে পূর্বাঞ্চলের ওপর নিজের শাসন প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বিকল্প বেছে নিচ্ছেন বলে মনে হয়।

অন্য দিকে জিএনএ পাল্টা অভিযানে রমজানের মধ্যেই খলিফা হাফতারের সেনাবাহিনীকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চল থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করতে চায় বলে মনে হচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থিত জেনারেল খলিফা হাফতার সম্প্রতি নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিলেন ত্রিপোলিতে। বরাবরের মতো তিনি আবার নাগরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছিলেন। অথচ তিনি আগে ঘোষণা করেছিলেন, বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি মেনে চলবেন। শেষ পর্যন্ত তার সেই চুক্তি লঙ্ঘনের একমাত্র কারণ হতে পারে, বিশ্ব এবং তুরস্ক বিশেষভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে লিবিয়াকে নিজের হাতে নিতে বাধা দেয়ার মতো আর কেউ সেভাবে থাকবে না।

বাস্তবতা সে রকম হয়নি। জিএনএ বাহিনীর অবিশ্বাস্য প্রতিরোধ ও পাল্টা লড়াইয়ে এ সত্যটি উপলব্ধি করতে বাধ্য হন যে তিনি ভুল হিসাব করেছিলেন। তুরস্ক লিবিয়ার আন্তর্জাতিক-স্বীকৃত সরকারের সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বজায় রেখেছে। লিবিয়ার সরকারি জিএনএ বাহিনী হাফতারের হামলাগুলোকে ব্যর্থ করে পাল্টা আক্রমণে তৎপর হয়ে পশ্চিম ত্রিপোলির সাবরাথা, সুরমান ও আল-আজাইলাত ছাড়াও মোট সাতটি শহর দখল করে নেয় এবং প্রতিবেশী তিউনিসিয়ার সীমান্তগুলোতে আবার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। জিএনএ বাহিনী এখন রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে তারধুনার দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে।

তারধুনা পশ্চিম লিবিয়ার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, যেখান থেকে হাফতার ত্রিপোলি এবং লিবিয়ার অন্যান্য অংশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন। এ ঘাঁটিটি বর্তমানে জিএনএ বাহিনী চার দিকে ঘিরে রেখেছে। তারধুনা ঘাঁটির পতন হলে পশ্চিমে হাফতারের সব সমর্থন কাঠামো ধসে পড়বে। জিএনএ বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, তারধুনা দখল যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। এরপর জিএনএ’র লক্ষ্য হতে পারে- দক্ষিণে আল-জুফরা এবং তারপরে পূর্বের আজদাবিয়ায়, সেখানে রয়েছে হাফতারের আসল নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল।
লিবিয়ার রাজ্য হাই কাউন্সিলের সভাপতি খালেদ আল মিসরি বলেছিলেন যে, জিএনএ রমজানের শেষে হাফতার বাহিনীকে পুরোপুরি নির্মূল করার পরিকল্পনা করছে। এই ক্ষেত্রে, লিবিয়া এখন এমন একটি সময়ে প্রবেশ করেছে যেখানে হাফতারের বিপর্যয় দৃশ্যমান। প্রশ্ন হলো ঠিক এই মুহূর্তে, হাফতার কেন নিজেকে শাসক ঘোষণা করতে গেলেন? তব্রুকের লিবিয়ার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস-এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকারী হাফতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় নিজের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে সমগ্র লিবীয় জাতি তার কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়।

এ পদক্ষেপটি অবাক করার কারণ হলো কেউ যখন স্থিরভাবে এবং সব কিছু হারাতে যাওয়ার পথে ক্রমাগত পরাজয়ের মুখোমুখি হন তখন তার পক্ষে এ ধরনের ঘোষণা দেয়া স্বাভাবিক নয়। এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইউরোপ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি স্পষ্ট করে যে, হাফতার তার পেশিশক্তি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও ফ্রান্সের সহায়তায় এখন অবধি দখল চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তিনি দেশকে বিভক্ত করতে পারলে পূর্ব লিবিয়ায় তার রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগটি ধরে রাখতে সক্ষম হতে পারেন। এখন সেই চেষ্টাই তিনি করছেন। তাকে সমর্থনকারী বাহিনী, মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের শুরু থেকেই এ জাতীয় পরিকল্পনা ছিল।

