রমজানের আগমনে রাসূল সা:-এর ভাষণ
রমজানের আগমনে রাসূল সা:-এর ভাষণ - সংগৃহীত
পবিত্র রমজান মাসের আগমন উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সা:-এর দেয়া এই ভাষণটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যদি রোজা থেকে বহু কাক্সিক্ষত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চাই, তাহলে এ ভাষণটিকে রোজ একবার হলেও পড়ে তদানুযায়ী আমল করা ভালো। প্রকৃতপক্ষে রাসূল সা:-এর এ খুতবাটির মধ্যে কেবল রমজানই নয়, বরং আমাদের সারা জীবনের পথ-পাথেয় রয়েছে। এর বাংলা নিম্নরূপÑ
হে লোক সকল!
নিশ্চয় তোমরা অবগত আছ যে, বরকত, রহমত আর ক্ষমার বার্তা নিয়ে আল্লাহর এই (রমজান) মাস সমাগত। এ মাসটি আল্লাহর কাছে অন্য সব মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। এ মাসের দিনসমূহও সর্বাপেক্ষা উত্তম। এ মাসের রাতগুলোও সবচেয়ে মহৎ। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-ঘণ্টা অন্য ক্ষণ-ঘণ্টার চেয়ে উৎকর্ষবাহী। এ মাসে তোমাদেরকে আল্লাহর মেহমানদারিত্ব গ্রহণের দাওয়াত করা হয়েছে। এ মাসে তোমাদেরকে আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ ও বদান্যতা প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
তাই এ মাসে তোমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাসবিহ করার ফজিলত দেয়া হবে। তোমাদের ঘুমকেও ইবাদতের অন্তর্গত করা হবে, তোমাদের সব প্রকার আমল কবুল করা হবে এবং তোমাদের সব দোয়া-প্রার্থনা পূরণ করা হবে। সুতরাং তোমরা বিশুদ্ধ নিয়ত ও নিষ্কলুষ অন্তরযোগে আল্লাহর কাছে এ আর্জি পেশ করো, যেন তিনি তোমাদের যথাযথভাবে এ মাসের রোজা আদায় ও তার কিতাব তিলাওয়াতের তাওফিক দেন।
তোমরা জেনে রাখো, যে মানুষ এ মহান মাসে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃত অসুখী। তোমরা এ মাসে যে ক্ষুধা ও তৃঞ্চা অনুভব করবে তার মধ্য দিয়ে কিয়ামত দিবসের (অন্তহীন) ক্ষুধা ও (অসহনীয়) তৃঞ্চার কথা স্মরণ করবে।
হে মানুষগণ!
তোমরা তোমাদের ফকির ও মিসকিনদের জন্য সাদাকা করো, তোমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করো, ছোটদের করুণা করো, আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগাও, জিহ্বার হেফাজত করো, হারাম-দৃষ্টি দেয়া থেকে নিজেদের চোখ হেফাজত করো এবং শুনতে মানাÑ এমন কিছু শোনা ও করা থেকে বিরত থাকো।
(বর্তমানে) এতিমদের প্রতি মমত্ব প্রদর্শন করো, বিনিময়ে (ভবিষ্যতে) তোমাদের এতিমরাও মমতাপ্রাপ্ত হবে। তোমরা স্বীয় গোনাহের জন্য তওবা করো এবং প্রত্যেক নামাজান্তে উপরে হাত উত্তোলন করো। কেননা, নামাজান্তের সময়গুলো এর জন্য শ্রেষ্ঠতম সময়। এ সময়গুলোতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি প্রসারিত করেন। আল্লাহ তার বান্দাদের কথার উত্তর দেন, তাদের চাওয়া-চাহিদা পূরণ করেন এবং ডাকলে সাড়া দেন।
হে লোক সকল!
জেনে রাখো, তোমাদের আমলের ওপর তোমাদের নফসের (শুভ-অশুভ) পরিণতি নির্ভরশীল। এ জন্য ইসতেগফারের মাধ্যমে স্বীয় নফসের মুক্তি সাধন করো। জেনে রাখো, দুষ্কর্মের ভারে তোমাদের পৃষ্ঠদেশ যখন ভারাক্রান্ত, তখন তা প্রলম্বিত সেজদাহর মাধ্যমে তা হালকা করে নেবে।
তোমরা জেনে রাখো যে, আল্লাহ তার ইজ্জতের কসম করে নামাজি ও সেজদাকারীদের শাস্তি দেবেন না মর্মে অঙ্গীকার করেছেন। এও অঙ্গীকার করেছেন যে, কিয়ামতের ময়দানে বিশ্ব প্রতিপালক স্বীয় প্রভুর সামনে যখন সব মানুষ দাঁড়াবে, তখন তিনি নামাজি ও সেজদাকারীদের আগুনের স্পর্শ বা ভয়ও দেখাবেন না।
হে মানুষগণ!
