পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ষড়যন্ত্র!
আইয়ুব খান - সংগৃহীত
১. পাকিস্তানের শুরুটা মোটেও স্বস্তিপূর্ণ বা তৃপ্তিদায়ক ছিল না। একে তো ব্রিটিশ ও কট্টরপন্থী হিন্দু নেতাদের কারসাজিতে কাশ্মির, আসাম, হায়দরাবাদসহ বড় বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ব্যতিরেকেই দুই প্রান্তে দুই বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্য দিকে, ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর স্বাধীনতার মাত্র দুই মাসের মাথায় কাশ্মির নিয়ে ভারতের সাথে রক্তক্ষয়ী অসম্পূর্ণ যুদ্ধ বেধে যায়। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে অর্থাৎ মাত্র এক বছরের মাথায় পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান নেতা ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। সুতরাং একটি দুর্বল নবজাত রাষ্ট্র সঠিক পরিচর্যার অভাবে নানা জটিলতা ও কুটিলতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ-ভারতের সামরিক-বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল পাকিস্তান। কেননা, ব্রিটিশদের ‘একচোখা’ নীতিতে ভারতের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল।
২. ব্রিটিশ-ভারতের চার লাখ সামরিক সদস্য ও সম্পদ ভাগাভাগির কমিটির চেয়ারম্যান (The Armed Forces Reconstitution Committee) ছিলেন ফিল্ড মার্শাল ক্লড অচিনেলেক। কিন্তু এর মূল দায়িত্ব পালন করেন ব্রিটিশ-ভারতের অত্যন্ত সুচতুর আমলা স্যার চান্দুলাল মাধবলাল ত্রিবেদী, তিনি মুসলমানদের অজ্ঞতা ও নিজের চাতুর্যতাকে কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ সুবিধা ভারতের পক্ষে নিয়ে যান।
৩. শুরুতেই আরেকটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক অনিয়মের প্রচলন শুরু হয়। তা হলো, সেনাবাহিনীতে স্বজাতীয় প্রথম ‘কমান্ডার ইন চিফ’ পদে জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার মাপকাঠিকে অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেয়া। তা সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতাকে খর্ব ও ম্লান করে দেয়।
৪. ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি ‘The Commander-in-Chief of the Pakistan Army (C-in-C) অর্থাৎ ‘সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে প্রচলিত ছিল। এরপর ১৯৭২ সালে এ পদের নামকরণ করা হয় ‘Chief of Army Staff (COAS)। ১৯৫১ সালের শুরুতেই পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ (সিইনসি) পদের জন্য স্বদেশী অফিসার নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নবীন সেনাবাহিনীতে প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জেনারেল ফ্রাঙ্ক মেসারভি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৪৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর জেনারেল ডগলাস গ্রেসি দ্বিতীয় সেনাপ্রধান হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫১ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তার মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয় স্বদেশী সিইনসি নিয়োগ দেয়ার জন্য। সামরিক প্রথানুযায়ী এ জন্য সেনা সদর থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চারজন মেজর জেনারেলের নাম পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সচিবালয়ে। তারা হলেনÑ মেজর জেনারেল আকবর খান, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ (সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি মুসলমান জেনারেল), মেজর জেনারেল ইফতেখার খান ও মেজর জেনারেল এন এ এম রাজা। এর মধ্যে মেজর জেনারেল ইফতেখার খান বিমান দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন। অতএব, বাকি তিনজনের মধ্যে যোগ্যতার মাপকাঠিতে যেকোনো একজন সিইনসি হওয়াই নিয়ম। সর্বজ্যেষ্ঠ জেনারেল আকবর খান, কাশ্মির যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনিই পদটি পাওয়ার কথা। অথবা, জ্যেষ্ঠ বাঙালি জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও অন্য সব বিবেচনায় ছিলেন সিইনসি পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি।
৫. কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এ পদটি নিয়ে সূচনালগ্নেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়। এ সময়ে ইসকান্দার মির্জা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রতিরক্ষা সচিব। প্রধানমন্ত্রীসহ সমগ্র প্রশাসনে তার ছিল ব্যাপক প্রভাব। কেননা, তিনি এক দিকে যেমন ছিলেন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, অন্য দিকে ব্রিটিশ-ভারতের সিভিল সার্ভিসে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, চৌকস ও প্রভাবশালী আমলা। তার দক্ষতা ও পারদর্শিতার জন্য সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা তাকে সমীহ করতেন। তার সাথে প্রথম থেকেই বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আইয়ুব খানের, যিনি জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে তখনো অনেক পেছনের সারিতে। তিনি জেনারেল মুহাম্মদ ইশফাকুল মজিদের চেয়েও চার বছরের কনিষ্ঠ। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জা গোপনে জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য জেনারেলদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে সক্ষম হলেন, মেজর জেনারেল আইয়ুব খানই হলেন ‘সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য, যোগ্য ও নিরাপদ’ ব্যক্তি সিইনসি পদের জন্য। পরিশেষে এ ষড়যন্ত্রই বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
৬. ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আইয়ুব খানকে চার তারকা জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম স্বদেশী সিইনসি পদে নিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে শুরুতেই ইস্কান্দার মির্জার অনৈতিকতার কাছে পরাজয় হলো প্রথাগত সামরিক নীতি ও আদর্শ এবং অদ্যাবধি এ নীতিহীনতার ভারে মুহ্যমান তারা। পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অবৈধ ভূমিকার কুশীলব হিসেবে গণ্য করা হয় ইস্কান্দার মির্জাকে।
৭. উল্লেখ্য, মির্জা ছিলেন মীরজাফরের চতুর্থ অধস্তন বংশধর। মীরজাফর ছিলেন ইস্কান্দার মির্জার দাদার বাবা। উর্দুভাষী বাঙালি আমলা ও রাজনীতিবিদ সাহেবজাদা ইস্কান্দার আলী মির্জা ও আইয়ুব খানের মধ্যে ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এদের সাথে আবার আমেরিকারও ছিল দহরম মহরম। আইয়ুব খান সিইনসি হওয়ার পর ‘কৃতজ্ঞতাস্বরূপ’ তার প্রভাব খাটিয়ে ইস্কান্দার মির্জাকে ১৯৫৪ সালে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট পদে আসীন করাতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর নিজের নিয়োগকৃত সিইনসি জেনারেল আইয়ুব খানই ইস্কান্দার মির্জাকে পদচ্যুত ও লন্ডনে নির্বাসিত করে নিজেই প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেন। এভাবেই ষড়যন্ত্রের ফসল ষড়যন্ত্র দিয়েই ধ্বংস হয়। কিন্তু, খুব কম নেতাই এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন!
লেখক : সামরিক গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.cog