চীন কি পশ্চিমের ঘোষিত প্রধান শত্রু হচ্ছে?
ট্রাম্প ও শি - সংগৃহীত
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশ এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা হান্টিংটনের থিউরিকে বাস্তবে অনুসরণ করেছিলেন। এরপর অনেক মুসলিম দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু হতে দেখা যায়। ইতোমধ্যে মুসলমানরা প্রায়ই পশ্চিমা গণমাধ্যমে আইনহীন, উগ্র আদর্শবাদী এবং বিশ্বের অস্তিত্বের হুমকি হিসাবে চিত্রিত হয়েছে। এটি ইউরোপে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের সাথে পশ্চিমে ভয়ানক ইসলামফোবিয়ার জন্ম দিয়েছে।
পিটার ওবর্ন লিখেছেন, করোনাভাইরাস ট্র্যাজেডির পরে এ ক্ষতিকারক শত্রুতা শিগগিরই হ্রাস পাবে। এর আংশিক কারণ (বিশেষত ব্রিটেনে) মুসলমানরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা এত সুস্পষ্ট যে, এর ফলে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচ্ছিন্ন পরিবর্তন হতে পারে। প্রাদুর্ভাবের ফলে মারা যাওয়ার প্রথম তিনজন মেডিক্যাল কর্মীর সবাই ছিলেন মুসলমান। তবে এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনীতিকে পুনঃরূপদান করছে। পাশ্চাত্য সব সময় একজন শত্রু পছন্দ করে, সম্ভবত এর সর্বশেষ লক্ষ্য চীন। চীনকে নতুন অস্তিত্বের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, ঠিক যেমন ২০ বছর আগে ইসলামকে করা হয়েছিল। একই সংবাদপত্রের কলামিস্ট, একই থিংক ট্যাংক, একই রাজনৈতিক দল এবং একই গোয়েন্দা সংস্থা এখন যেন সেই কাজ করছে। হান্টিংটনের বিখ্যাত প্রবন্ধের পরে যারা মুসলমানদের প্রায়ই র্যাডিকল ইসলামিস্ট বলে অভিহিত করেছিলÑ এখন তারা পূর্ব-প্রাচ্যের দিকে মনোনিবেশ করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই, এখন চীনকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন, তার রিপাবলিকান পূর্বসূরি বুশ যেমনটি ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ করেছিলেন এবং ২০ বছর আগে ‘অশুভের অক্ষ’ থিওরি দিয়ে কাজ করেছিলেন।
২০১৬ সালে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প চীনকে মার্কিন অর্থনীতিকে ‘ধর্ষণ’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। তবে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই ট্রাম্পের আক্রমণগুলো গতি এবং শৃঙ্খলা অর্জন করেছে। তিনি চীনের বিরুদ্ধে ভাইরাস আড়াল করা এবং মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেছেন। এই মাসের শুরুতে, তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দেয়া মার্কিন তহবিল বন্ধ করে দেন আর এই সংস্থাকে খুবই ‘চীনকেন্দ্রিক’ বলে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো, যেগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে একযোগে প্রচারণা চালাত তারাও এখন চীনকে লক্ষ্যবস্তু করছে।
বিবিসির টুডে প্রোগ্রামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমআই-৬-এর প্রাক্তন প্রধান স্যার জন সাওয়ারস ডব্লুএইচও থেকে ট্রাম্পের তহবিল অপসারণের প্রতি সমর্থন জানান। ব্রিটেনে প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানদের বক্তৃতা সর্বদা অফিসের অভ্যন্তরের বর্তমান দৃশ্যের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে দেখা যায়।
এ দিকে ব্রিটেনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ডমিনিক র্যাব বলেন যে, করোনাভাইরাসের পরে ‘সন্দেহ নেই’ চীনের সাথে এটি স্বাভাবিক ব্যবসা হবে না। সংবাদপত্রের একজন সিনিয়র কলামিস্ট ও তথাকথিত উগ্র ইসলামের দীর্ঘকালীন সমালোচক মেলানিয়া ফিলিপস টাইমসে তার লেখা কলামে সম্প্রতি সতর্ক করে দেন যে, পশ্চিম আর চীনের দিকে ‘অন্ধ দৃষ্টি দিয়ে রাখতে পারবে না’।
চীনকে ঘিরে পরিবেশের পরিবর্তনকে এখন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘকাল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা নিও কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংকগুলোও একটি নতুন প্রতিপক্ষ খুঁজে পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি (এইচজেএস) ইসলামকে র্যাডিকল ধর্ম হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করে এমন প্রতিষ্ঠানের একটি। চীনকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে প্রকাশিত এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। সার্বিকভাবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের ওপর তাদের আক্রমণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে।
সর্বশেষ এইচজেএস পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্রিটিশ চায় যে, বরিস জনসন চীনের প্রাথমিক করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য চাপ দিক।
এইচজেএসের সহযোগী ডা: জন হেমিংস ট্রাম্পের ডব্লুএইচওর তহবিল প্রত্যাহারের সমর্থনে দ্য টেলিগ্রাফে এক কলাম লিখেছিলেন এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।
কেউ কেউ বলতে পারেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে পশ্চিমে প্রতিস্থাপিত শত্রুর প্রয়োজন ছিল। আমরা এখন দীর্ঘ সময়ের শেষের দিকে পৌঁছে যাবো যখন মূল ‘ফল্টলাইন’ ছিল ইসলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষের বিষয়টি উল্লেখ করার সময় সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ‘সভ্যতার মধ্যে দোষত্রুটি ভবিষ্যতের যুদ্ধের লাইন হবে’। তবে কেবল ইসলামী সভ্যতা উদ্বেগের কারণ নয়। ইসলাম ছাড়া দ্বিতীয় ‘চ্যালেঞ্জার’ সভ্যতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন হান্টিংটন। হান্টিংটনের মতে, চীন হলো পশ্চিমের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
পিটার ওবর্ন মনে করেন, রাতারাতি সবকিছু হয়তো বদলাবে না। তবে এখন দীর্ঘ সময়ের শেষের দিকে পৌঁছে যাবো যখন মূল ‘ফল্টলাইন’ ছিল ইসলাম। এটা ভালো হতে পারে যে, পশ্চিম এখন নিজের নতুন শত্রু আবিষ্কার করেছে। যদি তা হয় তবে মুসলমানরা আরো অবাধে শ্বাস নিতে পারেন।
mrkmmb@gmail.com