এ মাসে তোমাদের কেউ যদি একজন রোজাদারকে ইফতার করায়, তবে সে আল্লাহর কাছে একজন দাস মুক্ত করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। তখন সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা:কে জিজ্ঞাসা করেনÑ হে আল্লাহর রাসূল আমাদের মধ্যে যাদের এরূপ সাদকা করার সক্ষমতা নেই তারা কী করবে? তখন উত্তরে রাসূল সা: বলেনÑ ‘তোমরা খেজুরের কিয়দাংশ দান অথবা এক ঢোক পানি পান করিয়ে হলেও আগুন থেকে আত্মরক্ষা করো।’
হে মানুষগণ!
এ মাসে তোমাদের মধ্যে যে নিজ চরিত্র উন্নত করবে সে পুলসিরাতে যখন মানুষের পা পিছলে পড়তে থাকবে, তখন নিজেকে ওই চরিত্রের বদৌলতে পার করে নিতে পারবে। এ মাসে যে ব্যক্তি তার অধীনস্থদের কর্মভার লঘু করবে আল্লাহ তার আমলের হিসাব হালকা করে নেবেন। এ মাসে যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি বা অনিষ্ঠ করার মানসিকতা অবদমিত করবে, বিনিময়ে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন না। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো এক অনাথের প্রতি করুণা করবে, আল্লাহর সাক্ষাত দিবসে তার প্রতি করুণা প্রদর্শন করা হবে।
এ মাসে যে মানুষ তার আত্মীয়তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করল, রোজ কিয়ামতে আল্লাহ তাকে তার রহমত দিয়ে সম্পৃক্ত করে নেবেন। আর যে ব্যক্তি তার আত্মীয়তা ছিন্ন করল, রোজ কিয়ামতের সাক্ষাতে তাকে আল্লাহ তার রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন।
এ মাসে যে কেউ একটি নফল নামাজ পড়ে, তখন তার এ নামাজের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম-মুক্তির ফায়সালা করবেন। এ (মহিমান্বিত) মাসে কেবলমাত্র একটি ফরজ আদায় করলে অনান্য মাসের তুলনায় সত্তরটি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে। আর যে ব্যক্তি আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করবে, আমলনামা হালকা হওয়া আশঙ্কার দিনে আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামা ভারী করে দেবেন। এ ছাড়াও এ মাসে কুরআনের একটি আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াতের সওয়াব অন্যান্য মাসে কুরআনের পূর্ণ এক খতম সওয়াবের সমতুল্য।
হে মানুষগণ!
জেনে রাখো, এ মাসে বেহেশতের সব দরজা খোলা থাকে। সুতরাং এ সব দরজা যেন তোমাদের জন্য বন্ধ না হয়ে যায় এ প্রার্থনা তোমরা তোমাদের রবের কাছে করতে থাকো। এ মাসে জাহান্নামের আগুনের দরজা বন্ধ করা হয়। সুতরাং এ সব দরজা যেন তোমাদের জন্য পুনরায় খোলা না হয়, এ ফরিয়াদ তোমাদের রবের কাছে করতে থাকো। এ মাসে শয়তান শৃঙ্খলবদ্ধ থাকে, তাই এ সব শয়তান যেন পুনরায় তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে না দেয়া হয়Ñ এ আবেদন তোমাদের রবের কাছে করতে থাকো।
রাসূল সা:-এর এ ভাষণ শেষে হজরত আলী রা: উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূল সা:কে বললেনÑ হে আল্লাহর রাসূল এ মাসের শ্রেষ্ঠতম আমল কী তবে?
জবাবে রাসূল সা: বললেনÑ ‘হে আবুল হাসান, এ মাসের শ্রেষ্ঠতম আমল হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার নিষেধসমূহ থেকে দূরে থাকা।
লেখক : সভাপতি ও অধ্যাপক
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া