লিবিয়াকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে সেটি নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তার ওপর। ২০১১ সালে মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে লিবিয়ায় দু’টি শক্তির উদ্ভব ঘটে। মূলত রাশিয়া, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত পূর্ব লিবিয়ার সেনা কমান্ডার হাফতার এবং ত্রিপোলিতে জিএনএ, যা ইউএনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। শোষোক্ত সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক এবং কিছুটা ইতালি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন একসময় হাফতারের প্রতি রয়েছে বলে মনে হলেও এখন আমেরিকা রাজনৈতিক সমঝোতা প্রত্যাশা করে বলে মনে হয়। রাশিয়া ঘোষণা দিয়ে পক্ষ না নিলেও ভাড়াটিয়া বাহিনী দিয়ে এবং পরোক্ষভাবে নানা ধরনের সাহায্য দিয়ে এসেছে হাফতারকে। ফ্রান্সের ভূমিকাও অনেকটা একই রকম।

এ অবস্থায় হাফতারকে লিবিয়ার একটি অংশের শাসক হিসেবে টিকে থাকতে হলে মিসর, আমিরাত বা সৌদি আরবের বাইরে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মতো শক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রয়োজন হবে। রাশিয়া সরাসরি লিবিয়ায় চলে এলে যুক্তরাষ্ট্র আবারো এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি হলে আমিরাত এবং সৌদি আরবের জন্য কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। মিসরের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ইসরাইল জেনারেল হাফতারকে যে সহায়তা দিচ্ছে সেটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

এ অবস্থায় লিবিয়াকে অবিভক্ত রেখে আন্তÍর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি শাসন বজায় রাখার প্রচেষ্টা সামনে আসতে পারে। এ ধরনের একটি প্রক্রিয়ার জন্যও হাফতারের পেশিশক্তির পরাজয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরাজয় আসন্ন বলে মনে হচ্ছে।

অবশ্য করোনা-উত্তর পৃথিবীতে নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের একটি সম্ভাবনাও সামনে চলে এসেছে। লিবিয়াসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর তারও একটি প্রভাব দৃশ্যমান হতে পারে। লিবিয়ার পাশাপাশি আমিরাত ইয়েমেনের দক্ষিণেও একই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ঘটে যাওয়া সব মানবিক সঙ্কটের বিষয় উপেক্ষা করে বিনা পার্লামেন্টে ইয়েমেনকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে চালানো হচ্ছে।

চীন কি পশ্চিমের ঘোষিত প্রধান শত্রু হচ্ছে?
এ দিকে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে এসেছে। সেটি হলো পাশ্চাত্য চীনকে নতুন প্রধান শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। ঠিক ২০ বছর আগে ইসলামকে এ ধরনের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। পাশ্চাত্য মনে করে, তার প্রধান শত্রু প্রয়োজন। এখন সেই শত্রু এবং সর্বশেষ লক্ষ্য চীন হতে চলেছে বলে আভাস দেয়া হচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্লেষক পিটার ওবর্ন এক তাৎপর্যপূর্ণ লেখায় বলেছেন, আমেরিকান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন সভ্যতার সংঘর্ষের বিষয়ে তার বিখ্যাত যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার নতুন এক দিক এখন সামনে চলে আসছে। এটি একাধিক যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়েছিল বলে মনে করা হয়। হান্টিংটন বার্লিনের প্রাচীরের পতন এবং সোভিয়েত রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে স্বায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পরে শান্তির যুগের পরিবর্তে ইসলাম এবং পশ্চিমাদের মধ্যে একটি নতুন লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেন।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশ এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা হান্টিংটনের থিউরিকে বাস্তবে অনুসরণ করেছিলেন। এরপর অনেক মুসলিম দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু হতে দেখা যায়। ইতোমধ্যে মুসলমানরা প্রায়ই পশ্চিমা গণমাধ্যমে আইনহীন, উগ্র আদর্শবাদী এবং বিশ্বের অস্তিত্বের হুমকি হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। এটি ইউরোপে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের সাথে পশ্চিমে ভয়ানক ইসলামফোবিয়ার জন্ম দিয়েছে।

পিটার ওবর্ন লিখেছেন, করোনাভাইরাস ট্র্যাজেডির পরে এ ক্ষতিকারক শত্রুতা শিগগিরই হ্রাস পাবে। এর আংশিক কারণ (বিশেষত ব্রিটেনে) মুসলমানরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা এত সুস্পষ্ট যে, এর ফলে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচ্ছিন্ন পরিবর্তন হতে পারে। প্রাদুর্ভাবের ফলে মারা যাওয়ার প্রথম তিনজন মেডিক্যাল কর্মীর সবাই ছিলেন মুসলমান। তবে এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনীতিকে পুনঃরূপদান করছে। পাশ্চাত্য সব সময় একজন শত্রু পছন্দ করে, সম্ভবত এর সর্বশেষ লক্ষ্য চীন। চীনকে নতুন অস্তিত্বের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, ঠিক যেমন ২০ বছর আগে ইসলামকে করা হয়েছিল। একই সংবাদপত্রের কলামিস্ট, একই থিংক ট্যাংক, একই রাজনৈতিক দল এবং একই গোয়েন্দা সংস্থা এখন যেন সেই কাজ করছে। হান্টিংটনের বিখ্যাত প্রবন্ধের পরে যারা মুসলমানদের প্রায়ই র্যাডিকল ইসলামিস্ট বলে অভিহিত করেছিলÑ এখন তারা পূর্ব-প্রাচ্যের দিকে মনোনিবেশ করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই, এখন চীনকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন, তার রিপাবলিকান পূর্বসূরি বুশ যেমনটি ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ করেছিলেন এবং ২০ বছর আগে ‘অশুভের অক্ষ’ থিওরি দিয়ে কাজ করেছিলেন।

