রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাড়ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর

ড. মনিস আহমার | Apr 28, 2020 08:42 am
জেনারেল বিপিন রাওয়াত

জেনারেল বিপিন রাওয়াত - সংগৃহীত

 

নয়া দিল্লিতে ২৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যপরিচর্যা নেতৃত্ব নিয়ে বক্তৃতকালে সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত একটি রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন এই বলে যে : যারা বিভ্রান্তপথে জনগণকে চালিত করে তারা নেতা নয়, যেমনটি আমরা বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রের মধ্যে দেখি। এটা নেতৃত্ব নয়। নেতা তোমাকে ঠিক পথে চালিত করবেন, তোমাকে ঠিক পরামর্শ দেবেন, তারপর তিনি যে জনগণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের পরিচর্যা করবেন। অর্থাৎ নেতৃত্ব হলো ব্যক্তিগত পরীক্ষা এবং আমরা এজন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে গর্বিত।‘ জেনারেল রাওয়াত গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তাকে ভারতের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) করা হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি শাসক পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত।

ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে বিভিন্ন নগরীতে হওয়া বিক্ষোভের ব্যাপারে তার সমালোচনার কারণে বিজেপি সরকার তাকে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদে বহাল রাখতে চায়। সিএএকে রাজনীতিকরণ করার জন্য ভারতে জেনারেল রাওয়াতের সমালোচনা করা হয়। সাবেক নৌবাহিনী প্রধান অব. অ্যাডমিরাল এল রামদাস বলেন যে তার মন্তব্য ছিল পরিষ্কারভাবে ভুল এবং কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয় বরং দেশের সেবা করার সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক দশকের নীতিই অনুসরণ করা উচিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের।

হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে আপস করার জন্য বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন। পুলওয়ামা হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবচেয়ে সুরক্ষিত মহাসড়কে পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলায় আমাদের সাহসী সিআরপিএফের ৪০ সদস্য শহিদ হয়েছে। এটি ভয়াবহ মাত্রায় গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যর্থতা। এরপর থেকে সিআরপিএফ ও বিএসএফ বিমান পরিবহনব্যবস্থা চাইছে, কিন্তু মোদি সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তিনি নির্লজ্জভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করার জন্য মোদি সরকারকে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক খাত, চাকরি খাত ও গ্রামীণ বিপর্যয়ে মোদি সরকারের ক্ষমাহীন ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি আড়াল করতেই এত কিছু করা হয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও এর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস নিয়ে ইন্ডিয়া টুডেতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মুসলিম প্রধান্যবিশিষ্ট ভারতীয় কাশ্মিরে রাজনৈতিক অসন্তোস দমন এবং দেশের কিছু অংশে সিএএর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রশমনে সেনাবাহিনীর ওপর মোদির ভরসা সুযোগ গ্রহণ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলরা মনে করছেন, রাজনৈতিক বিষয়াদিতে তারেদ হস্তক্ষেব বাড়ানোর এটিই যথার্থ সময়। সিএএর বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রার বিক্ষোভে ছাত্রদের সম্পৃক্ততা নিয়ে জেনারেল রাওয়াতের মন্তব্য আসলে হিমবাহের চূড়ামাত্র। হিন্দু উন্মাদনার কারণে ভারত যত মেরুকরণের মুখে পড়বে এবং মুসলিমবিরোধী বিজেপির নীতি যত কঠোর হবে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তত বেশি রাজনীতিকরণ ঘটবে।

সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সরকারের অধীনে, কিন্তু বাস্তবে গত কয়েক বছরে আগে পুরোপুরি বেসামরিক বিবেচিত বিষয়াদিতে তাদের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিবর্তন পর্যালোচনা এবং ভারত-অধিকৃত কাশ্মির ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে জনপ্রিয় আন্দোলন দমনে সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে বিজেপি সরকারের জেনারেলদের তোষামোদ করার তিনটি ঘটনার দিকে আলোকপাত করা যায়। প্রথমত ১৯৮৯ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে সিয়াচেন বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের সাথে একটি চুক্তি প্রায় হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী বেঁকে বসায় তা হয়নি। তাদের মতে, এটি করা হলে ভারতের ভূখণ্ডগত অবস্থান পরিবর্তন হয়ে দেশের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে।

১৯৮৪ সালে পাকিস্তানি বাহিনী শীতকালের স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে পেছনে সরে আসার সুবিধাটি গ্রহণ করে ভারত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা হিমবাহটির অংশবিশেষ দখল করে নেয়। এরপর থেকে সিয়াচেন হয়ে আছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ রণাঙ্গন। পাকিস্তান এলাকাটিকে বেসামরিক জোন ঘোষণা, শান্তি পার্ক প্রতিষ্ঠার মতো উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর অনেক প্রস্তাব দিয়ে এলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। ২০০৫-০৬ সালে মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমাধান কারমনা করলেও ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল জে জে সিং বিরোধিতা করেন। ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের প্রাক্কালে ভারতীয় সেনাবাহিনী সিয়াচেন হিমবাহে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সামনে সেনাবাহিনী ‘বেসামরিককরণ সিয়াচেনের’ বিরোধিতার কথা ঘোষণা করে।

দ্বিতীয়ত, গত ছয় বছরে বিজেপি ও এর হিন্দু জাতীয়তাবাদী মিত্ররা তাদের আদর্শবাদী ব্যক্তিদের আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে প্রবেশ করিয়েছে। এর ফলে এই চার বিভাগই তাদের নিরপেক্ষতা খুইয়েছে। যখনই সরকারের কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনী সমর্থন জানায়, এর মানে দাঁড়ায়, জেনারেলরা প্রমোশন প্রত্যাশা করছেন। জেনারেল রাওয়াত যদি বিজেপির পক্ষে প্রকাশ্যে কথা না বলতেন, তবে তিনি সিডিএস হতে পারতেন না।

২০১৯ সালটি ভারতের জন্য পতনের বছর। মোদি সরকার কেবল ভারতের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার ইমেজেরই ক্ষতি করেননি, সেইসাথে সামরিক বাহিনীকেও তার স্বার্থে টেনে এনেছে। শাসনযন্ত্র ও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতার স্বাদ পেলে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইবে। আকার ও বিকেন্দ্রীকরণ কাঠামোর কারণে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর পক্ষে ক্ষমতা গ্রহন করা সম্ভব হবে না। তবে রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেলে ধারণা করা যেতে পারে “খাকি’ এগিয়ে এসে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। আর তাতে গণতান্ত্রিক ও ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে। সবচেয়ে বিপজ্জনক আশঙ্কা হলো ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়া।

এক্সপ্রেস ট্রিবিউন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us