আফগানিস্তান : যুক্তরাষ্ট্র আউট, চীন ইন

ট্রাম্প ও শি - সংগৃহীত
আফগানিস্তানে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতির টালমাটালপূর্ণ দুই যুগের সময়কালে চীন সেখানে নীরবে তার প্রভাব বাড়িয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন করোনাভাইরাস ও এর অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার দিকে নজর দেয়ার ফাঁকে চীন নতুন পরাশক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো অবস্থান সৃষ্টি করেছে, যা একসময় ব্রিটেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ধারণ করত।
তালেবান ১৯৯৬ সালে কাবুলের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই ইসলামি আন্দোলনটির সাথে বেইজিং দক্ষতার সাথে স্বল্প মাত্রার, তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করেছিল। ২০০১ সালের গ্রীস্মে গ্রুপটিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকান ও নর্দান্য অ্যালায়েন্স বাহিনী অভিযান শুরু করলে কেবল চীন ও পাকিস্তানই তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছিল।
আফগানিস্তানে বিদেশী বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,আফগানিস্তানের সরি-ই-পুল ও ফারিয়াব প্রদেশের তিনটি তেলক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে চীন। এছাড়া আফগানিস্তানের তামা ও লোহার খনিতেও বিপুল বিনিয়োগ করেছে চীন।
অবশ্য, মনে হচ্ছে চীন তার বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তার অবস্থান বহুমুখী করছে। ইরানের থার্ড পার্টি সার্ভিসেসের মাধ্যমে তালেবানের অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে বহাল রয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়েই ইরানে চীনা অস্ত্রের অবাধ প্রবাহ নিয়ে অভিযোগ করেছে। তাদের বক্তব্য হলো, এসব অস্ত্র পরে তালেবানের হাতে যায়। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট-চালিত গ্রেনেড, আর্টিলারি শেল ও স্থল মাইন। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল মেরিন ইরান সীমান্তের কাছে আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে তালেবানের জন্য যাওয়া ১০ টন অস্ত্রের চালান আটক করেছিল।
আফগানিস্তান যাতে আন্তর্জাতিক ইসলামি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত না হয়, এ ব্যাপারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই স্বার্থ রয়েছে। তা সত্ত্বেও বেইজিং ও ওয়াশিংটন তালেবানের সাথে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে দরকষাকষি করছে। পাকিস্তানে তালেবানপন্থী গ্রুপকে সমর্থনকারী চীন দৃশ্যত আশা করছে যে চীনা প্রদেশ জিনজিয়াঙে হামলা চালানোর জন্য আফগানিস্তানের মাটি যাতে ইস্টার্ন তুর্কেস্তান ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্ট ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে তালেবান। অন্যদিকে তালেবানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র এই আশ্বাস চায় যে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর দেশটির মাটি যাতে আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট ব্যবহার করতে না পারে। এখন প্রশ্ন হলো, এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আফগান জিহাদিদের অস্ত্র দিয়েছে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়েছিল চীন। ২০০০ সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত তালেবানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কান্দাহারে এক সভায় গ্রুপটির নেতা মোল্লা ওমরও উপস্থিত ছিলেন। তালেবান এর জবাবে আফগানিস্তানে চীনা বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আফগানিস্তানের লগার প্রদেশে তিন বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগের মেস আইনাক তামা খনি তালেবান সুরক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া জিনজিন মাইনিং কোম্পানি, জিয়ানজি কপার করপোরেশন, চীনা ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেছে। আফগানিস্তানে সেরিয়াম, লিথিয়াম, নিওডিমিয়াম ও ল্যানথানামের এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ এখনো তোলা বাকি আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীন বর্তমানে আঞ্চলিক শান্তিপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য দেশটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। এক্ষেত্রে ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড উদ্যোগ সামনে এনেছে চীন। এই বাণিজ্য করিডোরটির মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া হয়ে ইউরোপ যেতে পারবে চীন। এছাড়া আরো অবকাঠামো প্রকল্পে আফগানিস্তানকে প্রলুব্ধ করছে চীন।
ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে তার বাহিনী প্রত্যহার করতে চান বলে জানিয়ে দিয়েছে। তালেবানও একে স্বাগত জানিয়েছে। এর ফলে তালেবানের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করে লাভবান হবে চীন। চীন ইতোমধ্যে। আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে ওয়াখান করিডোরে তাজিকিস্তানে একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসলিম উইঘুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান পার্বত্য বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনাও করছে চীন।
আফগানিস্তানে বিনিয়োগ থেকেও চীন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আর তালেবানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে তো লাভবান হচ্ছেই। এখন পর্যন্ত চীন অবাধে চলছে, এবং আশা করছে, আরো বেশি সুযোগ পাবে।
গ্যাটেস্টোন ইনস্টিটিউট