২০১৬ সালে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প চীনকে মার্কিন অর্থনীতিকে ‘ধর্ষণ’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। তবে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই ট্রাম্পের আক্রমণগুলো গতি এবং শৃঙ্খলা অর্জন করেছে। তিনি চীনের বিরুদ্ধে ভাইরাস আড়াল করা এবং মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেছেন।
এই মাসের শুরুতে, তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দেয়া মার্কিন তহবিল বন্ধ করে দেন আর এই সংস্থাকে খুবই ‘চীনকেন্দ্রিক’ বলে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো, যেগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রচারণা চালাত তারাও এখন চীনকে লক্ষ্যবস্তু করছে।

বিবিসির টুডে প্রোগ্রামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমআই-৬-এর প্রাক্তন প্রধান স্যার জন সাওয়ারস ডব্লুএইচও থেকে ট্রাম্পের তহবিল অপসারণের প্রতি সমর্থন জানান। ব্রিটেনে প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানদের বক্তৃতা সর্বদা অফিসের অভ্যন্তরের বর্তমান দৃশ্যের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে দেখা যায়।
এ দিকে ব্রিটেনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ডমিনিক র্যাব বলেন যে, করোনাভাইরাসের পরে ‘সন্দেহ নেই’ চীনের সাথে এটি স্বাভাবিক ব্যবসা হবে না। সংবাদপত্রের একজন সিনিয়র কলামিস্ট ও তথাকথিত উগ্র ইসলামের দীর্ঘকালীন সমালোচক মেলানিয়া ফিলিপস টাইমসে তার লেখা কলামে সম্প্রতি সতর্ক করে দেন যে, পশ্চিম আর চীনের দিকে ‘অন্ধ দৃষ্টি দিয়ে রাখতে পারবে না’।

চীনকে ঘিরে পরিবেশের পরিবর্তনকে এখন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘকাল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা নিও কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংকগুলোও একটি নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি (এইচজেএস) ইসলামকে র্যাডিকল ধর্ম হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করে এমন প্রতিষ্ঠানের একটি। চীনকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে প্রকাশিত এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সার্বিকভাবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের ওপর তাদের আক্রমণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে।
সর্বশেষ এইচজেএস পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্রিটিশ চায় যে, বরিস জনসন চীনের প্রাথমিক করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য চাপ দিক।

এইচজেএসের সহযোগী ডা: জন হেমিংস ট্রাম্পের ডব্লুএইচওর তহবিল প্রত্যাহারের সমর্থনে দ্য টেলিগ্রাফে এক কলাম লিখেছিলেন এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।

কেউ কেউ বলতে পারেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে পশ্চিমে প্রতিস্থাপিত শত্রুর প্রয়োজন ছিল। আমরা এখন দীর্ঘ সময়ের শেষের দিকে পৌঁছে যাবো যখন মূল ‘ফল্টলাইন’ ছিল ইসলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষের বিষয়টি উল্লেখ করার সময় সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ‘সভ্যতার মধ্যে দোষত্রুটি ভবিষ্যতের যুদ্ধের লাইন হবে’। তবে কেবল ইসলামী সভ্যতা উদ্বেগের কারণ নয়। ইসলাম ছাড়া দ্বিতীয় ‘চ্যালেঞ্জার’ সভ্যতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন হান্টিংটন। হান্টিংটনের মতে, চীন হলো পশ্চিমের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

পিটার ওবর্ন মনে করেন, রাতারাতি সবকিছু হয়তো বদলাবে না। তবে এখন দীর্ঘ সময়ের শেষের দিকে পৌঁছে যাবো যখন মূল ‘ফল্টলাইন’ ছিল ইসলাম। এটা ভালো হতে পারে যে, পশ্চিম এখন নিজের নতুন শত্রু আবিষ্কার করেছে। যদি তা হয় তবে মুসলমানরা আরো অবাধে শ্বাস নিতে পারেন।

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us