হজরত ইবরাহিম আ:-এর যেসব দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন
কাবা ঘর - সংগৃহীত
সূরা আল-বাকারার (২৬-২৯) আয়াতসমূহে হজরত ইবরাহিম আ: কিভাবে নত-অন্তরে আল্লাহর নিকট চাইতে হয় আমাদের অতি উত্তম উপায়ে তার পথ-প্রদর্শন করে গেছেন।
‘আর স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম বলল, ‘হে আমার রব, আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান এবং এর অধিবাসীদের ফলমূলের রিজিক দিন যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছে’। তিনি বললেন, ‘যে কুফরি করবে, তাকে আমি স্বল্প ভোগোপকরণ দেবো। অতঃপর তাকে আগুনের আজাবে প্রবেশ করতে বাধ্য করব। আর তা কত মন্দ পরিণতি’।
আর স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং বলছিল,) ‘হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী’।
‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত জাতি বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের বিধিবিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।
‘হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।
ইবরাহিম আ: অনেকগুলো দোয়া করেছিলেন-
প্রথমত. আপনার নির্দেশে আমি এই জনমানবহীন প্রান্তরে নিজ পরিবার-পরিজনকে রেখে যাচ্ছি। আপনি একে একটি শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়ে দিনÑ যাতে এখানে বসবাস করা আতঙ্কজনক না হয় এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহজলভ্য হয়। ‘আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করেছেন এবং সে ঊষর মরুপ্রান্তর মক্কা নগরীতে পরিণত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত. ‘হে রব! শহরটিকে শান্তির ভূমি করে দিন’। অর্থাৎÑ হত্যা, লুণ্ঠন, কাফেরদের অধিকার স্থাপন, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখুন। ইবরাহিম আ:-এর এই দোয়াও কবুল হয়েছে। মক্কা মুকাররামার শুধু একটি জনবহুল নগরীই নয়, সারা বিশ্বের প্রত্যাবর্তনস্থলও বটে। বিশ্বের চারদিক থেকে মুসলিমরা এ নগরীতে পৌঁছাকে সর্ববৃহৎ সৌভাগ্য মনে করে। নিরাপদ ও সুরক্ষিত ও এতটুকু হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত কোনো শত্রুজাতি অথবা শত্রুসম্রাটের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আল্লাহ হারাম শরিফের চতুর্সীমানায় জীবজন্তুকেও নিরাপত্তা দান করেছেন। এই এলাকায় শিকার করা জায়েজ নয়।
তৃতীয়ত. ইবরাহিম আ:-এর তৃতীয় দোয়া এই যে, এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসেবে যেন ফলমূল দান করা হয়। মক্কা মুকাররামা ও পার্শ্ববর্তী ভূমি কোনোরকম বাগ-বাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল না পানির নাম-নিশানা। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিমের দোয়া কবুল করেন। মক্কার কাছেই তায়েফে যাবতীয় ফলমূল প্রচুর উৎপন্ন হয় যা মক্কার বাজারেই বেচাকেনা হয়। এখনো সারা বিশ্ব থেকে ফলমূল মক্কায় নিয়ে আসা হয়।
চতুর্থত. ইবরাহিম আ:-এর চতুর্থ দোয়া হচ্ছে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি শিখিয়ে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন। আপনি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু’।
এ দোয়াটিও ইবরাহিম আ:-এর আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান ও আল্লাহভীতিরই ফল, আনুগত্যের অদ্বিতীয় কীর্তি স্থাপন করার পরও তিনি এরূপ দোয়া করেন যে, আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন। কারণ, আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান যার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে সে তত বেশি অনুভব করতে থাকে যে, যথার্থ আনুগত্য তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। এ দোয়াতে স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, যিনি আল্লাহর পথে নিজের সন্তান-সন্ততিকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুণ্ঠিত নন, তিনিও সন্তানদের প্রতি কতটুকু আন্তরিকতা ও ভালোবাসা রাখেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শারীরিকের চেয়ে আত্মিক আর জাগতিকের চেয়ে পারলৌকিক আরামের জন্য চিন্তা করেন বেশি। এ কারণেই ইবরাহিম আ: দোয়া করলেনÑ ‘আমার সন্তানদের মধ্যে থেকে একটি দলকে পূর্ণ আনুগত্যশীল করো’।
পঞ্চমত. তিনি দোয়া করেছেন যে, আমার বংশধরের মধ্যে একজন নবী প্রেরণ করুন। যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের তিলাওয়াত করে শোনাবেন, কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। দোয়ায় নিজের বংশধরের মধ্য থেকেই নবী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর কারণ এই যে, এটা তাঁর সন্তানদের জন্য গৌরবের বিষয়। এতে তাদের কল্যাণও নিহিত রয়েছে।
ইবরাহিম আ:-এর দোয়ার মাধ্যমে আমরা শিখতে পারলামÑ আমরা শুধু আমাদের নিজেদের জন্যই আল্লাহর কাছে দোয়া করব না, বরং আমাদের পুরো মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করব। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দোয়া করব। আমরা শুধু আমাদের সন্তানদের জন্য জাগতিক কল্যাণ কামনা করব না, বরং পরকালীন মুক্তির পথ-প্রদর্শনের জন্য চাইব। সন্তানদের প্রতি যদি প্রকৃত ভালোবাসা থাকে, তবে কখনোই তাদের পরকাল নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।
আমাদের এই সঙ্কট মুহূর্তে পুরো বিশ্ব যখন এক স্রষ্টার কাছে ধরনা দিতে প্রস্তুত তখন যদি নত-অন্তরে আমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের অপরাধ শিকার করে সঙ্কট নিরসনের জন্য দোয়া করতে থাকি, মহা-মহিমান্বিত স্রষ্টার আরশে-আজিম আমাদের দোয়া কবুল করবেন।